রবিবার, মে ২৬, ২০২৪
প্রচ্ছদচট্রগ্রাম প্রতিদিনআল্লামা শফীপুত্র আনাসের সম্পদ হঠাৎ বেড়ে গেছে

আল্লামা শফীপুত্র আনাসের সম্পদ হঠাৎ বেড়ে গেছে

চট্টগ্রাম অফিস (বিডি সময় ২৪ ডটকম)

হঠাৎ করে  বেড়েছে হেফাজতে ইসলামী প্রচার সম্পাদক আনাস মাদানী ও তাঁর সহযোগীদের সম্পদ। প্রচার সম্পাদক হলেও তিনি কখনো প্রকাশ্যে আসেন নি। আনাস হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ছেলে। তিনিও হাটহাজারী দারুল উলুম মইনুল ইসলাম, মাদ্রাসার  শিক্ষক। আনাস মাদানী ও তাঁর সহযোগীরা ইতিমধ্যে হাটহাজারী ঈদগাহ মাঠের দক্ষিণ পাশে প্রায় ২০ কাঠা জায়গায় পাঁচটি বাড়ির নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন। সেখানে প্রতি কাঠা জমির মূল্য প্রায় ৪০ লাখ টাকা। বাড়িগুলোর নির্মাণ কাজ তৃতীয় তলা পর্যন্ত শেষ হয়েছে। তবে আনাস মাদানী বলেছেন, পাঁচটি নয় একটি নির্মাণ করছেন তিনি। বাকীগুলোর মালিক তিনি নন। বাবা শাহ আহমদ শফীকে শিষ্যদের দেয়া টাকায় এ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, হাটহাজারী সদরের ঈদগাহ মাঠের দক্ষিণ পাশে পাশপাশি তৈরি হচ্ছে পাঁচটি ভবন। সেখানে কর্মরত নির্মাণ শ্রমিকরা বলেন, বাড়িগুলো ছয়তলা পর্যন্ত তোলার কথা রয়েছে। এসব বাড়ির নির্মাণ কাজ দেখাশোনা করছেন আনাস মাদানীর বন্ধু আহসান উল্লাহ। তাঁর কাছ থেকেই জমিগুলো কেনা হয়েছে। মাঝে মাঝে আনাস মাদানীও নির্মাণ কাজ দেখতে আসেন। একজন নির্মাণ শ্রমিক বলেন, গত ছয়-সাত মাস আগে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। হুজুর (আনাস) সবসময় আসতে পারেন না। মাঝে মাঝে আসেন। তবে তাঁর পক্ষে আহসান উল্লাহ হুজুর এসব দেখাশোনা করেন।

হাটহাজারীর এসব ভবন ছাড়াও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা লিচু তলায় এগারো শতক জমির উপর রয়েছে চারতলা সুপরিসর ভবন। একবছর আগেও ভবনটি ছিল একতলা। হেফাজতের আন্দোলনের পর এ ভবনটিও চারতলা পর্যন্ত উঠে যায়। বর্তমানে এটির পাঁচতলার নির্মাণ কাজ চলছে। মাদানি মঞ্জিল নামে এ ভবনটি জামায়াতপন্থী লোকজনের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। ভবনটিতে বর্তমানে একটি প্রাইভেট হাসপাতালের কার্যক্রম চলছে। রাঙ্গুনীয়ার শিলক গ্রামে হেফাজত আমীর শাহ আহমদ শফীর বাড়ি। সেখানে বাড়ির পাশে একটি পারিবারিক মাদ্রাসা রয়েছে। রয়েছে বেশ কিছু ফসলি জমি। বাড়ি ও মাদ্রাসা দুইটিই দ্বিতল পাকা ভবন।

জানা যায়, হেফাজতে ইসলামের নামে দেশব্যাপী বড় পরিসরে আন্দোলন হলেও এর মূল কর্তৃত্ব রয়ে যায় কেবলমাত্র শাহ আহমদ শফী ও তাঁর পুত্র আনাস মাদানীর হাতে। শাপলা চত্বরের সমাবেশে বাবার পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করে আলোচনার কেন্দ্রে আসেন আনাস। হেফাজতের দায়িত্বশীল একজন নেতা জানান, ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর শাহ আহমদ শফি অনেকটা মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এসময় তিনি বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পুত্র আনাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে হেফাজতের মূল আর্থিক বিষয়টিও হেফাজত আমীরের ছেলে আনাস মাদানীর হাতেই থেকে যায়। আনাসের পরামর্শেই শাপলা চত্বরের ঘটনার প্রতিবাদে ডাকা গত বছরের ৭ মে’র হরতাল প্রত্যাহার করা হয়।

এ ছাড়া সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতাদের নামে একদিকে মামলা, তাঁদের ওপর সরকারি বিভিন্ন সংস্থার চাপ ও সার্বক্ষণিক নজরদারি, আবার দলের আমীর ও তাঁর সন্তানের  সঙ্গে সরকারের  যোগাযোগ সব মিলিয়ে হেফাজতের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে। কয়দিন পর পর সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাটহাজারী মাদ্রাসায় হেফাজত আমীর ও তার পুত্রের সাথে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে  হেফাজতের শীর্ষ কোন নেতাকেও থাকতে দেয়া হয় না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১১ ও ১২ এপ্রিল লালদিঘির মাঠে হেফাজতের রেসালত সম্মেলনের আগের দিন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হেফাজত আমীর শাহ আহমদ শফী ও তাঁর পুত্র আনাস মাদানীর সাথে প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক করেন। গত ১৭ মার্চ সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাটহাজারী মাদ্রাসায় গিয়ে বৈঠক করেছেন। গত ২২ এপ্রিল (মঙ্গলবার) চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিনও শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে দেখা করেছেন। এসব বৈঠকে  হেফাজত আমীর ও তাঁর পুত্র আনাস মাদানী ছাড়া  দলের অন্য কোনও নেতা উপস্থিত ছিলেন না। এমনকি হেফাজতের মহাসচিবও নয়। এ নিয়ে সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা  ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এ অবস্থায়  হেফাজতের পক্ষে আগের মতো বড় ধরনের কর্মসূচি পালন বা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির মতো পরিস্থিতি তৈরির সক্ষমতা নিয়ে সংগঠনের নেতারা নিজেরাই সন্দিহান। ‘শানে রেসালত’ নামে যে কর্মসূচি  দেওয়া হচ্ছে, তা কেবল সংগঠনের কর্মী-সমর্থক গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন স্থান  থেকে পাওয়া আর্থিক সহায়তার উৎসগুলো ধরে রাখার  চেষ্টার অংশ বলে মনে করছেন  হেফাজতের  কোনো  কোনো নেতা।

হেফাজতের দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দশম সংসদ নির্বাচনের কয়েকদিন আগে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা বিরোধীদল ও সরকারের পক্ষ থেকে বড় অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে কয়েক মাসে দফায় দফায় কর্মসূচি  ঘোষণা করেও তা স্থগিত করায় এবং সংগঠনের আমীরের  ছোট  ছেলে আনাস মাদানীর সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন মহলের নিয়মিত  যোগাযোগ থাকার কথা জানাজানি হওয়ার পর আর্থিক সুবিধা গ্রহণ-সংক্রান্ত অভিযোগ বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন  নেতারা।

অভিযোগ রয়েছে, ২৯ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ (মার্চ ফর ডেমেক্রেসি) কর্মসূচিতে সমর্থন  পেতে  আর সমর্থন ঠেকাতে সরকার ও বিরোধীদলের সাথে বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন ঘটেছে হেফাজতের। হেফাজতের ভেতরেই প্রচার পায়  যে সংগঠনটিকে বেশ কয়েক কোটি টাকার অনুদান দেওয়া হয়েছে। এরপর গত ২৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিবের হাটহাজারী মাদ্রাসায় যাওয়া এবং  হেফাজত আমীর ও তাঁর  ছেলের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করার পর আনাছ মাদানীর বিষয়ে সন্দেহের ডালপালা মেলতে থাকে। এর পর  থেকে  নেতাদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব ও ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়। এ অবস্থায় বিরোধী দলের ২৯ ডিসেম্বরের কর্মসূচিতে সমর্থন না জানিয়ে ‘দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে’ যার যার অবস্থান  থেকে ভূমিকা পালনের জন্য  হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী ২৮ ডিসেম্বর গণমাধ্যমে একটি  খোলা চিঠি পাঠান। তবে তাতে ‘যার যার অবস্থান  থেকে ভূমিকা’ কীভাবে পালন করা হবে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, শাপলা চত্বরে আহত ও নিহতদের সাহায্যের জন্য দেশ ও দেশের বাইরে থেকে লোকজহন বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন। ওমরাহ করতে গিয়ে পেয়েছেন ৭১ লাখ টাকা। এছাড়া শাপলা চত্বরের সমাবেশের দুইদিন আগে লালবাগ মাদ্রাসায় অবস্থানকালে লোকজন লাইন ধরে টাকা দিয়েছেন হেফাজত আমীরকে। সেই সময়ও প্রায় দুই বস্তা টাকা পাওয়া গেছে। অথচ এসব অর্থের কোন হিসেব  নেই। হতাহতদের দেয়া হয়নি কিছুই।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, হুজুর (শাহ আহমদ শফী) প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার ভক্তদের কাছ থেকে  যে পরিমাণ অর্থ  উপহার পেয়ে থাকেন তা দিয়ে ভবন তৈরি করা কোন ব্যাপার নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হুজুরের শিষ্যরা অনেক অর্থ দিয়ে থাকেন।  তবে আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে যেভাবে বলা হচ্ছে তা কিন্তু সঠিক নয়।

মার্চ ফর ডেমোক্রেসিতে অংশ নিতে টাকা নেয়া প্রসঙ্গে ইসলামবাদী বলেন, ১৯ দলের জোটভুক্ত কয়েকটি ইসলামী দল রয়েছে যারা হেফাজতের সাথেও রয়েছে। ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসিতে’ হেফাজত অংশ নেবে এ ধরনের কথা বলে এসব ইসলামী দলের কোন নেতা কারো সাথে আর্থিক  লেনদেন করে থাকলে তা ভিন্ন বিষয়। হেফাজত নেতাদের কারো সাথে এ ধরনের আলাপ হয়নি। হেফাজতকে টাকা দিয়েছে একথা কেউ প্রকাশ্যে বলতে পারবে না।

যোগাযোগ করা হলে হেফাজতের প্রচার সম্পাদক আনাস মাদানী বাড়ি নির্মাণ করার কথা স্বীকার করে বলেন, ঈদগাহ মাঠের পাশে সব বাড়ি আমার নয়। আমার বাবাকে মানুষ অনেক ভালোবাসেন। তাঁর অনেক মুরিদ ও ছাত্র রয়েছেন। তারা বাবাকে অনেক টাকা পয়সা দেন। ওই টাকা থেকে একটি বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। অন্য বাড়িগুলোর মালিক আহসান উল্লাহ, জসিম উদ্দিন, ফরিদ ও নেজাম উদ্দিন। তিনি বলেন, আমার বাবার তো বাড়ি থাকতেই পারে। এদেশে কতো ভন্ডপীরেরও একাধিক বাড়ি গাড়ি আছে।

তবে যে চারজনের কথা আনাস মাদানী বলেছেন তারা সবাই আনাস মাদানীর সিন্ডিকেটের লোকজন বলে জানা গেছে। এদের প্রধান হলেন আহসান উল্লাহ। বিগত উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হন তিনি। কিন্তু  শেষ পর্যন্ত আনাস মাদানীর নির্দেশে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। আনাস মাদানী দাবি করেন, আমি কোনও টাকা পয়সা কারও কাছ থেকে নিইনি। হেফাজতের আন্দোলনের জন্য যারা টাকা দিয়েছেন, তারা সবাই বাবার হাতে দিয়েছেন। বাংলাদেশের বাইরে লন্ডন আমেরিকাতেও আমার বাবার মুরিদ ও ছাত্র আছেন। তারা আমার বাবাকে টাকা পয়সা দেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ