শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪
প্রচ্ছদশিল্প ও সাহিত্যমস্তিষ্কের অবতারণা : শিপন নাথ

মস্তিষ্কের অবতারণা : শিপন নাথ

বর্ষার এক হালকা অন্ধকারাচ্ছন্ন বিকেল। সময় ৪.৩০ মিনিট। কিন্তু বাইরের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে ধরণীতে আজ সাঁঝের আবির্ভাব খুব তাড়াতাড়ি ঘটেছে। একটু আগেই ঝুম বৃস্টি হয়েছিল। এখন হচ্ছে। তবে ঝুম নয়,গুঁড়ি গুঁড়ি বৃস্টি। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। চারপাশ প্রায় কালো অন্ধকারে নিমজ্জ্বিত হতে চলেছে। এমন অবস্থায় চার-পাঁচ হাত দূরে সামনের কোন বস্তুকে লক্ষ্য করাও যেন মস্ত কঠিন কাজ।

ভাঙা ব্রীজটার পাশে সাত রাস্তার মাথায় ডান পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ব্রীজটা ভাঙা নয়। একদম সমতল এবং শক্ত।তবুও কেন জানিনা এর নাম ভাঙা ব্রীজ। এমন অদ্ভুত নাম কে দিলো! জানতে ইচ্ছে করছে। আমার গন্তব্যস্থল কদমতলী হাসপাতালের পাশেই অবস্থিত মর্গটার বিপরীতে থাকা একটি কামারের দোকান। উদ্দেশ্য হলো কয়েকটি ধারালো ছুড়ি কেনা। ১৩৭৫ গ্রাম ওজনের মস্তিষ্কে আজকাল অদ্ভুত সব খেয়াল ভেসে বেড়ায়। এইতো সেদিন ইচ্ছে হলো এজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে দাঁতের পরিক্ষা করাব। এমন উদ্ভট খেয়াল কেন এলো নিজেও জানিনা। আজ আবার মাথায় ছুড়ি কেনার ইচ্ছে হলো। তাও আবার যে সে ছুড়ি নয়। খুব ধারালো যাকে বলে একদম “পিউর শার্প”।

বৃস্টির কারণে শহরের রাস্তাঘাট সব ভিজে একাকার। রাস্তায় আবার যানবাহন চলাচল খুব কম। একদম নেই বললেই চলে । গত পনের মিনিট যাবৎ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি একটি রিক্সার জন্য। কিন্তু রাস্তায় না আছে কোনো রিক্সা আর না আছে কোনো সিএনজি বা টমটম। আরো মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করলাম। দূর থেকে একটা সিএনজি আসতে দেখছি। হাত বাড়িয়ে দিলাম থামানোর জন্য। কিন্তু থামলো না। এদিকে আকাশে আবার মেঘের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। হয়তো এক্ষুণি আবার ঝুম বৃস্টি শুরু হবে। দু মিনিট বাদেই একটি টমটম আসতে দেখে আবার হাত বাড়িয়ে দিলাম। টমটম ড্রাইভার আমার পাশে দু হাত দূরে এসে তার টমটম সাইড করে থামালো। ব্যাস। আর প্রতীক্ষা না করে তড়িঘড়ি করে দৌড় দিয়ে উঠে পরলাম টমটমে।পেছনের সিটটায় একজন বয়স্ক ব্যক্তি এবং ছোট একটি বাচ্চা মেয়ে বসে আছে। বয়স্ক ব্যক্তিটি ফুঁক ফুঁক করে কিছুক্ষণ পরপর কাসি দিচ্ছেন। আমি সেই পাঁচ ছয় বছর বয়সী বাচ্চা মেয়েটার মুখোমুখি বসতেই মেয়েটা হুট করেই চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিলো। কি আশ্চর্য!! আমি অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম। মেয়েটা কাঁদছে তো কাঁদছেই। কেঁদেই চলেছে।কোনোদিকে একদমই হুঁশ নেই। মেয়েটার গাল বেয়ে টপ টপ করে নোনা জল গড়িয়ে পরছে অনবরত। টমটম চলতে শুরু করলো।

একসময় মেয়েটার কান্না কিছুটা থেমে এলো। আমি শান্ত হয়ে বসলাম। বয়স্ক ব্যক্তিটির অন্যদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। কিন্তু এ কি! মেয়েটি একটু পরেই আবার চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিলো। একটা বাচ্চা মেয়ে এতো কান্না করতে পারে! আর কান্না করলেও ঠিক কি কারণে কান্না করছে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। মেয়েটার কান্না কিছুতেই থামছে না। এক নাগাড়ে কেঁদেই চলেছে৷ কি বিরক্তিকর, উঠকো ঝামেলায় পরলাম। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে খুব। শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে৷ নিজের অজান্তেই চোখ দুটো লাল হয়ে আসছে। আমি ভ্রু কুঁচকে মেয়েটির পাশে বসা বয়স্ক লোকটির দিকে তাকাতেই তাঁর সাথে আমার চোখাচোখি হলো। আমার ভ্রু কুঁচকানো প্রশ্ন বিদ্ধ চোখ দেখে লোকটি থতমত খেয়ে গেলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। বলার চেস্টাও করেননি। আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে একটি কৃত্রিম মুচকি হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে দিলাম। এবার তা দেখে বয়স্ক লোকটি আরো ঘাবড়ে গেলেন। তিনি রীতিমত অবাক। অন্যদিকে বাচ্চা মেয়েটি এখনও কাঁদছে। চোখের নোনা জল তার গাল বেয়ে চিবুকে গিয়ে ঠেকছে। আমি বয়স্ক লোকটির ভাব-ভঙিমায় বুজতে পারলাম তিনি প্রচুর ঘাবড়ে গিয়েছেন এবং তার চোখে ভয় স্পষ্ট লক্ষণীয়। হঠাৎ লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে নিজে থেকেই বললেন, “ইবে আর নাতিন। ইতির উগ্গো ভাই আছিলো৷ ফুয়াগো বোদ ভালা। কিন্তু সতান বেশি। কালিয়ে বেনে ঘুন্টি উড়োইতু যায় আরো বাসার ছাদততুন ফরি গেইয়ি। এখন মেডিকেলত ভর্তি আছে। হেতারলাই কানদের যে উয়া। কিত্তাম ক চাই। আয় বুড়ো মানুষ। ইতির কানদন থামায়ত ন ফারির।”

আমি লোকটির কথা চুপ করে শুনলাম এবং বুজলাম- এমন ভাব করে মাথা ঝোঁকালাম। ছোট্ট ওই পুচকে মেয়েটির দিকে এবার একটু ভালো করে লক্ষ্য করলাম। চিকনচাকন শরীরের হালকা গড়ন। গায়ে নীল রঙের গোল জামা আর লাল রঙের ফুলহাতা সোয়েটার। সোয়েটারের চেইনটা সামনের দিকটায় খোলা। নীল জামাটিতে মাঝারি আকারের হলুদ রঙের অর্ধ চতর্ভুজ আকারের প্রিন্ট। বৃস্টি পরছে খুব।কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা একদম ঘেমে গিয়েছে। জটিল বিষণ্ণতা ! কিন্তু এমন ক্রন্দনরত অবস্থায় মেয়েটিকে দেখতে ভালোই লাগছে। চোখের পাপড়িগুলো বেশ বড় বড় হওয়ার দরুণ কান্না করার সময় পাপড়িগুলো কি সুন্দর করে সারি বেঁধে একটা আরেকটির সাথে লেগে আছে। কি অদ্ভুত! আমি মেয়েটির চিবুকের নিচে আলগা করে আমার বাম হাতটি ধরে রেখেছি। ওর চোখের নোনা জল টপ টপ করে পরছে আমার বাম হাতের তালুতে। কিছুসময়ের মধ্যেই কয়েক ফোঁটা জলের মিশ্রণ জমেছে বেশ খানিকটা। আমি সেই নোনা জলটুকু দিয়ে হাতের তালুতে নিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেললাম। মেয়েটির চোখ মুছে দিলাম যাতে আর কান্না না করে। কান্না থামালো সে। কিন্তু কি আশ্চর্য! মেয়েটি আবার কাঁদছে। এবার আরও জোড়ে। বাচ্চা মেয়েটির কান্না দেখে এখন আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে। কিন্তু কান্নার শব্দটা অমন বিশ্রি শোনাচ্ছে কেন? কান্নার কি অঙ্গভঙ্গি নেইম মেয়েটি সুন্দর করে কাঁদতে পারে না। তাহলে এতো কান্না করার কী দরকার? কান্নার আওয়াজে আমার মস্তিষ্কে উদ্ভট ধরণের খেয়ালিপনা হামলা দিচ্ছে।

বয়স্ক লোকটির সামনেই আমি খপ করেই মেয়েটিকে তুলে নিয়ে আমার কোলে বসালাম। এত দ্রুত কাজটি করলাম যার ধারাবাহিকতায় মেয়েটি ভয় পেয়ে গেল। ভয়ের কারণে মেয়েটির কান্না থেমে গেলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। বয়স্ক লোকটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তিনি পুনরায় অবাক হয়ে গেলেন। আমার অমন কার্যকলাপে তিনি বিভোর হয়ে পরলেন এবং মুখে কৃত্রিম হাসি ফোটালেন। মেয়েটি ঘাড় বাঁকিয়ে একবার আমার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকানো শেষে মুখটা সামনের দিকে নিয়ে তুখটা কঠিন করে কেঁদে দিলো আবার। এখন ওর কান্নার ধরণটা অদ্ভুত শোনাচ্ছে। কারণ, একটু কাঁদার পর পর একটা করে হিঁচকি দিয়ে যাচ্ছে। তাই আমি বিরক্ত হয়ে মেয়েটির মুখ আমার ডান হাতটা দিয়ে চেপে ধরলাম। কিছুক্ষণ কোন শব্দ হলো না। আমি আমার হাতটা আমার সরিয়ে নিলাম। টমটমের লুকিং গ্লাসে আমাকে আর মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে। ড্রাইভারও মেয়েটির কান্না শুনে রীতিমত বিরক্তি অনুভব করছে। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। এতে মেয়েটি আরো শব্দ করে কাঁদতে আরম্ভ করলো। আমি বাম হাতে চামড়ার বেল্টে বদ্ধ ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে কপালে ভাঁজ ফেললাম। গত চব্বিশটা মিনিট যাবৎ আমি মেয়েটার কান্না শুনছি! কি অসহ্য।

বাইরে ঝুম বৃস্টি হচ্ছে। বয়স্ক লোকটি গুঁটিসুঁটি হয়ে বসেছেন যাতে বাইরের বৃস্টির জল তার গায়ে ছিটকে না পরে।হঠাৎ, লক্ষ্য করলাম ড্রাইভার টমটমের গতি বাড়িয়ে দিলো। সামনে থেকে একটা বাস আসছে দ্রুত গতিতে। বড় রাস্তা। কিন্তু পুরোপুরি ফাঁকা। বাসটি টমটমের কাছাকাছি আসতেই আমি মেয়েটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম রাস্তায়। বাসের ড্রাইভার কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটার উপর দিয়ে বাসটা চলে গেলে। আর মেয়েটার মাথাটা গিয়ে পড়ল চারটে চাকার নিচে। বট করে একটা শব্দও হলো। মেয়েটির মাথাটা ফুঁটে গেছে। প্রচুর গ্যাস ভরা বেলুন হঠাৎ করে ফুটে গেলে যেমনটা শব্দ হয় ঠিক তেমনটাই।

কল্পনার জগৎ থেকে তখনই প্রস্থান করলাম যখন প্রচন্ড জোড়ে কোনো কিছুর সাথে টমটমের সংঘর্ষ হয়েছিল।ধ ড্রাইভার জোড়ে ব্রেক কষে সামনের সিএনজিকে ঠেঙিয়ে দিয়েছে। সামনে থেকে ড্রাইভারকে কেউ একজন বলে উঠলো, “শালা বেরেক ধরিত ন পারস আবার গাড়িও চালছ? নাম শালা নাম। গাড়িত্তুন নাম। আর সিএনজিরে ধাক্কা মারছ? তোর এত সাহস!” আমি বাচ্চা মেয়েটিকে বয়স্ক লোকটির কাছে বুঝিয়ে দিলাম। মেয়েটিএখনো কাঁদছে। বয়স্ক লোকটি বাচ্চাটিকে কান্না থামানোর জন্য ধমকাচ্ছেন। তা দেখে আমি কৃত্রিম হাসিটা ঝুলিয়ে দিলাম ঠোঁটের কোণে।

[গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক ]

আরও পড়ুন

সর্বশেষ