রবিবার, মে ১২, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়যুদ্ধাপরাধের বিচার : আপিল নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা

যুদ্ধাপরাধের বিচার : আপিল নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা

ডেস্ক রিপোর্ট (বিডি সময় ২৪ ডটকম)

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দ-প্রাপ্তদের আপিল নিষ্পত্তি আইনে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে শেষ হচ্ছে না। আইনে নির্ধারিত সময়সীমা ৬০ দিন উল্লেখ থাকলেও, এ সময়ের মধ্যে একটি মামলারও আপিল নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে একটি মামলার শুনানি চলাবস্থায় আরেকটি মামলার শুনানি করাও সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধের মামলার তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। ফলে একের এক মামলা আপিল বিভাগে যুক্ত হওয়ায় নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতার পাশাপাশি এই সরকারের আমলে রায় বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনেরা।

এরই মধ্যে জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার আপিলের শুনানি শেষে রায় ঘোষণা পর্যন্ত সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে সাত মাস। বর্তমানে এই মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে জাতিকে। সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি প্রকাশ পেলেই কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করতে আর কোনো বাধা থাকবে না বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। তবে আসামিপক্ষ রিভিউর সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।

একাত্তরে হত্যা-ধর্ষণের মতো অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয় চলতি বছরের পাঁচ ফেব্রুয়ারি। এরপর উভয়পক্ষের আপিল শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির  সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগ গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের আপিল মঞ্জুর করে সাজা বাড়িয়ে কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করার রায় ঘোষণা করেন। এটাই ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম আপিল মামলা।

এরপরই রয়েছে দলটির নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল নিষ্পত্তির বিষয়টি। গত ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে এ মামলার আপিল শুনানি শুরু হয়। এখনও শুনানি অব্যাহত রয়েছে। আপিলের প্রায় ৬ মাস পর এ মামলার শুনানি শুরু হয়। এ মামলাটি এখনও আপিল শুনানির প্রাথমিক ধাপেই রয়েছে বলে জানা গেছে। সাঈদীর মামলায় প্রমাণিত অভিযোগগুলোতে সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষ আর ফাঁসির দন্ডাদেশ থেকে খালাসের আরজি জানিয়ে আপিল করেছেন আসামিপক্ষ। চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সাঈদীকে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেয়। এরপর আইন অনুযায়ী রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ সুপ্রিমকোর্টে আপিল করে।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পরই রয়েছে দলটির সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলা। এই মামলাটিও ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ইতিমধ্যে প্রায় পাঁচ মাস অতিক্রম হলেও এখনও শুনানির তারিখ ধার্য হয়নি। যদিও উভয়পক্ষ মামলার সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছে। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও রাষ্ট্রপক্ষ ন্যায় বিচার চেয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেছে। ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজা অপর্যাপ্ত উল্লেখ করে গোলাম আযমের ফাঁসির আরজি জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ এবং ৯০ বছরের কারাদন্ডাদেশ থেকে খালাসের আরজি জানিয়ে আপিল করেছে আসামিপক্ষ।
গোলাম আযমের পাশাপাশি একই কাতারে রয়েছে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মামলাটি। এই মামলা দুটি ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর প্রায় তিন মাস হতে চললেও মামলার সারসংক্ষেপ এখনও কোনো পক্ষই আদালতে জমা দেয়নি বলে জানা গেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে চলতি বছরের ৯ মে কামারুজ্জামানকে ও ১৭ জুলাই মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকরের রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। এই দু’জনই সুপ্রিকোর্টে আপিল করেছেন ফাঁসির দন্ডাদেশ থেকে খালাস চেয়ে।

সর্বশেষ আপিল বিভাগে যোগ হতে চলেছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির  সদস্য ও সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলা। চলতি মাসের প্রথম তারিখে ট্রাইব্যুনাল-১ বিএনপির এই নেতাকে পৃথক চারটি অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণা করেন। রায়ের পর সাকা চৌধুরীর পরিবার ও তার আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালের রায় প্রত্যাখ্যান করে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, আসামিপক্ষ ট্রাইব্যুনালের ধারাবাহিকতায় সুুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগেও বিচারকার্য বিলম্বিত করার নানা কৌশল প্রয়োগ করছে। এর ফলে নির্ধারিত সময়ে আপিল শুনানি শুরু করা যাচ্ছে না। এরমধ্যে শুনানি শুরু করতে গড়িমসি, হরতালের অজুহাত দেখিয়ে শুনানির জন্য নির্ধারিত দিনে আদালতে না আসা, একই বিষয়ে বার বার আবেদন এবং বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে আবেদন করা অন্যতম।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের রায়ের ৩০ দিনের মধ্যে আপিল দায়ের করা আইনে বাধ্যতামূলক। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল আইনের (সংশোধন) ২১(৪) ধারা অনুসারে আপিল দায়েরের ৬০ দিনের মধ্যেই তা নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। অথচ একটি মামলাও আইনের বেধে দেয়া সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, আইনের এ বিধানটি বাধ্যতামূলক নয়। এটি নির্দেশনামূলক। কারণ, ওই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না হলে পরবর্তী প্রক্রিয়া কী হবে তা আইনে বলা নেই। তিনি বলেছেন, সর্বোচ্চ আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা রয়েছে। বিষয়টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা শুনতে ও রায় দিতে পারবেন আদালত।

উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এরই মধ্যে ৭টি মামলায় রায় ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, গোলাম আযম ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল-১। এছাড়া আব্দুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল-২। এর মধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, সাকা চৌধুরী ও বাচ্চু রাজাকারকে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেয়া হলেও গোলাম আযমকে ৯০ বছর ও কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ দেয়া হয়। এছাড়া বিচারকাজ শেষে সাবেক বিএনপি নেতা আব্দুল আলীম ও জামায়াতের প্রবাসী নেতা পলাতক চৌধুরী মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের মামলা রায়ের অপেক্ষায় (সিএভি) রাখা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ এই দুটি মামলার রায় ঘোষণা করবেন। তবে চলতি সপ্তাহে আলীমের মামলার রায় ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ