বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান শাহেদ করিম ওরফে মো. শাহেদের উত্তান যেভাবে

রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান শাহেদ করিম ওরফে মো. শাহেদের উত্তান যেভাবে

আলোচিত রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান শাহেদ করিম ওরফে মো.শাহেদ টকশো, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ভাঙানো আর হাসপাতাল ব্যবসা করেই ওপরে উঠে আসেন। বিভিন্ন স্থানে সুবিধাজনক পরিচয় দিতেন শাহেদ করিম।
কখনো তিনি নিজেকে আমলা, সামরিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী-নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিয়েছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে।প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে তোলা ছবি ব্যবহার করে তিনি নিজেকেও প্রভাবশালী বলে তুলে ধরতেন।

 র‍্যাবের গণমাধ্যম ও আইন শাখার পরিচালক কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেছেন, ‘তার প্রতারণার ধরণ একটি অনন্য ধরণ। তাকে বলা যায় প্রতারক জগতের ‘আইডল’।

র‍্যাব কর্মকর্তা মি. কাশেম বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. শাহেদ বহু মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ‘প্রতারণাই ছিল তার প্রধান ব্যবসা,’ বলেন ঐ র‍্যাব কর্মকর্তা।
র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, আমরা শুরুতে ভুয়া টেস্টের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করেছি। কিন্তু এখন দিন যতই যাচ্ছে দেখছি অসংখ্য জঘন্য অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল শাহেদ। যাদের সঙ্গে তার ব্যবসা ছিল, তাদের সঙ্গেই প্রতারণা করেছে। একাধিক ব্যবসা শুরু করেছিলেন শাহেদ করিম। তবে সবচেয়ে রমরমা ছিল তার হাসপাতাল ব্যবসা।
২০০৭ সালে রিজেন্ট হাসপাতালের অনুমোদন নেন মো. শাহেদ। তবে তখন সেটি হাসপাতাল নয়, এটি ক্লিনিক ছিল। পরবর্তীতে হাসপাতাল হিসেবে কার্যক্রম শুরুর পর উত্তরার পাশাপাশি মিরপুরেও শাখা খোলা হয়।
করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় প্রথম বেসরকারি হাসপাতাল হিসেবে রিজেন্ট হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর এই হাসপাতালটি বিশেষ পরিচিতি পায়। পরবর্তীকালে র‍্যাবের অভিযানে জানা যায় যে, ২০১৪ সালের পর থেকে হাসপাতালের অনুমোদন নেই। করোনা পরীক্ষার নামে প্রতারণা ও ভুয়া প্রতিবেদন দেয়ার মতো অপরাধের তথ্য বেরিয়ে আসে।
এই হাসপাতালের চিকিৎসা সুবিধা দেয়ার নাম করে তিনি অনেক মন্ত্রী-প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে খাতির জমিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও জানিয়েছেন, হাসপাতালের কথা জানার পর তিনিও শাহেদকে বলেছিলেন যে রোগী পাঠাবেন। বেশ কয়েকজনকে পাঠিয়েছিলেনও।
কর্মজীবনের শুরু থেকেই প্রতারণা : 
২০০৯ সালের দিকে মো. শাহেদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মালামাল সরবরাহের ঠিকাদারি করতেও শুরু করেন। রাইজিং শিপিং এন্ড ট্রেডিং কোম্পানি ও রাইজিং রিয়েল এস্টেট নামে সেই সময় তিনি দুইটা প্রতিষ্ঠান চালাতেন। এসি সরবরাহে প্রতারণার মামলায় ২০০৯ সালে প্রথম গ্রেফতার হয়েছিলেন মো. শাহেদ।
খুলনার একটি টেক্সটাইল মিলে এসি সরবরাহের করে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে তিনি চেক দিলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। সেই মামলায় তাকে কয়েকমাস কারাগারে থাকতে হয়।
মো. শাহেদ ২০০৯ সালে তিনি ডিবিএস নামের একটি কুরিয়ার সার্ভিস চালু করেন। সেখানে চাকরি করা সাতক্ষীরার কাজী সালাহউদ্দিন দেশের প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিকে বলেছেন, তাকে ওই প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এক টাকাও বেতন না দেয়ায় দুই বছর পরে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তার কাছ থেকে ২৯ লাখ টাকার আসবাবপত্র নিয়ে এক টাকাও পরিশোধ করেননি। এই কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি দেয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকে তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১০ সালে শাহেদ ধানমণ্ডি এলাকায় বিডিএস কিক ওয়ান ও কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি বহু ধাপের বিপণন কোম্পানি শুরু করেন। গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করে তিনি ভারতে পালিয়ে যান বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সেই সময় তিনি নিজেকে পরিচয় দিত সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলে। তখন তারা স্বপরিবারে ভারতের বারাসাতে কিছুদিন ছিলেন।
র‍্যাবের কর্মকর্তাদের মতে, এই ব্যবসা থেকে আত্মসাৎ করা অর্থ দিয়েই তিনি রিজেন্ট গ্রুপ চালু করেন। সেসব মামলায় জামিন হওয়ার পর তিনি দেশে এসে আবার ব্যবসা শুরু করেন।
তার আয়ের আরেকটি উৎস ছিল প্রতারণার মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা। মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ থেকে ছয় কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার বিষয়ে দুইটি মামলা আদালতে চলছে। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ধানমণ্ডি, উত্তরাসহ বিভিন্ন থানায় অন্তত ৩২টি মামলা আছে বলে র‍্যাব জানতে পেরেছে। তিনি মালামাল নিয়ে চেক দিলেও সেসব হিসাবে কোন টাকা থাকতো না।
প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে ছবি :
রিজেন্ট গ্রুপ চালু করার পর তিনি হাসপাতাল, আবাসন, হোটেল, কলেজসহ একাধিক ব্যবসা চালু করেন। সেই সঙ্গে ঠিকাদারি ব্যবসাও শুরু করেন। কিন্তু ঠিকাদারির জন্য মালামাল নিয়ে টাকা পরিশোধ না করা বা চেক দিলেও প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সেসব ঘটনায় ঢাকার অনেকগুলো থানায় মামলা ও জিডির খবর পাওয়ার তথ্য জানিয়েছেন র‍্যাবের কর্মকর্তারা।
তার ফেসবুক একাউন্টে নিজের পরিচয় দিয়েছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্য, ন্যাশনাল প্যারা অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট, রিজেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, রিজেন্ট কেসিএস লিমিটেড, কর্মমুখী কর্মসংস্থান লিমিটেড, রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেড ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান।
সেন্টার ফর পলিটিকাল রিসার্চ নামের একটি প্রতিষ্ঠানেরও তিনি চেয়ারম্যান। এই পরিচয়ে তিনি একাধিক টেলিভিশন টকশোতে এসেছেন।
সরকার প্রধান থেকে শুরু করে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মন্ত্রী, এমপি, সচিব, আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার ছবি রয়েছে।
র‍্যাবের পরিচালক সারওয়ার বিন কাশেম বলেছেন, দুষ্ট লোকেরা নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের হর্তা-কর্তা ব্যক্তিদের সাথে সে ছবি তুলেছে। এটা আসলে তার একটা মানসিক অসুস্থতা। এই ছবি তোলাকে কেন্দ্র করেই সে প্রতারণা করতো।
মো. শাহেদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে র‍্যাবের পরিচালক সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘প্রতারকদের কোন রাজনৈতিক পরিচয় নেই। তারা যখন যার নাম পারে তখন সেটা বেচে নিজের জীবনকে অগ্রগামী করার চেষ্টা করে। একটি পত্রিকার ডিক্লারেশনও নিয়েছিলেন তিনি, যার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে তার নাম রয়েছে।
রিজেন্ট গ্রুপের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, মো. শাহেদ আত্রাই নদ ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ করেছেন। কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপ ও কক্সবাজারের সাইক্লোন শেল্টার, প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনেও কাজ করেছেন।
নিজের পরিচিতি বাড়াতে টাকার বিনিময়ে টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে যেতে শুরু করেন মো. শাহেদ। আবার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেসব ছবি সামাজিক মাধ্যম, নিজের অফিস ও বাসায় টাঙিয়ে রাখতেন। এক সময় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে শাহেদের ছবি দেখা গেলেও, আওয়ামী লীগের একটি উপ-কমিটিরও সদস্য হয়েছিলেন মো. শাহেদ।
আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের আগেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শাহেদ করিমের কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। তবে ২০১৬ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য হন। তবে গত ডিসেম্বরে ২১তম সম্মেলনের পর নতুন উপ-কমিটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
পড়াশোনা :
সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন মো. শাহেদ। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি ঢাকায় চলে আসেন। তার একজন সহপাঠী জানিয়েছেন, শাহেদ কারো সঙ্গে খুব একটা মিশতেন না। তার মা তাকে নিয়ে আসতেন আবার নিয়ে যেতেন।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আজিজুর রহমান বলছেন, ঢাকার পিলখানার রাইফেলস স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করেছিলেন কিনা, সেটা কারো জানা নেই।
পারিবারিক জীবন :
মো. শাহেদের বাড়ি বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলায়। তার দাদা একরামুল করিম ভারত বিভাগের পর ভারতের বসিরহাট মহকুমা থেকে সাতক্ষীরায় এসে বাড়ি করেন।
মো. শাহেদের দাদার এক সময় সাতক্ষীরায় অনেক জমি-জায়গা ছিল। কামালনগরে তাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল।কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর তার বাবা-চাচারা সেসব জমি ও জায়গা বিক্রি করে দেন। নিজেদের বিলের জায়গায় ঘের তৈরি করে ব্যবসা করার চেষ্টা করেছিলেন তার পিতা। কিন্তু বেশিদিন সেই কাজ করেননি। এক সময় সাতক্ষীরা শহরে শাহেদদের নিজেদের বাড়ি থাকলেও সেটিও বিক্রি করে তারা ভাড়া থাকতে শুরু করেন।
সাতক্ষীরার আইনজীবী আবু বক্কর সিদ্দিক বলেছেন, নিজেদের সব জমি প্লট আকারে তারা বিক্রি করে দেন। আমিও তাদের কাছ থেকেই কিনেছি। ২০০৭ সাল থেকে তারা আমার বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। পরবর্তীতে এই বাড়িতেই তিনি ফ্ল্যাট কেনেন।
শাহেদের মা ২০১০ সালে মারা যান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তবে শাহেদ কখনো সাতক্ষীরার রাজনীতিতে জড়াননি। শাহেদের বাবা-চাচারা চার ভাই। জমি-জায়গা বিক্রির পর দুই ভাই ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি বাড়ি কেনেন। সেখানেই তার পিতা থাকতেন। তবে আবু বকর বলছেন, তার পিতার এই বাড়িতে ফ্ল্যাট থাকলেও শাহেদ কখনো সেখানে আসেননি।
তবে তিনি ২০০৫ সালে সাতক্ষীরায় একটি বিয়ে করেছিলেন বলে জানিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আজিজুর রহমান। কিন্তু তার আচরণে স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন অসন্তুষ্ট হওয়ায় একমাসের মধ্যেই বিচ্ছেদ ঘটে। পরবর্তীতে মো. শাহেদ ঢাকায় একটি বিয়ে করেছেন বলে জানা যায়। সূত্র : বিবিসি।
আরও পড়ুন

সর্বশেষ