রবিবার, মে ১৯, ২০২৪
প্রচ্ছদইন্টারভিউকোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য

কোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য

স্টাফ রিপোর্টার:(বিডি সময় ২৪ ডটকম)

পবিত্র শবে বরাতের রাতে কোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদ ও মাজারে। নানা পদ্ধতিতে এই ভিক্ষা বাণিজ্য হয়েছে রাতজুড়ে। ভাড়া করা শিশু, হাসপাতাল থেকে ছুটি নেয়া রোগী, বিভিন্ন বাসাবাড়ির কাজের বুয়া, গ্রামের শ্রমজীবীসহ নানা শ্রেণীর লোক এই একদিনের ভিক্ষা বাণিজ্যে অংশ নেয়। পবিত্র কোরানে বলা আছে শবে বরাত হলো আল্লাহপাকের নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের এক দুর্লভ সুযোগ। এ উদ্দেশে ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিরা পবিত্র লাইলাতুল বরাতে সাধ্যমতো দান খয়রাত করেছেন। পাপ-তাপ থেকে মুক্তিলাভের আশায় সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাতব্যাপী করেছেন ইবাদত-বন্দেগি। পড়েছেন নফল ও তাহাজ্জুদের নামাজ। পাশাপাশি সাধ্যমতো দান-খয়রাত করেছেন প্রায় সবাই। এ সুযোগে এক রাতেই প্রায় কোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য করেছে ভিক্ষুকরা। সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পবিত্র শবে বরাত উপলক্ষে শুধু ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে থেকেও এসেছিল ভিক্ষুকরা। কেউ কেউ এসেছিল সপরিবারে। ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীর মসজিদ ও মাজারগুলোতে। বিভিন্ন বয়সের ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শবে বরাত উপলক্ষে তাদের প্রস্তুতি ছিল অনেক আগে থেকেই। কেউ এসেছিল রোববার, কেউবা সোমবার সকালে। সারা রাত ভিক্ষা করে সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেছে তারা। এ জন্য ঝক্কি-ঝামেলাও কম পোহাতে হয়নি তাদের। আগে থেকেই জায়গা দখল, ঢাকার নিয়মিত ভিক্ষুকদের সঙ্গে নতুন ভিক্ষুকদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল নিয়মিত বিষয়। এছাড়া সিন্ডিকেটের কারণে জায়গা দখল করতে টাকাও গুনতে হয়েছে কোন কোন ভিক্ষুককে। তবে এক্ষেত্রে ঢাকার বাইরে থেকে আসা ভিক্ষুকরা ভোগান্তিতে পড়েছে বেশি। অবশ্য রাত শেষে মুখে হাসি ছিল প্রায় সকলের। কথা হয় সত্তরোর্ধ্ব ভিক্ষুক হালিমের সঙ্গে। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। পরনে ধবধবে সাদা নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি পরা এ ভিক্ষুক এসেছেন নেত্রকোনা জেলার মদনপুর থেকে। শবে বরাত উপলক্ষে সোমবার সকালেই বাসে করে ঢাকায় আসেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের হযরত শাহ্ খাজা সরফুদ্দিন চিশতী (রহ.)-এর মাজারে (হাইকোর্ট মাজার) রাস্তার পাশের ডিভাইডারে সকাল থেকে বসেছিলেন। রাত ২টা পর্যন্ত ভিক্ষা করে পেয়েছেন ১০৫২ টাকা। জন্মান্ধ রুবেল ও হাসু দু’জনেরই বয়স বিশের কোঠায়। থাকে মুগদা মানিকনগর ১৪ নম্বর বস্তিতে। বিশেষ দিবসে এক সঙ্গে ভিক্ষায় বের হয়। তাদের সহযোগিতা করে হাসুর ছোট ভাই রাজু। গত শবে বরাতে ছিল গুলশানের আযাদ মসজিদে। আয় হয়েছে ২৭০০ টাকা। তাই দু’জনে ভাগ করে নিয়েছে। এবার বসেছে হাইকোর্ট মাজারে। কত আয় হবে প্রশ্ন করলে দু’জনই জানায় ‘এইবার মনে অয় কম হইব। পুলিশ, র‌্যাব খুব ঝামেলা করতাছে। কোন জায়গায় বইতে দেয় না, খাড়াইতে দেয়না। তাই এক জায়গায় বসতে পারতেছি না। ‘শবে বরাতে ভিক্ষা করলে এক জায়গায় ধ্যানের মতো বসন লাগে’ বিজ্ঞের মত জানায় রুবেল। ভিক্ষুক হাসু জানায় তার ৭ ভাইবোনের চারজনই অন্ধ। শবে বরাতে এরা সবাই ভিক্ষায় বের হয়। দু’বোনের একজন ভিক্ষা করছে মিরপুর কাজীপাড়া জামে মসজিদে, একজন গুলিস্তান হযরত গোলাপ শাহ্ (রহ.) মাজারে, আর এক ভাই গেছে কাকরাইল মসজিদে। বরিশালের স্বরূপকাঠি জেলার বালীহারি গ্রাম থেকে এসেছে রুখসানা বানু (৪৮)। লঞ্চে করে সোমবার সকালে ঢাকায় নেমেছে। বায়তুল মোকাররম হাইকোর্ট কোথাও জায়গা না পেয়ে বসেছে গুলিস্তান পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ভবনের সামনের ফুটপাতে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে রুখসানা। মাথার ঘোমটা টেনে এক মনে কোরান পড়ছেন তিনি। কথা হয় রুখসানার সঙ্গে। সারা রাতে ২৫ পারা পর্যন্ত কোরান পড়বে। এরই মধ্যে সূরা হজ, সূরা বাকারা, সূরা নিসা, সূরা মায়িদাহ, সূরা আনআম পড়া হয়ে গেছে। যা আয় হবে তাই নিয়ে সকালের লঞ্চে চড়ে বাড়ি ফিরবে। আবার আসবে ২৭শে রমজান। মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনের রাস্তার দু’পাশে যদ্দূর চোখ যায় শুধুই ভিক্ষুক। একপাশে পুরুষদের লাইন। অন্য পাশে মহিলাদের। আগত মুসল্লিদের কেউ ভিক্ষা দেয়ার জন্য এগিয়ে আসতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন তারা। এদের মধ্যে কেউ একজন সর্দার ও সর্দারনীর ভূমিকা পালন করছে। চিৎকার করে বার বার বলছে ‘কেউ লাইন ছাইড়া উঠবা না। নামাজিদের বিরক্ত করবা না। ছিরিঙ্খলা ভাইঙ্গো না।’ তবে যারা দৃষ্টি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী তারা একটু পিছিয়ে পড়ছে। অবশ্য ভিক্ষা দেয়ার জন্য মুসল্লিদের আগ্রহ তাদের দিকেই বেশি। আগারগাঁও তালতলা বস্তি থেকে আসা ভিক্ষুক রমিজা বেগম ও রেনু বেগম জানায় তারা বাসা-বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। শবে বরাত উপলক্ষে ছুটি নিয়েছে ভিক্ষা করার জন্য। গেল শবে বরাতেও তারা এসেছিল। দু’জনে আয় করেছিল ৯০০ টাকা করে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ পাশের গেটের দু’পাশ জুড়ে ভিক্ষুকদের লাইন। এর মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী ৭ জনের একটি দলের দেখা পাওয়া গেল। গোল হয়ে সুরে সুরে একটানা জিকির করছে। দলের সর্দার মজনু মিয়া জানায়, গত বছর ১২ হাজার ট্যাকা কামাইছিলাম। এবার মুসল্লি বেশি। ইনশাআল্লাহ বেশি ইনকাম হইব। বায়তুল মোকাররমে বসার জায়গা না পেয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ভিক্ষা করছে শ্মশ্র“মণ্ডিত মো. মুকুল মিয়া (৪৫)। ১০ বছর বয়সে ঢাকার বাসাবো রেলগেটে এক দুর্ঘটনায় ডান পা হারিয়েছিল। সেই থেকে ভিক্ষায় নেমেছে। ক্ষোভের সঙ্গে জানায়, আইজকা শবে বরাতে যত ভিক্ষুক দেখবেন বেশির ভাগই ভুয়া। অরজিনাল ফকির আমরা। ছিলাম ভদ্র ঘরের সন্তান। হইছি ফকির। সারা রাত মুসল্লিরা ইবাদত-বন্দেগি করবো। সারা রাতই তারা ভিক্ষা দিবো। তয় আমার মতো আসল ফকিরের তারা ঠিকই চিনবো। বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটের সামনে হাত ও পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভিক্ষা করছে ১২ বছরের প্রতিবন্ধী ইমরান। তাকে ঘিরে ছোটখাটো জটলা। বরিশালের আমতলী থানার আরীমণ্ডল গ্রাম থেকে এসেছে সে। পিতা মানিক খাঁ ভিক্ষা করছে আজিমপুর গোরস্থান মসজিদে। রমজানজুড়ে পিতা-পুত্র ঢাকায় থাকবে। ভিক্ষা করে যা আয় হবে তা নিয়ে ঈদের দিন চলে যাবেন গ্রামের বাড়ি।

শিক্ষিত ভিক্ষুক: ৫৫ বছরের মো. মামুন বিল্লাহ। এসেছে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া থেকে। নিজেকে একটু আলাদা প্রমাণ করতেই যেন ভিক্ষা করতে বসেছে প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায়। পরনে হাফ প্যান্ট। খালি গা। গলায় জড়ানো হরেক রঙের পুঁতির মালা। হাতে ব্রেসলেট। সাদা চক দিয়ে পিচঢালা রাস্তায় ইংরেজি ও বাংলা শব্দে গোটা গোটা অক্ষরে লম্বা লাইনে লিখেছে “ঢাকা সিটির ব্রাদার এন্ড সিষ্টার। ষ্ট্যান্ড আপ এন্ড লিসেন টু মি। মাই নেম ইজ মামুন বিল্লাহ। একটি রোড এক্সিডেন্টে আমার দুটি পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত হারিয়েছি। ৫ সদস্যের পরিবারের বোঝা টানতে আমি ল্যাংড়া মামুনকে ভিক্ষা করতে হচ্ছে। প্লিজ ব্রাদার এন্ড সিষ্টার হেল্প মি। আল্লাহ ইজ হেল্প ইউ।” মামুন বিল্লাহর মুখে ভিক্ষা চাইতে অনীহা। জানালেন, ‘ভিক্ষার জন্য অন্য ফকিরদের মতো একটানা ঘ্যান ঘ্যান করতে ভাল্লাগেনা। আমার যা বলার তা তো লিখেই দিছি। কেউ দিলে দিবো, না দিলে নাই। তয় মাশাল্লাহ্ ইনকাম ইজ ভেরি গুড।’

বিকৃত অঙ্গ প্রদর্শন: শবে বরাতে রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদ ও মাজারগুলোতে ভিক্ষার জন্য বিকলাঙ্গের প্রদর্শনী ছিল চোখে পড়ার মতো। কে কত বেশি নিজের বিকৃত অঙ্গ প্রদর্শন করে আগত মুসল্লিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে সে প্রতিযোগিতা ছিল সবার মধ্যে। দীন ইসলামের বাঁ পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটু পর্যন্ত দগদগে ঘা। ভিক্ষার জন্য বসেছে গুলিস্তান কেন্দ্রীয় শিশু জামে মসজিদের গেটের সামনের ফুটপাতে। জানায়, পুলিশের জন্য একটানা কোন জায়গাতেই বসতে পারছে না। পারলেও পা ঢেকে রাখতে হচ্ছে। তবে আয় তার ভালই হচ্ছে। ‘পায়ের চিকিৎসার কথা কইলেই ৫-১০ ট্যাহার কমে কেউ দেয় না’ বলে জানায় দীন ইসলাম। হাইকোর্ট মাজারের সামনের রাস্তার ফুটপাতে বসেছে রেহানা আক্তার। ডান পা ফাইলেরিয়া (গোদ রোগ) রোগে আক্রান্ত হয়ে ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে। পা খানি রাস্তায় ফেলে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। জানায়, পুলিশের বাধায় মাজারের ভেতরে ঢুকতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশে বসতে হয়েছে। সারা রাত এভাবেই চলবে। রমজান আলী। বয়স ষাটের কাছাকাছি। মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনের রাস্তায় খালি গায়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। একটু পর পর আকাশের দিকে তাকিয়ে হা করে শ্বাস নিচ্ছেন তিনি। মাথায় চুল নেই। সারা গায়ের চামড়া উঠে মাংস বের হয়ে আসছে। ইবাদত-বন্দেগি ও নামাজে আসা মুসল্লিরা এ দৃশ্য দেখেই চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। রমজান আলী জানায় ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। শবে বরাতে ভিক্ষা করার জন্য বহু কষ্টে হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে এসেছে। জানায়, এখন পর্যন্ত ৭১৩ টাকা আয় হয়েছে। ফজরের নামাজের পর আখেরি মোনাজাত শেষ করেই হাসপাতালে ফিরে যাবে। সুস্থ হলে পুরো রমজানে ভিক্ষা করে যা আয় হবে তাই নিয়ে চলে যাবে গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বাদিয়াখালী গ্রামে।

একদিনের অতিথি: রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদ ও মাজার ঘুরে দেখা গেছে ঢাকায় ভিক্ষা করতে আসা ভিক্ষুকদের একটা অংশ ছিল একদিনের অতিথি। শুধুমাত্র শবে বরাতকে কেন্দ্র করেই একদিনের জন্য ঢাকায় এসেছিল এই অতিথিরা। সঙ্গে পুটলা-পুঁটলি তো ছিলই। এরকম অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে নিজ নিজ এলাকার শ্রমজীবী মানুষ তারা। ভিক্ষার কৌশল অবলম্বন হিসেবে কেউ সঙ্গে নিয়ে এসেছিল স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা পৌরসভার মেয়রদের সই করা প্রতিবন্ধী সনদ, কারও গলায় ঝোলানো হাসপাতালের চিকিৎসা সনদ, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার কাগজপত্র ইত্যাদি। রংপুরের পীরগঞ্জের মোজাম্মেল হোসেন জানায় এলাকায় সে মাটি কাটার কাজ করে। অনেকের মুখেই শুনেছে শবে বরাতে ঢাকায় ভিক্ষা করলে অনেক টাকা পাওয়া যায়। তাই প্রথমবারের মতো চলে এসেছে। বরিশালের মেহেদীগঞ্জের লস্করপুর গ্রামের ফটিক হাওলাদার, নূর ইসলাম, জজ মিয়া, ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া থানার শুভরিয়া গ্রামের আমেনা বেগম, লতিফা বেগম, সুলতানা বেগমসহ আরও অনেককে পাওয়া গেল শবে বরাতে ভিক্ষার জন্য ঢাকায় এসেছে। কেউ কেউ এসেছে দু’দিন আগেই।

ভাড়া করা শিশু নিয়ে ভিক্ষা: বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে হুইল চেয়ারে বসে ভিক্ষা করছে ১৩-১৪ বছরের প্রতিবন্ধী শিশু চয়ন। আড়ালে দাঁড়ানো মাথায় ঘোমটা দেয়া এক মহিলা। মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনির বস্তি থেকে তাকে ৩০০ টাকায় ভাড়া করে নিয়ে এসেছে মা পরিচয়দানকারী ফুলবানু। পাশেই তিন চাকার বেয়ারিংয়ের গাড়িতে বসা ৯ বছরের প্রতিবন্ধী লুৎফাকেও ভাড়া করে নিয়ে এসেছে পিতা পরিচয়দানকারী ইনসান মিয়া। পরিচয় গোপন রেখে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সারা রাত ভিক্ষা করে আয় হবে ২ হাজার টাকার মতো। এই ভিক্ষা চলবে পুরো রমজান।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ