শনিবার, মে ২৫, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়সরকারের শত শত কোটি টাকা বকেয়া: আইজিডব্লিউ’র বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে বিটিআরসি

সরকারের শত শত কোটি টাকা বকেয়া: আইজিডব্লিউ’র বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে বিটিআরসি

স্টাফরিপোর্টার🙁বিডিসময়২৪ডটকম)

শত শত কোটি রাজস্ব বাকি থাকায় ও সরকারের নিয়মনীতি না মানায় আইজিডাব্লিউগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এর মধ্যে  টেলেক্স লিমিটেডের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে । এছাড়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত বাকি অন্তত বিশটি কোম্পানির কল এক মিলিয়নে সীমিত করে দেয়া হয়েছে বলে সূত্র বিডিসময় টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছে।

বিটআরসির মহাপরিচালক (স্পেকটাম ম্যানেজমেন্ট) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডিসময় টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। কিন্তু এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি।

বিটিআরসি সূত্র জানায়, গেটওয়ে অপারেটরস আইজিডব্লিউর কাছে বাংলাদেশ টেলিকম নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসির পাওনা ৯৪৭ কোটি টাকা। পাওনা টাকা ফেরত দেয়ার শর্তে আইজিডব্লির ৬ অপারেটরকে ৫০০ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করতে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেধে দেয় বিটিআরসি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় টেলেক্সের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। আর প্রায় ২০টি অপারেটরকে এক মিলিয়নের বেশি কল না নামানোর নির্দেশ দেয়া হয়।

বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমান ২৯টি আইজিডব্লিউ রয়েছে। এরমধ্যে ভিশন, ওয়ান এশিয়া অ্যালিয়েন্স, ডিবিএল, সেল টেল, বাংলা টেল, বিজি টেল, নোভটেল, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে, ডিজিকন, প্লাটিনাম,ফাস্টকম, মস ফাইভ গ্লোবাল ভয়েস, রুটস, সিগমা ইঞ্জিনিয়ারস, এইচআরসি টেকনোলোজিস ও রাতুলসহ প্রায় ২০ আইজিডাব্লিউ এর কাছে সরকারের বকেয়া পড়ে আছে কয়েকশ কোটি টাকা। ফাস্ট কমিউনিকেশনস লিমিটেডের কাছে বিটিআরসি’র পাওনা ছিল প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবশ্য কিছু টাকা তারা পরিশোধ করেছেন। টেলেক্স লিমিটেডের কাছেও বিটিআরসির পাওনা ৬২ কোটি টাকা। এর মালিক আবদুর রহমান বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার আত্বীয়-স্বজনের দুই ছেলে এবং ছেলে বউদের নামে নেয়া হয়েছে ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স এর গেটওয়ের লাইসেন্স। ভিশন টেল লিমিটেডের সঙ্গে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের মেয়ের সম্পর্ক আছে। রাতুল টেলিকম লিমিটেডের সঙ্গে এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের মেয়ের মালিকানা রয়েছে। মস ফাইভের সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হকের ছেলে জিয়াউল হকের সম্পর্ক রয়েছে।

বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা জানান, গত ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে সব প্রতিষ্ঠানের জুন পর্যন্ত পাওনা পরিশোধ করার কথা ছিল। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানই জুন পর্যন্ত পাওনা পরিশোধ করেনি। অর্ধেক প্রতিষ্ঠান মার্চ পর্যন্ত পাওনা পরিশোধ করেছে। আর ৫-৬টি প্রতিষ্ঠান এ বছর কোনো টাকাই দেয়নি। বিটিআরসির হিসেব বলছে, ডিসেম্বরের শেষে তাদের পাওনা পরিমাণ ছিল ৩৭৭ কোটি টাকা। মার্চের শেষে এটি বেড়ে যায় ৫৩৩ কোটিতে। আর জুনের শেষে তা দাঁড়ায় ৯৪৭ কোটিতে। আর গেল জুলাই মাসের পাওনা ধরলে ১১শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তবে এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কিছু টাকা পরিশোধ করেছে। তারপরও বিটিআরসির পাওনা হাজার কোটি টাকার কম হবে না।

 বিটিআরসি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে দেশের বাইরে কল করার চার্জ মিনিট প্রতি দশমিক শূন্য ৩ ডলার বা আড়াই টাকা। আইজিডব্লিউয়ের মাধ্যমেই এ আন্তর্জাতিক কলগুলো করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা বিটিআরসিকে এর ৫১ দশমিক ৭৫ শতাংশ অর্থ প্রদানের শর্ত থাকলেও, তা একেবারেই মানা হচ্ছে না। কারণ হিসেবে জানা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন গেটওয়ে অপারেটরসের (আইজিডব্লিউ) লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের বেশির ভাগেরই উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সংযোগ রয়েছে। আর তার বলি হচ্ছে দেশের টেলিকম খাত।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগে যখন ৪টি লাইসেন্স ছিল তখন যে কল এসেছিল এখন ২৯টি লাইসেন্স দেয়ার পরও কল বাড়েনি। ফলে বাড়েনি সরকারের কোন রাজস্বও। এক হিসেবে দেখা গেছে, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে যখন ৪টি লাইসেন্স ছিল তখন কল এসেছে ১৩৫ কোটি মিনিট। ২০১২ সালে এই সময় এর পরিমাণ ছিল ১৪৩ কোটি মিনিট। তখনও লাইসেন্স ছিল ৪টি। আর ২৯টি লাইসেন্স দেয়ার পর এবার জানুয়ারিতে কল এসেছে ১৩২ কোটি মিনিট। একইভাবে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কল এসেছে ১২২ কোটি মিনিট। ২০১২ সালের জুলাই মাসে ১২৪ কোটি মিনিট। আর ২৯টি লাইসেন্স দেয়ার পর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসেছে ১২৫ কোটি মিনিট। গত মার্চে কল এসেছে ১৩১ কোটি মিনিট। আর ৪টি লাইসেন্সের সময় গত বছরের মার্চে এসেছিল ১২৪ কোটি মিনিট। আর ২০১১ সালের মার্চে এসেছিল ১৩২ কোটি মিনিট।

জানা গেছে, আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের মধ্যে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে আইজিডব্লিউ প্রথম যাত্রা শুরু করে। সে সময় নিলাম আহ্বানের মাধ্যমে মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আরও ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়। আর এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগ মালিকানায় রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিত্বরা।

বিটিআরসি সূত্রে বলা হচ্ছে, বড় এ বকেয়া প্রতি ৩ মাসে দ্বিগুণ হচ্ছে। বিটিআরসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানগুলোর অপরিশোধিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৭৭ কোটি টাকা। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যাংক থেকে জামানতের সাড়ে ৭ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছিল। এ বছরের মার্চের অপরিশোধিত বিলের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫শ’ ৩৩ কোটিতে। শেষ অর্থবছরে গত জুন মাসে বকেয়া অর্থের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে ৯শ’ ৪৭ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বার্ষিক লাইসেন্স ফির সাড়ে ৭ কোটি টাকাও দিতে অপারগতা জানায়। কর্মকর্তারা বলছেন, বহু আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে বকেয়া পরিশোধের ন্যূনতম ইচ্ছাও প্রকাশ করছে না। যার অর্থ লাগামহীন এ বকেয়া বাড়বে আরও বহুগুণ। পুরোনো আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন মালিক অভিযোগ এনেছেন, নতুন অপারেটররা সরকার নির্ধারিত প্রতি মিনিটে দশমিক শূন্য ৩ ডলার বা আড়াই টাকা রেটও বজায় রাখছে না। তারা আরও কম কলরেট রাখছে যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে জাতীয় রাজস্বতে। ব্যবসাটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও তাদের ছত্রছায়ায় থাকা ব্যক্তিদের হাতে চলে যাওয়ায় প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। অনেকে তাদের কার্যক্রম সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধও করে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ