শনিবার, মে ৪, ২০২৪
প্রচ্ছদইন্টারভিউহঠাৎ তৎপর ইসি

হঠাৎ তৎপর ইসি

বিশেষ প্রতিনিধিঃ (বিডি সময় ২৪ ডটকম)

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে হঠাৎ তৎপর হয়ে উঠেছে নির্বাচন কমিশন। আকস্মিকভাবে বলা হচ্ছে নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি। ২৪ জানুয়ারির পূর্ববর্তী ৩৫ থেকে ৪৫ দিন আগে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার স্ট্যান্ডার্ড সময়। এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সিইসির কথায় মনে হয় নীল-নকশার পাতানো নির্বাচনের জন্য যেন তারা আগে থেকেই প্রস্তুত। ছিলেন শুধু ইঙ্গিতের অপেক্ষায়। দলদাসের মতো তড়িঘড়ি করে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সচিব সভার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণায় ইসির এই তৎপরতা নজীরবিহীন। ভোটার তালিকা প্রস্তুতের পর সাবেক সিইসি ড: শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি ভোটের ১০ মাস আগে নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরি করে হিমশিম খেয়েছেন। আর কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ কমিশন সরকারকে খুশি করতে এতোদিন ‘ক্ষমতা হ্রাস’ নিয়ে ব্যস্ত থেকে হঠাৎ নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রস্তুত করলেন? সরকারের ইশারায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ইসির নির্বাচনের হঠাৎ প্রস্তুতি নেয়ায় ‘সরকারের তল্পিবাহক’ বলা হচ্ছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও বিশিষ্টজনদের মতে বর্তমানের ইসি সরকার নিয়ন্ত্রিত। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর রোডম্যাপ করায় সরকারের ইচ্ছাপূরণের কমিশনে পরিণত হয়েছে।

পাঠ্যপুস্তুকের ভূমিহীন গণি মিয়া যেমন অন্যের জমি চাষ করে ফসল ফলায় তেমনি মেরুদন্ডহীন ইসি সরকারের আদেশ নির্দেশ পালন করছে। গতকালও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেছেন, এক দলীয় পাতানো নির্বাচন দেশের মানুষ মেনে নেবে না।

২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সচিব বৈঠকের কয়েকদিন আগে নির্বাচন কমিশনের সচিব ড: মোহাম্মদ সাদিক ‘নির্বাচনী বোমা’ ফাটান। সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেন, ২৭ অক্টোবর থেকে আগামী বছরের ২৪ জানুয়ারীর মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সচিবের এই বক্তব্যের পর কমিশনার মোঃ শাহনেওয়াজকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন তারিখের ব্যপারে তিনি অন্ধকারে। নির্বাচন কমিশনের সচিবের এ বক্তব্যের কয়েকদিন পর সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হবে সিদ্ধান্ত দেন।

সাবেক এক নির্বাচন কমিশনারের মতে নির্বাচন কখন হবে তা কমিশনের সচিব জানেন অথচ কমিশনার জানেন না এটা রহস্যজনক। হয়তো সচিবকে সরকার থেকে আগেই এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি মিডিয়ার সামনে তা মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন। তাহলে প্রশ্ন হলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এই নির্বাচন কমিশন কার? রাষ্ট্রের না আওয়ামী লীগের? নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা। নির্বাচনী বিধিবিধান করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা আনায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করা। সেটা না করে বর্তমান নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতিষ্ঠানের মতো আচরণ করছে। হুদা কমিশনের কিছু ব্যর্থতা থাকলেও তারা মেরুদন্ড খাড়া রেখেই কাজ করছে এবং বিদায়ের সময় আরো কিছু নির্বাচন সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর সে প্রস্তাবগুলো বাদ দেয় সরকারকে খুশি করতে। এ যেন নির্বাচন কমিশনে বসানোর প্রতিদান। হালুয়া-রুটির ভাগ পেয়ে কিছু সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজন যেমন সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী টকশোতে কথাবার্তা বলছেন এবং পত্রিকায় কলাম লিখছেন। তেমনি সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনও সেই পথ অনুসরণ করছেন। মূলত নির্বাচন কমিশনকে সরকারের ইচ্ছাপূরণের কমিশনে পরিণত করা হয়েছে। শুধু তাই নয় সরকারকে খুশি করতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৪১টি ধারায় ৫৭টি সংশোধনী চেয়ে একটি প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। একই সঙ্গে আচরণবিধি লংঘনের দায়ে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা (৯১-ই ধারা) বিলোপের প্রস্তাবও করা হয়। কমিশন সরকারের এতোই অন্ধভক্ত যে নিজেদের ক্ষমতা হ্রাস করার নজিরবিহীন প্রস্তাব করে। জনগণের প্রতিরোধের মুখে ইসি ক্ষমতা হ্রাসের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। প্রশ্ন হচ্ছে কে বেশি সরকারের তল্পিবাহক? সাবেক সিইসি বিচারপতি এমএ আজিজ না বর্তমানের সিইসি কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ?

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এমএ আজিজ ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার মাহফুজুর রহমান নিজেদের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার চেষ্টা করেছেন। বিরোধী দল সে সময় তাদের বিদায়ের দাবিতে আন্দোলন করলেও সে সময়ের সরকারকে পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ায় সরকার অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। কিন্তু কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ সরকারের ইচ্ছার বাইরে কোনো কিছুই করছেন না। সরকার থেকে কি নির্দেশ, আদেশ বা ইংগিত আসে সে জন্যই তীর্থের কাকের মতো প্রহর গনেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে হাঁটা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কমিশন বলছে সংবিধান অনুযায়ী ২৭ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচন করতে হবে। এর জন্য নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করে জানুয়ারির মাঝামাঝিতে নির্বাচন করার পরিকল্পনা হচ্ছে। কমিশন সরকার থেকে বার্তা পাওয়ার পর দফায় দফায় সভা করে রোডম্যাপ মূল্যায়ন খসড়া করা হয়েছে। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী আচরণবিধি ও নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা প্রণয়ন, মাঠ পর্যায়ে ভোটার তালিকা প্রেরণ, ভোটার তালিকার সিডি প্রস্তুত নির্বাচনী কার্যক্রমে ইউএনডিপির মাধ্যমে অর্থ সংস্থানের বিষয়, বিভিন্ন ফরম ও প্যাকেট মুদ্রণ, ইউএনডিপির এসইএমবি প্রকল্পের মাধ্যমে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, অমোচনীয় কালি-কলম, দেশি মালামালের মধ্যে রয়েছে স্ট্যাম্প প্যাড, মার্কিং সিল, ব্রাশ সিল, অফিসিয়াল সিল, গালা ক্রয় ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দ্রুত সম্পন্নের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমদের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসি তাদের রোডম্যাপ বাস্তবায়নে নানা আইনি এবং রাজনৈতিক জটিলতা নিরসনের জন্য অসম্পন্ন কাজগুলো সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইসির কর্মকান্ড সন্দেহজনক। তারা যেসব প্রস্তাব করেছে তা বাস্তবায়ন হলে প্রার্থীরা আচরণবিধি লঙ্ঘনে উৎসাহী করে তুলবে। নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করার ইসির প্রস্তাব সরকারের আজ্ঞাবহ মানসিকতার পরিচায়ক।

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড: এটিএম শামসুল হুদা বলেছেন, অনেক কষ্টে অর্জিত ক্ষমতা বিষর্জন দেয়ার ঘটনা নজীরবিহীন। পৃথিবীর কোথাও এধরণের ঘটনা দেখা যায় না। ইসি সরকারের ইচ্ছার বাইরে যাচ্ছে না।

২০১১ সালে আদালতের দোহাই দিয়ে সংসদে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলোপ করা হয়। নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান রেখেই নির্বাচন করার পথে অগ্রসর হচ্ছে। বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করার পথে হাঁটতে সরকার। আর বিরোধী দল নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধিনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থায় দেশের সুশীল সমাজ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্টজন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন এমন সব সংস্থা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে সরকারের তল্পিবাহকের ভূমিকা ছেড়ে বাস্তবধর্মী হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। অথচ কাজী রকিব উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের ভূমিকায় নির্বাচন কমিশনকে অবতীর্ণ করেছে।

একজন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বললেন, বৃটিশরা ভারতবর্ষ শোষণের জন্য এদেশীয় কিছু তল্পিবাহক সৃষ্টি করেছিল। ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীরা কিছু নিজস্ব দালাল তৈরি করে তাদের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করেছে। বৃটিশ আর পাকিস্তানীদের ওই সব এদেশীয় দালালের কাজ ছিল তোয়াজ করা আর হুজুরদের খুশি করা। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও সেরকম সরকারকে খুশি করতে সর্বচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যোগ্য ব্যক্তিকে ইসিতে না বসানোয় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যারা ইসিতে রয়েছেন সাংবিধানিক পদ হওয়ায় ইচ্ছা করলেই সরকার তাদের বাদ দিতে পারবে না। কিন্তু ইসিতে যারা রয়েছেন তারা বুঝে হোক না বুঝে হোক সরকারকে খুশি করতে ব্যস্ত। সরকার নিয়োগ দিয়েছে বলেই সরকার কিসে খুশি হয় সে চিন্তা মাথায় রেখে এধরণের আত্মঘাতী পথে অগ্রসর হচ্ছে ইসি।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ইচ্ছাপূরণের জন্য প্রায় অর্ধশত পৌরসভায় নির্বাচন দিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন। কয়েকটি পৌরসভার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রশ্ন হলো নির্বাচন কমিশন কি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধিনস্ত কোনো প্রতিষ্ঠান? এক নির্বাচন পর্যবেক্ষকের মতে বর্তমান সিইসি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ইসিকে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। সরকার কিসে খুশি হয় সেটা করতে ইসি ব্যস্ত। যার জন্যই এই ইসিকে অযোগ্য হিসেবে অবিহিত করে মহাজোটের শরীক সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ বলেছেন, এ ইসি বিতর্কিত, অযোগ্য। এদের দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদ সম্প্রতি এক টকশোতে বলেছেন, যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য যায়গায় না বসানোর কারণে সমস্যার সৃষ্টি হয়। অযোগ্য ব্যক্তিকে স্বাধীনতা দিলেও তিনি তার ব্যবহার করতে পারেন না।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ইসি নিরপেক্ষ নয়। তারা সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।

গতকাল নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজ বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যই শেষ কথা নয়। কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, নির্বাচনকালীন কী ধরনের সরকার থাকবে সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এখনো স্পষ্ট ধারণা পায়নি। রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপরই নির্ভর করবে কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। এখন আমরা নির্বাচনের স্বাভাবিক প্রস্তুতির কাজ করছি। যদি সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হয় তাহলে আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করবো।

সম্প্রতি এক টকশোতে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক দুঃখ করে বলেন, ভারতের সেশনের মতো ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন সিইসি হলে অনেক সংকট কেটে যেত। কিন্তু যে কমিশন নিজের ক্ষমতা হ্রাস করতে চায় তাদের নিয়ে কাছে প্রত্যাশাই বা কি করতে পারি?

আরও পড়ুন

সর্বশেষ