বুধবার, মে ১, ২০২৪
প্রচ্ছদফিচারশেখ হাসিনার পঞ্চম মন্ত্রিসভা এবং চট্টগ্রাম

শেখ হাসিনার পঞ্চম মন্ত্রিসভা এবং চট্টগ্রাম

মন্ত্রিসভার আকার আর বাড়বে কি না সেটা একমাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই জানেন। কারণ মন্ত্রিসভা গঠন তাঁরই এখতিয়ার। মন্ত্রীরা তাঁর কাছেই দায়বদ্ধ থাকেন, তাঁর কাছেই জবাবদিহি করেন। তবে এই মন্ত্রিসভায় চট্টগ্রাম থেকে মাত্র দু’জন এমপিকে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখে চট্টগ্রামের মানুষের মন হতাশায় ভেঙে পড়েছে। বারবার চট্টগ্রাম থেকে তিন চারজন মন্ত্রী হন, এবারই ডা. হাছান মাহমুদ আর ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। হাছান মাহমুদ এখন জাতীয় নেতা, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তাঁকে চট্টগ্রামের কোটায় না ধরে, কেন্দ্রের কোটায় ধরাই ভাল। সেক্ষেত্রে চট্টগ্রাম মন্ত্রী পেয়েছে মাত্র দু’জন। আগে মোশাররফ ভাই মন্ত্রী ছিলেন, ডা. আফছারুল আমীন মন্ত্রী ছিলেন। মান্নান ভাই যখন ছিলেন, তখন তিনিও মন্ত্রী ছিলেন। গতবার সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ মন্ত্রী, নওফেল উপমন্ত্রী ছিলেন। এবার মোশাররফ ভাই সংসদ নির্বাচন করেননি, ছেলে মাহবুবুর রহমান রোহেলকে করিয়েছেন, তিনি এমপি হয়েছেন। মোশাররফ ভাই এমপি না হওয়ায় মন্ত্রী হতে পারলেন না। নওফেল প্রমোশন পেয়ে পূর্ণ মন্ত্রী হলেন। আখতারুজ্জামান বাবুর পুত্র সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ এমপি হয়েছেন, কিন্তু তাঁর ‘ফুফু’ শেখ হাসিনা তাঁকে মন্ত্রিত্বের জন্য ডাকেননি। তাঁর পিতার সঙ্গে নেত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো ভাই বোনের মতো। জাভেদ নিজে শেখ হাসিনাকে মায়ের মতো সম্মান করেন। তারপরও তিনি মন্ত্রী না হওয়ায় গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে। তবে অনেকে মনে করেন, এটাই চূড়ান্ত নিয়োগ নয়। আরো মন্ত্রী নেয়া হতে পারে। চট্টগ্রামের মানুষ আশা করে নেত্রী চট্টগ্রাম থেকে আরো ক’জন মন্ত্রী নিয়োগ করবেন। শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রিসভায়ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে তিনজন মন্ত্রী ছিলেন–এমএ মান্নান, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও কল্পরঞ্জন চাকমা। আর খালেদা জিয়ার প্রথম মন্ত্রিসভায় তিনিও চট্টগ্রাম থেকে তিনজনকে মন্ত্রী করেছিলেন–আবদুল্লাহ আল নোমান, কর্নেল অলি আহমদ ও মোরশেদ খান।

শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় (২০০৮) চট্টগ্রাম থেকে মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন ৪জন–দিলীপ বড়ুয়া, ডা. আফছারুল আমীন, ড. হাছান মাহমুদ ও দীপংকর তালুকদার।

খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় চট্টগ্রাম থেকে ঠাঁই পেয়েছিলেন ৮জন; আবদুল্লাহ আল নোমান, মোরশেদ খান, এল কে সিদ্দিকী, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাউদ্দিন আহমদ, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, মীর নাছিরউদ্দিন ও মনি স্বপন দেওয়ান।

শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভায় (২০১৪) বৃহত্তম চট্টগ্রাম থেকে মন্ত্রিসভায় স্থান প্রাপ্তরা হলেন–নুরুল ইসলাম বিএসসি, মোশাররফ হোসেন, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বীর বাহাদুর ঊ শৈ সিং। শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রিসভায় (২০১৯) বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে যাঁরা মন্ত্রী হন–ড. হাছান মাহমুদ, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, বীর বাহাদুর উ শৈ সিং। শেখ হাসিনার পঞ্চম মন্ত্রিসভায় (২০২৪) মন্ত্রিসভায় স্থান প্রাপ্তরা হলেন– ড. হাছান মাহমুদ, ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা।

এই হিসাব থেকে যেটা বেরিয়ে আসছে সেটাই এখনো পর্যন্ত বিএনপিই এক মেয়াদে বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে সবচেয়ে বেশি ৮জনকে মন্ত্রী করেছে, আওয়ামী লীগ সর্বোচ্চ ৪জনকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়েছে ৩য় মন্ত্রিসভায় (২০১৪)-বিএসসি, মোশাররফ, আনিস, বীর বাহাদুর। সবচেয়ে কম মন্ত্রী বানিয়েছে এবার মাত্র দু’জনকে। চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্রিসভায় প্রত্যেকবারই তিনজন করে মন্ত্রী।

চট্টগ্রামের সমস্যাও কম নয়। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর, বাণিজ্যিক রাজধানী এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রাম বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। জলাবদ্ধতা, যানজট, গ্যাস, পরিবেশ দূষণ, চট্টগ্রামের জীবন প্রবাহ কর্ণফুলী দখল–দূষণ ইত্যাদি মোকাবেলার জন্য একজন মন্ত্রী যথেষ্ট নয়। চট্টগ্রামের উন্নয়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর অধিদপ্তর মিলিয়ে ৩২টি সংস্থা জড়িত। তাদের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই, তাদেরকে এক জায়গায় বসানোর জন্য কোন আমব্রেলা সংগঠন নেই। নেই কোন মন্ত্রী। এমতাবস্থায় আরেকজন মন্ত্রী থাকলে তিনি সমন্বয়ের কাজটা করতে পারতেন। তাছাড়া ভূমি মন্ত্রী হিসেবে জাভেদ তাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। মগী চিটা, আর এস, সি এস, বিএস, জরিপের নানা খতিয়ান, দলিল নির্ভর ভূমিব্যবস্থায় বিভিন্ন মধ্যস্বত্তভোগী, টাউট–বাটপাররা ছিলো, যাদের জন্য ভূমি নিয়ে কৃষকদের দুর্ভোগের অন্ত ছিলো না। জাভেদ মান্ধাতার আমলের এই জীর্ণ পুরাতন ভূমি ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করে মানুষের জমি বেচাকেনা, নামজারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে হয়রানি কমিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন মন্ত্রীর কথায় প্রথমেই জাভেদের কথা এসে পড়লো। কারণ তাঁর নামই বেশি আলোচিত হচ্ছে জনমানসে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর স্নেহভাজন ও আস্থাভাজন মানুষ, বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ আখতারুজ্জামান বাবুর পরিবারের সদস্য, সুতরাং মন্ত্রিসভায় তিনি তো থাকবেনই, এমনটাই ছিলো সবার ধারণা। সেজন্য তাঁর নাম না থাকাটা এত অস্বাভাবিক প্রতিপন্ন হয় যে হঠাৎ সেটা কারো বিশ্বাসই হতে চায় নি।

আমেরিকায় লেখাপড়া করা জাভেদ একজন আধুনিক মানুষ, তাঁকে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিলেন, তখন তিনি বিস্মিতই হয়েছিলেন। আর যাই করুন না কেন, তিনি কখনো ভূমিজীবী ছিলেন না। ভূমির সাথে সম্পর্ক ছিল তাঁর পিতামহ নুরুজ্জামান চৌধুরীর। নুরুজ্জামান চৌধুরীর পিতা ও পিতামহ জমিদার গোছের লোক ছিলেন। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পিতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও তাঁর বড় ভাই বশিরুজ্জামান চৌধুরীর আমল থেকে ভূমিকেন্দ্রিক পরিবারটা প্রথমে ব্যবসায়ী, পরে শিল্প পরিবারে রূপান্তরিত হয়। জাভেদ শিল্পপতির পুত্র হিসেবে জন্ম নিয়েছেন এবং শিল্পপতি হিসেবে বেড়ে উঠেছেন। সুতরাং ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব যখন শেখ হাসিনা তার কাঁধে অর্পণ করলেন, তখন জাভেদের কাছে সেটা যেমন আকস্মিক একটা ব্যাপার ছিল, তেমনি কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। জাভেদ চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেছিলেন এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি তাঁর দায়িত্ব খুব সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন করে তাঁর নেত্রীর সম্মান রক্ষা করেছিলেন। জাবেদ শত শত বছরের প্রাচীন ম্যানুয়েল পদ্ধতির ভূমি ব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়ে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন করে আমাদের দেশের ভূমিব্যবস্থায় বিপ্লব সাধন করেছিলেন। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্যকে খুব ভালভাবে আত্মস্থ করে ভূমি ব্যবস্থাকেও স্মার্ট করে গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ায় তাঁর সে উদ্দেশ্য আর পূরণ করা হয়তো সম্ভব হবে না।

বিগত মন্ত্রিসভায় যাঁরা খুব ক্লিন, সৎ ও পরিচ্ছন্নমন্ত্রী হিসেবে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ তাদের মধ্যে অন্যতম। যেমন মতিয়া চৌধুরী সততার চূড়ান্ত উদাহরণ ছিলেন। জাভেদের নামে কোন বদনাম ছিল না, কোন রকম দুর্নীতি, অনিয়ম কিংবা স্বজনপ্রীতির কোন অভিযোগ ছিল না। তাঁর ঘোর শত্রুও বলতে পারবে না যে, সাইফুজ্জামান মন্ত্রী–এমপি হয়ে নিজের আখের গুছিয়েছেন, বা ধন সম্পদে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। তিনি এমপি মন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই ধনী, পারিবারিকভাবে সম্পদশালী। সুতরাং মন্ত্রী–এমপি নাম ব্যবহার করে তার সম্পদ গড়ে তোলার বা বাড়ানোরও কোন প্রয়োজন ছিল না। তবে তার এই বাদপড়াটা সাময়িকও হতে পারে। একবার বাদ পড়লেই যে, চিরতরে বাদ পড়ে গেলেন এমন ধারণা করা হয়তো ঠিক নয়। কিছুদিন পর হয়তো বাদপড়া কোন কোন মন্ত্রী আবার মন্ত্রিসভায় ডাক পেতে পারেন।

নতুন কোন মুখও মন্ত্রিসভায় আসতে পারে। যে কোনো এক বা দুজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীর জন্য বিবেচনা করা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ