রবিবার, মে ১৯, ২০২৪
প্রচ্ছদআরো খবর......সরকারি বা বিরোধী দলের অন্তঃকোন্দল : পাবলিকর কী দোষ! ।। ভাঙ্ গাড়ি...

সরকারি বা বিরোধী দলের অন্তঃকোন্দল : পাবলিকর কী দোষ! ।। ভাঙ্ গাড়ি ।। যত ক্ষোভ গাড়ির ওপর

 চট্টগ্রাম অফিস (বিডি সময় ২৪ ডটকম)

সরকারি দল বা বিরোধী দল, পদচ্যুত কিংবা পদবঞ্চিত একটা বিষয়ে তাদের সকলেই একাট্টা। ক্ষোভে বিক্ষোভে, আন্দোলন সংগ্রামে তাদের সকলের এক ও অভিন্ন টার্গেট রাজপথের যানবাহন। যত ক্ষোভ সব গাড়ির উপর। আন্দোলন চলুক, কিংবা হরতাল, দাবি আদায়ে ক্ষোভের যতো বহিঃপ্রকাশ দেখানোর মাধ্যম যেন এই একটিই; গাড়ি। হয় ভাঙো, নয়তো জ্বালাও। সিএনজি অটোরিক্সা, পিকআপ ভ্যান, বাস কিংবা ট্রাক, মোটর সাইকেল থেকে প্রাইভেট কার, রাজপথে নামলেই আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পড়ে তার বারোটা বাজছে। মানবতা বিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর থেকে গত ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত আট মাসে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনকারীদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে সহস্রাধিক যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে ১৮টি বাস। এছাড়াও আছে প্রাইভেট গাড়ি। সর্বশেষ গত ৩০ অক্টোবর ছাত্রলীগ নগর শাখার নতুন কমিটিতে পদ না পেয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগের কর্মীরা এলোপাতারি যানবাহনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। আশঙ্কার বিষয় হলো যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হয়েছে বিভিন্ন স্থানে ট্রেনে আগুন দেয়ার ঘটনা।

বিরোধী দলের ডাকা হরতালের আগের রাতে গাড়ি পোড়ানো এখন একটি ‘রেওয়াজে’ পরিণত হয়েছে। ধ্বংসাত্মক এসব ঘটনায় কোটি কোটি টাকা ক্ষতির পাশাপাশি জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর ফলে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেক পরিবহন ব্যবসায়ী। ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকদেরও লোকসান গুণতে হচ্ছে। আন্দোলনের নামে গাড়ি পোড়ানো ও ভাঙচুরের ‘উৎসবে’ মেতে ওঠার এই অপসংস্কৃতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলে, তাদের ক্ষতি করে এভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন একটি গণতান্ত্রিক দেশে কখনোই কাম্য হতে পারে না। হরতালকে কেন্দ্র করে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়ার অপকৌশল শত চেষ্টা করেও ফেরানো যাচ্ছে না। পিকেটারদের নাশকতা ঠেকাতে ইতোপূর্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও কমেনি এই প্রবণতা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন পূর্বাঞ্চল কমিটির সভাপতি মৃণাল চৌধুরী বলেন, চলতি বছর বিরোধী দলতো আছেই, ছাত্র ধর্মঘট, শ্রমিক ধর্মঘট, যাই হোক না কেন আন্দোলনকারীদের প্রথম লক্ষ্য থাকে রাস্তায় নেমে গাড়ি পোড়ানো, গাড়ি ভাঙচুর করা। মানুষ কতোটা অমানবিক হলে, দেখা যায়, পরিশ্রান্ত চালক বাসে ঘুমিয়ে আছে, তাকে সহ পুরো বাস জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মরণাপন্ন রোগীকে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্স ছুটছে, রোগী নামিয়ে দিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে আগুন দিচ্ছে। এ ধরনের আন্দোলনের চাপে সারা দেশে এ পর্যন্ত আমাদের ১৭ জন পরিবহন শ্রমিক মারা গেছে। তার মধ্যে চট্টগ্রামে মারা গেছে দুইজন। তিনি বলেন, হরতালের আগের দিন সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করতে হরতালকারীরা একের পর এক গাড়ি ভাঙচুর করে। আবার গাড়ি না চালিয়ে রাস্তার পাশে রেখে দেয়া যানবাহনেও তারা আগুন দেয় হরতালের দিন। তিনি বলেন, ঈদুল আযহার কয়েক দিন আগে দেখা গেছে ক্লোজ ডোর নন স্টপ একটি চেয়ার কোচকে জোর পূর্বক থামাতে গিয়ে সীতাকুণ্ডে এক ছাত্র মারা যায়। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা সেদিন ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে শতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করে, পাঁচটি চেয়ারকোচ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে। এই নিয়ে আমরা ধর্মঘট ডাকলে পুলিশ প্রশাসন আইনি সহায়তার আশ্বাস দিলে ধমর্ঘটের সময় আমরা কমিয়ে আনি। তিনি বলেন, লাগাতার পরিবহন ধর্মঘট দেয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে। কিন্তু তিনদিন হরতালের পর আমরা যদি এখন আরো তিনদিন লাগাতার ধর্মঘট ডাকি, তার বলী হবে জনগণ। এটাতো রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে। তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা গেলে এ প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েকটি হরতালে অন্তত অর্ধশত গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করা হয় চট্টগ্রামে। প্রতি হরতালেই এই নাশকতা ঘটলেও এর দায় নিতে কেউই রাজি নন। হরতাল ‘সফল করতে’ পরিকল্পিতভাবে এই নাশকতা ঘটানো হচ্ছে বলে সরকারসহ সাধারণ মানুষ অভিযোগ করলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করছে। বিরোধী দল পাল্টা অভিযোগ করে বলছে সরকারি দলই গাড়িতে আগুন দিয়ে বিরোধী দলকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে! শুধু হরতালই নয়, গত ৩০ অক্টোবর ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা নগরীর বিভিন্ন স্থানে শতাধিক যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। ঠিক একই স্টাইলে কয়েক মাস আগে তাণ্ডব চালিয়েছিল নগর ছাত্রদলের পদবঞ্চিত নেতা কর্মীরা।

আন্দোলনের নামে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় রীতিমতো আতংকিত গাড়ির চালক মালিক, এমনকি যাত্রী সাধারণও। এর ফলে হরতালের আগের দিন থেকেই রাস্তায় গাড়ি চলাচল একেবারেই কমে যায়। যার প্রভাব পড়ে সাধারণ জনগণের উপর। গত তিনদিনের হরতালে নগরজুড়ে যাত্রী পরিবহনের চলাচল ছিল খুবই কম। ফলে গভীর রাত পর্যন্ত কর্মজীবী মানুষকে ঘরে ফিরতে হয়েছে পায়ে হেঁটে। এরকম হাজার হাজার মানুষ সন্ধ্যার পর পরিবহনের অভাবে পায়ে হেঁটে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে ফেরেন। গত ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যা ছয়টায় আগ্রাবাদ বাদামতলীর মোড়ে অফিস থেকে বাসায় ফেরার জন্য পরিবহনের অপেক্ষায় থাকা ব্যাংক কর্মচারী মোহসিন ও রাশেদের সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। মোহসিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আন্দোলন গরিবু ভালা কতা। চেয়ারত্‌ যেই বইবু বইয়ুক, মরেয্যে পাবলিক।” তিনি কথাটি শেষ করতে না করতেই লাকি প্লাজার সামনে ককটেল বিস্ফোরিত হয়। যে যেদিকে পারছে, ছুটছে তখন।

স্কুলের নিরাপত্তা প্রহরী দুলাল দারুণ ক্ষুব্ধ দুই দলের উপর। এতদিন হরতালত গাড়িত অইন দে’র, গাড়ি ভাঙের বুলি জামাত বিএনপির পোয়া ছা’রে গাইল দি। এহন গতকাইল (৩০ অক্টোবর) ত ছাত্রলীগর পোয়া ছা ভাইঙ্গি, জ্বালাইয়ি। তারারে কী কইয়ূম?

কর্মজীবীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, হরতালে বাস জ্বালিয়ে দেয়ার আতঙ্কে বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানি পুরোনো লক্করঝক্কর মার্কা বাস রাস্তায় নামিয়েছেন। তাই হরতাল ঘোষণা দিতেই পরিবহন সংকট বেড়ে যায়। নতুন বাসগুলো হরতালের আগের দিন দুপুরের পর নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। হরতালে আতঙ্ক ছড়াতে পিকেটারদের নতুন কৌশল ‘বাস জ্বালানো’ শুরু হওয়ার পরই বাস মালিকরা রাস্তায় নামান এইসব লক্কর ঝক্কর বাস। এতে দেখা দেয় যানবাহন স্বল্পতা। একইভাবে প্রাইভেট গাড়িগুলোও সন্ধ্যার পর সচরাচর বের করেন না গাড়ির মালিক।

ভাঙচুর কিংবা অগ্নিসংযোগের আতঙ্কে যানবাহন চলাচল কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাগণ। সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (যানবাহন) এস এম তানভীর আরাফাত চৌধুরী এ প্রসঙ্গে  বলেন, গাড়ি ভাঙচুর কিংবা অগ্নিসংযোগ ঠেকাতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। আসামিও ধরা পড়ছে। তবু কিছু কিছু জায়গায় ঘটছে। নাশকতা সৃষ্টিকারীদের প্রতিরোধে তিনি স্থানীয় জনতাকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।

একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) মো: ইলতুৎমিশ  বলেন, আন্দোলনের নামে গাড়ি ভাঙচুর, আগুন দেয়ার ঘটনা আমরা কঠোর হস্তে দমন করছি। জড়িতদের গ্রেফতার করছি। কিন্তু হামলার ঘটনাটি আকস্মিকভাবেই ঘটে যায়। তাই অনেক সময় আমরা আগে জানার সুযোগ পাইনা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ