মঙ্গলবার, অক্টোবর ১৫, ২০২৪
প্রচ্ছদইন্টারভিউমানবতাবিরোধী অপরাধ : মুজাহিদের বিরুদ্ধে রায় যেকোনো দিন

মানবতাবিরোধী অপরাধ : মুজাহিদের বিরুদ্ধে রায় যেকোনো দিন

mujahid Jamatএকাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামাত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলার রায় যে কোনো দিন ঘোষণা করা হবে।

মামলার শেষ ধাপ যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ দেয়।

প্রায় এক বছরের বিচারিক কার্যক্রম শেষে রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেছে, তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগই প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। বিপরীতে একটি অভিযোগেও মুজাহিদকে সাজা দেয়া যায় না বলে দাবি আসামিপক্ষের।

ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষের যুক্তির জবাবে পাল্টা যুক্তিতর্ক ও সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ। এর আগে মঙ্গলবার মুজাহিদের পক্ষে আইনি পয়েন্টে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। মুজাহিদের বিরুদ্ধে দিতে যাওয়া এ রায় হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চতুর্থ রায়। এর আগে জামাতের সাবেক নেতা আবুল কালাম আযাদ, জামাতের দুই সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

গ্রেপ্তার:

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

অভিযোগ দাখিল :

গত বছরের ১৬ জানুয়ারি মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল-১ এ ১০৯ পৃষ্ঠার ৩৪টি বিভিন্ন ঘটনাসহ মোট ৬ হাজার ৬৮০ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফরিদপুর ও ঢাকাসহ সারাদেশে সাধারণ মানুষকে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। ২৬ জানুয়ারি এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক মামলাটি দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করে।

অভিযোগ গঠন:

গত বছরের ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৭টি অভিযোগে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল-২।

সাক্ষ্য প্রদান :

মুজাহিদের বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকসহ রাষ্ট্রপক্ষের ১৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেছেন।

লেখক, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, মুক্তিযুদ্ধকালে গেরিলা বাহিনীর সদস্য জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল, সাংবাদিক মাহবুব কামালসহ ঘটনার অন্য সাক্ষীরা হলেন : শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে সাংবাদিক শাহীন রেজা নূর, মো. রুস্তম আলী মোল্লা, আব্দুল মালেক মিয়া, রঞ্জিত কুমার নাথ ওরফে বাবুনাথ।

এছাড়া মো. আবু ইউসুফ পাখি, মীর লুৎফর রহমান, একেএম হাবিবুল হক মুন্নু, ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ, চিত্তরঞ্জন সাহা ও শক্তি সাহা মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন।

আর জব্দ তালিকার সাক্ষীরা হলেন, বাংলা একাডেমির সহকারী গ্রন্থাগারিক মো. এজাব উদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রধান ডকুমেন্টশন কর্মকর্তা আমেনা খাতুন ও জাতীয় জাদুঘরের সংরক্ষক স্বপন কুমার।

মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনা যতো অভিযোগ :

মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে : শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা, সাধারণ মানুষ হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও দেশত্যাগে বাধ্য করা ইত্যাদি। মুজাহিদ একক ও দলবদ্ধভাবে সরাসরি জড়িত থেকে ও নেতৃত্ব দিয়ে কিংবা সহযোগিতা ও নির্দেশের মাধ্যমে এসব করেছে।

এক নম্বর অভিযোগ : একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগ থেকে ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ করা হয়। মুজাহিদের পরিচালনাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন ৭/৮ জন যুবক তাকে ধরে মিনিবাসে তুলে নেয়। তারপর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি তার।

অভিযোগ-২ এ বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাসে একদিন মুজাহিদের নেতৃত্বে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানায় বিভিন্ন গ্রামে হিন্দুদের প্রায় ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা। পরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন হিন্দু নরনারীকে হত্যা করে।

অভিযোগ-৩ এ বলা হয়েছে, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে যে কোনো একদিন ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট (রথখোলার) মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের পুত্র রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে।

বেলা অনুমান ১১টার দিকে ফরিদপুর পুরোনো সার্কিট হাউসে আসামি মুজাহিদের সামনে পাকিস্তানি সেনা অফিসার মেজর আকরাম কোরাইশীর কাছে হাজির করা হয় বাবু নাথকে। তখন মুজাহিদ ওই মেজরের সঙ্গে কথা বলার পর বাবু নাথের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তার একটি দাঁত ভেঙ্গে ফেলা হয়।

নির্যাতনের পর মুজাহিদের ইশারায় তাকে হত্যা করার উদ্দেশে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আব্দুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে রাজাকাররা আটকে রাখে। পরে রাতে রণজিৎ নাথ বাবু তার আটক ঘরের জানালার শিক বাঁকা করে ওই ঘর থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচান।

অভিযোগ-৪ এ বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৬ জুলাই সকাল বেলায় ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থেকে স্থানীয় রাজাকাররা মো. আবু ইউসুফ ওরফে পাখি, পিতা- মৃত মো. জয়নাল আবেদীন, গ্রাম-পূর্ব গোয়ালচামট খোদাবক্সপুর, থানা-কোতোয়ালি, জেলা-ফরিদপুরকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করা হয়।

এরপর পাখিকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটক করা হয়। আটক বন্দিদের মধ্যে আবু ইউসুফ পাখিকে দেখে মুজাহিদ সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি মেজরকে কিছু একটা বলার পরই তার উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। সেখানে ১ মাস ৩ দিন আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। নির্যাতনের ফলে আবু ইউসুফ পাখির বুকের ও পিঠের হাড় ভেঙ্গে যায়।

অভিযোগ-৫ এ বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাত ৮টায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি আসামি মুজাহিদ পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামীসহ ঢাকার নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলের আর্মি ক্যাম্পে যান। সেখানে তারা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালিগালাজ করেন এবং পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন যে, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আদেশের আগেই তাদের হত্যা করতে হবে।

আসামি মুজাহিদ অন্যদের সহায়তায় আটকদের একজনকে ছাড়া অন্যান্য নিরীহ-নিরস্ত্র বন্দিদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুমের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন।

অভিযোগ-৬ এ বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরবর্তীতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারাও ওই স্থানে ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ অপরাধজনক নানা কর্মকাণ্ড চালায়।

মুজাহিদ ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হওয়ার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র নেতা হিসেবে আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন আর্মি অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন।

এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র মাধ্যমে মুজাহিদ ১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযানেরসহ বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীসহ হত্যা, নির্যাতনসহ ইত্যাদি যাবতীয় মানবতবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা সংঘটিত করেন।

অভিযোগ-৭ এ বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ করে। শান্তি কমিটির বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

বকচর গ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হামালা চালিয়ে বিরেন্দ্র সাহা, উপেন সাহা, জগবন্ধু মিস্ত্রি, সত্য রঞ্জন দাশ, নিরোদ বন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহাকে আটক করা হয়। উপেন সাহার স্ত্রী রাজাকারদের স্বর্ণ ও টাকা দিয়ে তার স্বামীর মুক্তি চান। রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার কন্যা ঝুমা রানীকে ধর্ষণ করে।

পরে আটক হিন্দু নাগরিকদের হত্যা করে। তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। অনিল সাহাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ