শনিবার, মে ১৮, ২০২৪
প্রচ্ছদইন্টারভিউ১০৬ প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তপ্রায়, ২৫ হাজার একর পাহাড় সমতল ভূমিতে পরিণত

১০৬ প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তপ্রায়, ২৫ হাজার একর পাহাড় সমতল ভূমিতে পরিণত

ন্যাশনাল ডেস্কঃ (বিডি সময় ২৪ ডটকম)

চট্টগ্রামে দুই দশকে ১৫০টি পাহাড় কাটা হয়েছে। এতে ২৫ হাজার একর পাহাড় কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। এরফলে ভূমিধস, মাটি ক্ষয়, খাল-বিল জলাশয় ভরাট, পানি শোধনের উৎস, মাছ-জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গত ২০ বছরে চট্টগ্রামে অন্তত ৩৫০বার মৃদু ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এ অঞ্চলে পাহাড়ি গাঁথুনি শক্ত নয় বলে ভূমিকম্পে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা বেশি। এতে প্রাচ্যের রাণী চট্টগ্রাম কালের গর্ভে ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়ে শ্রীহীন অপরিকল্পিত নগরীতে রূপান্তিত হচ্ছে। এছাড়াও বন উজাড় ও পাহাড় কাটার ফলে ১০৬ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্নপ্রায়।

পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আয়োজিত চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা, পরিবেশ বিপর্যয় বিষয়ক আলোচনা সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্টি এন্ড এনভায়রমেন্টাল সায়েন্সের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামাল হোসাইনের গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলা ছাড়া ১৩টি উপজেলায় চার লাখ একর পাহাড়ি ভূমি রয়েছে। এক সময় এসব পাহাড় সৌন্দর্যের লীলাভূমি ছাড়াও ছিল সুফি-সাধক-সন্ন্যাসীদের ধ্যান-মগ্নের কিংবদন্তি স্থান। কালক্রমে সরকারি-বেসরকারি নানা স্থাপনা নির্মাণ, পাহাড় খেকোদের থাবায় পাহাড় ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বালু মাটি হওয়ায় পাহাড় কাটা ও ন্যাড়া হলেও প্রতিনিয়ত মাটি ধস ও মাটি ক্ষয় বাড়তে থাকে।

পাহাড় বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসাইন উল্লেখ করেন, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটার ফলে জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ হারিয়ে যাচ্ছে। এতে ১০৬ প্রজাতির উদ্ভিদ এখন বিপন্নপ্রায়। অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন অবস্থায় টিকে রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলেন, প্রাকৃতিকভাবেই পাহাড়ের পাদদেশে বহমান জলধারা ও পানিতে বসবাসরত উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। এছাড়া পাহাড়ি এলাকায় পানি সংরক্ষণের পরিমাণও আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।

ভূমিকম্পে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরের চট্টগ্রামে অন্তত ৩৫০ বার মৃদু ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ের গাঁথুনি শক্ত নয় বলে ভূমিকম্পে পাহাড় ধসে সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি। এর সাথে পাহাড় কাটা যোগ হলে ভবিষ্যতে ভূমিকম্পে পাহাড় ধসে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

গত চার দশক ধরে চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে উল্লেখ করেছেন প্রতিবেদনে। ১৫ বছরে চট্টগ্রামে সরকারি কমিটি পাহাড় কাটার অনুমতি দেয়নি। তবে থেমে ছিল না পাহাড় কাটা। নগরীর এ কে খান গেট থেকে সীতাকুন্ডের কুমিরা পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার পাহাড় সারির অনেকাংশ ন্যাড়া হয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পাহাড় কাটায় জড়িত। দুই দশকে চট্টগ্রামে ১৫০টি পাহাড় কাটায় চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে ২৫ হাজার একর পাহাড় ন্যাড়া করা হয়েছে। প্রভাবশালী মহল পাহাড় কেটে গড়ে তুলছে বস্তিঘর। এতে ছোট ছোট পাকা-কাঁচা পাকা ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিচ্ছেন প্রভাবশালীরা। নিম্ন আয়ের লোকজন চরম ঝুঁকি নিয়ে এসব ঘরে বসবাস করে আসছে। বিশেষ করে নদী ভাঙন ও দরিদ্র শ্রেণীর লোকজন সস্তায় পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করে আসছে। শতাধিক বস্তির ৫ লক্ষাধিক মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হল : মতিঝর্ণা, বাঘঘোনা, বায়েজিদ বোস্তামী, লালখান বাজার, হামজারবাগ, বার্মা কলোনি, জামতলা বস্তি, পলোগ্রাউন্ড পাহাড়, বাটালি হিল, জিলানী পাহাড়, এ কে খান পাহাড়, নাসিরাবাদ পাহাড়, চন্দ্র নগর পাহাড়, রউফাবাদ পাহাড়, কুসুমবাগ, জালালবাদ, বন গবেষণাগারের পেছনে, খুলশী, ষোলশহর, ফৌজদারহাট ও কুমিরা ইত্যাদি।

চট্টগ্রামে দুর্যোগে জীবনহানির অন্যতম কারণ হচ্ছে ভূমিধস। পাহাড়ি ভূমিধসে গত ছয় বছরে নগরী ও বিভিন্ন স্থানে ২৫০ জন লোক মারা যান।

২০০৭ সালে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে ১২৮ জনের মৃত্যুর পর তদন্ত কমিটির রিপোর্টে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রেলওয়ে, বনবিভাগ ও পুলিশসহ ছয় সরকারি সংস্থাকে দায়ী করেছেন। এছাড়া পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত ৫৭ প্রতিষ্ঠান ও ১৬২ জনের একটি তালিকা করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির কোনো সুপারিশ ছয় বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। বরঞ্চ গত দুই সরকারের আমলেই বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে। দুই সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের লোকজনই জড়িত ছিল।

প্রতিবেদনে তিনি সুপারিশমালায় উল্লেখ করেছেন, পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে স্থায়ী বিধি নিষেধ আরোপ, পাহাড় ধসের জন্য দায়ী সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে বিচারের মুখোমুখি করা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া, স্থায়ী পুনর্বাসন করা। পাহাড়ের খালি জায়গায় পরিকল্পিতভাবে বনায়ন। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানসমুহে গ্রীন বেল্ট তৈরি করতে হবে। এতে জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। পাহাড়ের পাদদেশে ইটভাটা তৈরির অনুমতি না দেয়া। পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, বনবিভাগ, রেলওয়ে, ভূমি মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করে নগরীর উন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণ করা। পাহাড় কাটা আইন সমূহ সংশোধনপূর্বক যুগোপযোগী করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যেন পাহাড় কাটার অনুমতি দেয়া না হয়। কারণ প্রয়োজনের কথা বলে অনুমিত পেলে অপব্যবহার করা হবে। শহরের পাহাড়ি এলাকা সমূহকে ইকোপার্ক বা পর্যটন স্পটের জন্য সংরক্ষিত রাখা। সমন্বিত পর্বত উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে অধিক সম্পৃক্তকরণ, জাতীয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন ও তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ