শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
প্রচ্ছদফিচারমুজিব বাহিনী গঠনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

মুজিব বাহিনী গঠনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

প্রবাসী মুজিবনগর সরকার এবং সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানিকে না জানিয়ে গোপনে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে মুজিববাহিনী গঠিত হয়েছে বলে খুবই নেতিবাচক একটি মনোভাব ভারতের মাটিতে ১৯৭১ সালে মুজিববাহিনী গঠনের সময় থেকেই প্রচারিত ও প্রচলিত রয়েছে। মুজিববাহিনী গঠিত হলে কর্নেল ওসমানী তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছিলেন। এতে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বি ডি এফ (বাংলাদেশ ফোর্স) ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে এবং নিয়মিতবাহিনীর মাঝে খুবই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়। এ নেতিবাচক মনোভাব এদের অনেকের মাঝে যুদ্ধপরবর্তীকালেও অব্যাহত থাকতে এবং সংক্রমিত হতে দেখা যায়। এ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ফলে গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফর উল্লাহ চৌধুরীকে ‘মুজিব বাহিনী কোনো যুদ্ধ করেনি, লুটপাট করেছে’ এমন ভুল ও অজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা ব্যক্ত করতে দেখা যায়।

এসব নেতিবাচক মনোভাবের কিছু অংশ কিছু মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের বেলায় সঠিক হলেও কিছু অংশ ভুল। বিশেষ করে ‘মুজিব বাহিনী কোনো যুদ্ধ করেনি’ এরকম ধারণা ও প্রচারণা সম্পূর্ণভাবে ভুল। চাক্ষুশ অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়; চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা যুদ্ধে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যেসব মুক্তিযোদ্ধা নেতৃত্ব দিয়েছেন, স্থানীয়ভাবে যোদ্ধা তৈরি করতে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন তাদের দু একজন ব্যতীত অন্যরা সবাই ছিল মুজিব বাহিনীর যোদ্ধা। এরকম একজন সংগঠকের নাম মাহফুজুর রহমান। স্বাধীনতার পর তিনি ডা. মাহফুজুর রহমান নামেই পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ভারতে মুজিব বাহিনীর দেরাদুন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বাদ্ধীন চট্টগ্রাম শহর কমান্ডের আর্মস ইন কমান্ড ছিলেন ভিপি হারুন।

স্বাধীনতার পর তিনি ইঞ্জিনিয়ার হারুন নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম শহরে বহু দুর্ধর্ষ অপারেশনের পরিপল্পনাকারী ও নেতৃত্ব দানকারী সংঘটক। তিনিও দেরাদুন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুজিব বাহিনীর নেতৃস্থানীয় একজন সদস্য। চট্টগ্রাম শহরে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণের দুটি ঘটনা ঘটেছে, এ দুটি অপারেশনই সম্পন্ন হয়েছে মুজিববাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যদের দ্বারা। চট্টগ্রাম শহরে একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধার নাম শ্রী অমল মিত্র। পাক বাহিনীর ওপর উপরোক্ত দুটি ওপারেশনেই তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন, প্রথমটিতে দলভুক্তভাবে দ্বিতীয়টিতে একা। তিনি ভারতের ঝাড়খণ্ডের তান্দুয়ায় (দেরাদুন) মুজিববাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুজিব বাহিনীর একজন সদস্য। চট্টগ্রাম শহরে মুজিব বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধ করার বিবরণ আরও দীর্ঘ করা যায়।

‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই মুজিব বাহিনীর কিছু সদস্যই লুটপাটে নেতৃত্ব দিয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধু সরকারকে সহযোগিতা দূরের কথা বরং তাদের কর্মকাণ্ড সরকারকে ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন করে দেয়। মুজিব বাহিনী সৃষ্টির যে মূল লক্ষ্য ছিল, অর্থাৎ নতুন সরকারকে শক্তিশালী করা, তা মাঠে মারা যায়। তারা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্যের রূপ নেয়। কিছুদিন পর তো তারা সরাসরি অবস্থান নেয় সরকার তথা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেই’। ২০১৪ সালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার বই ‘ভেতরে বাইরে’-তে এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) এ কে খন্দকার মুজিব বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে এমন বিরূপ মন্তব্য করলে ইসহাক ভুঁইয়া নামে মুজিব বাহিনীর এক মুক্তিযোদ্ধা ব্রাহ্মণবাড়িয়া কোর্টে এয়ার ভাইস মার্শাল(অব.) এ কে খন্দকারের বিরুদ্ধে মামলা টুকে দেন। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে এমনতর খণ্ডিত ও নেতিবাচক ধারণা সামরিক-বেসামরিক অনেক ব্যক্তির মাঝে এখনো রয়েছে এবং তা প্রকাশ হতে মাঝে মাঝে দেখা যায়।

এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) এ কে খন্দকারের উপরোক্ত বক্তব্যের একটি অংশ- ‘মুজিব বাহিনী সৃষ্টির যে মূল লক্ষ্য ছিল, অর্থাৎ নতুন সরকারকে শক্তিশালী করা, তা মাঠে মারা যায়’, থেকে বোঝা যাচ্ছে, মুজিব বাহিনী বুঝি স্বাধীন বাংলাদেশে গঠিত হয়েছিল স্বাধীনতা লাভের পর! বাস্তবে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের মাটিতে। বাস্তবে মুজিববাহিনী গঠনের প্রেক্ষাপট ও সময়কাল সম্পর্কে যথাযথভাবে এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) এ কে খন্দকার মহোদয় অবহিত থাকলেও অনবধাবনতাবশত তাঁর বইতে উপরোক্ত বাক্যাংশটি যুক্ত হয়ে যাওয়ায় মুজিববাহনী গঠনের সময়কাল সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের পাঠকের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তোফায়েল আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাক-এর, চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল-এর মেগা ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘১৯৭১’ ও বিবিসি বাংলাকে দেয়া, ভিডিও সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় ভারতের মাটিতে মুজিববাহিনী গঠনের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে।

৭০-এর নির্বাচনের পর পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলি ভুট্টো ও ইয়াহিয়া গং ক্ষমতা হস্তান্তর না করার উদ্দেশ্যে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করলে ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণি ও আবদুর রাজ্জাক এই চার ছাত্রনেতাকে ডেকে নিয়ে বললেন; ‘ওরা আমদের ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না, ক্ষমতায় আমাদেরকে যুদ্ধ করে যেতে হবে। এ জন্যে তোমাদেরকে আমি দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে নির্দেশ দিচ্ছি’। এ বৈঠকে তাজউদ্দিন আহমদও উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দিন আহমদকে দেখিয়ে বললেন, ‘আমি যদি না থাকি, তাহলে আমার অনুপস্থিতে তোমরা উনার নেতৃত্বে কাজ করবে (সূত্র: তোফায়েল আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাক-এর ভিডিও সাক্ষাৎকার, তানভীর মোকাম্মেল-এর মেগা ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘১৯৭১’ ও বিবিসি বাংলা)।

ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা হস্তান্তর নাকরার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু যে নিশ্চিত ছিলেন এ কথার সাক্ষ্য পাওয়া যায়, এম আসগর খান-এর বই ‘উই হ্যাভ লার্নড নাথিং ফ্রম হিস্ট্রি: পাকিস্তান- পলিটিকস অ্যান্ড মিলিটারি পাওয়ার’ থেকে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধুর সাথে ঢাকায় এম আসগর খানের বৈঠকের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করতে গিয়ে ‘হাও বাংলাদেশ ওয়াজ বর্ন’ অধ্যায়ে আসগর খান বলছেন, ‘ঢাকায় সপ্তাহব্যাপী অবস্থানকালে আমি শেখ মুজিবের সঙ্গে তিনবার বৈঠক করি। একটা বাদে বাকি সব কটি বৈঠকে কেবল আমরা দুজনেই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে কথা বলি। মুজিব নিশ্চিত ছিলেন, ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দমাতে সেনাবাহিনী ব্যবহার করবেন’। (সূত্র: ‘১৯৭১ শত্রু ও মিত্রের কলমে’ সম্পাদনা: মতিউর রহমান। পৃষ্ঠা-১৫০, দ্বিতীয় মুদ্রণ: ফাল্‌গুন ১৪২৬, ফেব্‌্রুয়ারি ২০২০, প্রথমা প্রকাশন)।

এ কারণে বঙ্গবন্ধু উপরোক্ত চার ছাত্রনেতাকে ডেকে দীর্ঘ মেয়াদি গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তোফায়েল আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাক-এর উপরোক্ত ভিডিও সাক্ষাতকারসমূহ থেকে জানা জায়, ওই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত গোপনীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্যে কলকাতার ভবানীপুরের একটি বাড়ির ঠিকানা ওই চার ছাত্রনেতাকে লিখে না দিয়ে মুখস্ত করান। ‘সানি ভিলা,২১ নং রাজেন্দ্র রোড, নর্দান পার্ক, ভবানীপুর’। যুদ্ধ শুরু হলে তারা এ ঠিকানায় গেলে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাবেন বলে জানান। বাড়িটি বঙ্গবন্ধুর বিশেষ সহযোগী এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক পিরোজপুর এলাকার বাসিন্দা চিত্তরঞ্জন সুতারের। বাড়িটি পূর্ব-বাংলা থেকে আগত আওমীলীগ-ছাত্রলীগের নীতিনির্ধারক নেতৃবৃন্দের যোগাযোগের কাজে ব্যবহার করার জন্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার চিত্তরঞ্জন সুতারকে বরাদ্দ করেছিল (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ জুন ২০১৩)। যুদ্ধ শুরু হলে এ ছাত্রনেতারা এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে সানি ভিলায় সমবেত হয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে মুজিববাহিনী গঠনের কাজে লেগে যান। মুজিববাহিনী গঠনের শুরুর দিকে উপরোক্ত চার ছাত্রনেতা সানি ভিলায় থাকতেন।

মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তোফায়েল আহমেদ-এর মতে মুজিববাহিনীর আদি নাম ছিল বি এল এফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স)। এ নাম পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে গঠিত ছত্রলীগের গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’-এর দ্বারা ১৯৬২ সালে ঠিক করা হয়েছিল। ভারতে এসে উপরোক্ত চার ছাত্রনেতা বি এল এফ নাম পরিবর্তন করে মুজিববাহিনী নামকরণ করেন। কেননা, বঙ্গবন্ধুই যেহেতু স্বাধীনতা লাভের জন্যে তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছাত্রনেতাদের গেরিলাযুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন তাই স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠন– বি এল এফ-এর নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর নামে ‘মুজিববাহিনী’ রাখা হয়। এই মুজিব বাহিনীতে বিশেষভাবে নির্বাচিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের পৃথক প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে ‘মুজিববাহিনী’ নামের পাশাপাশি ‘বি এল এফ’ নামও প্রচলিত ছিল।

লেখক: করিম আবদুল্লাহ , পরিচালক, বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম অধ্যয়ন কেন্দ্র।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ