সাংবাদিকের কাজ সত্য উদ্ঘাটন করা এবং সেটি সবাইকে জানিয়ে দেওয়া। দায়িত্ব পালনের সার্থকতা বোধ ছাড়াও এতে আনন্দ আছে। পেশাদারি তৃপ্তি আছে। কিন্তু সাংবাদিক যতই পেশাদার হন, মানুষও তো বটে। কিছু কিছু সত্য এমনই হূদয়বিদারক যে, সেটি সাংবাদিকের পেশাদার সত্তাকে ছাপিয়ে পুরো মানুষটাকেই বিমূঢ় করে দেয়। এমন বিমূঢ় দশাতেই কাটছে গত কয়েকটা দিন।
চোখের সামনে উন্মোচিত বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্ধকার এক জগৎ এমনই বিষম এক ধাক্কা হয়ে এসেছে যে, বলতে গেলে নির্ঘুমই কেটেছে গত চার-পাঁচটি রাত। পেশাদার সাংবাদিকেরই যদি এই অবস্থা হয়, সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের অনুভূতিটা অনুমান করতে একটুও সমস্যা হচ্ছে না। মেঘে ঢাকা গোমড়া আকাশ নিয়ে ঘুম ভাঙা প্রায় বিরতিহীন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কালকের দিনটি যেন প্রতীকী হয়ে গেল বাংলাদেশের ক্রিকেটের কালো এক দিনের।
কাল সকালে ঘুমঘুম চোখে প্রথম আলো হাতে নিয়ে নিশ্চয়ই হতভম্ব হয়ে গেছেন পাঠকেরা। যে ক্রিকেট নিয়ে এ দেশের মানুষের এত আবেগ, যে ক্রিকেট পরিণত হয়েছে লাল-সবুজের প্রতীকে, হাজারো সমস্যায় জর্জরিত জাতিকে যে ক্রিকেট নিয়ে আসে এক পতাকার নিচে, মাঝেমধ্যেই উপহার দেয় সর্বজনীন উৎসবের উপলক্ষ, সেটি নিয়েই এমন ছিনিমিনি খেলেছেন ক্রিকেটাররা!
বিস্ময়-হতাশা-ক্ষোভ মিশ্র যেসব অনুভূতি তাঁদের মনে খেলা করেছে বলে অনুমান করছি, এই প্রতিবেদকও গত কয়েক দিন তাতে আক্রান্ত। তারকাসুলভ অহমিকার ছিটেফোঁটাও যাঁর মধ্যে নেই, ব্যবহারে-কথাবার্তায় এখনো যেন পাশের বাড়ির ছেলেটি—সেই মোহাম্মদ আশরাফুল এমন করতে পারেন! এই অন্ধকার জগতের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া নামগুলোও তো বাংলাদেশের ক্রিকেটাকাশে উজ্জ্বল সব নক্ষত্র হয়ে জ্বলজ্বল করছিল।
ক্রিকেটকে ঘিরে এই বদ্বীপের উৎসবের দেশে পরিণত হওয়ার প্রথম দুটি উপলক্ষ এনে দিয়েছিলেন খালেদ মাসুদ ও খালেদ মাহমুদ। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফির ফাইনালে শেষ ওভারে খালেদ মাসুদের ছক্কা রূপকথা হয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। আর বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রথম বড় জয়—১৯৯৯ বিশ্বকাপে নর্দাম্পটনে পাকিস্তান-বধ—সেটির নায়ক খালেদ মাহমুদ।
২০০৬ সালে বগুড়ায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে খেলে অবসর নিলেন খালেদ মাহমুদ। তাঁকে নিয়ে লেখা বিশেষ কলামের শিরোনাম দিয়েছিলাম, ‘বিদায় লড়াকু মাহমুদ!’ যার একটা অংশ ছিল এ রকম: ‘সংকল্প, লড়াই আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞা দিয়ে প্রতিভার ঘাটতিও যে অনেকটাই ঢেকে দেওয়া যায়—মাহমুদের ক্যারিয়ার তো তার ডকুমেন্টারি।’
আজ আরেকটি গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠান। প্রাসঙ্গিকভাবেই মনে পড়ে যাচ্ছে, আমাদের প্রথম বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ হয়েছিলেন খালেদ মাসুদ। যাঁর সম্পর্কে সেদিন বাংলাদেশ দলের তৎকালীন কোচ ডেভ হোয়াটমোর বলেছিলেন, ‘এশিয়ার সেরা উইকেটকিপার।’ নিয়তির কী পরিহাস, সেই খালেদ মাসুদের ভিন্ন একটা পরিচয় এখন উন্মোচিত।
আর মোহাম্মদ রফিক? তাঁর অবসর নেওয়ার পর সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রথম আলোর স্টেডিয়াম পাতায় এক পাতাজুড়ে তাঁকে নিয়ে বিশেষ আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে লিখেছিলাম, রফিকের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। সেটির ব্যাখ্যাটা ছিল এ রকম—মোহাম্মদ রফিক শুধুই একজন ক্রিকেটারের নাম নয়। হাজারো প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে মানুষের বিজয়ী হওয়ার গল্প। অনন্ত প্রেরণাদায়ী এক গল্প। রফিকের গল্প আপনাকে জানাবে, প্রতিভার সঙ্গে ঐকান্তিক পরিশ্রম যোগ হলে একজন মানুষ শূন্য থেকেও কত বড় হতে পারে! পাঠ্যপুস্তকে তো এসবই থাকা উচিত, যা শিশু-কিশোরদের জানিয়ে দেবে, মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়।
মাঠে আনন্দের কত মুহূর্তই না উপহার দিয়েছেন তাঁরা! অথচ সব ছাপিয়ে আজ বড় হয়ে উঠছে ক্রিকেটের অন্ধকার জগতের সঙ্গে তাঁদের যোগসূত্র।
সাধারণ দর্শকদের মনে এই তিনজনকে ঘিরে শুধুই ক্রিকেটীয় স্মৃতি, কিন্তু এই প্রতিবেদকের মনে তো আরও হাজারো স্মৃতির ভিড়। দেড় যুগেরও বেশি প্রায় সব টুর্নামেন্ট, সিরিজ বা সফরে বাংলাদেশ দলের ছায়াসঙ্গী হয়ে আছি। মাঠের বাইরেও আড্ডায় মেতে ওঠা কত অলস দুপুর, কত মনোরম সন্ধ্যা কেটেছে এই তিনজনের সঙ্গে। মনে পড়ছে ২০০৫ সালের ইংল্যান্ড সফরে কেন্টের ওই সন্ধ্যা। বাংলাদেশের প্রায় সব খেলোয়াড় ও সফরসঙ্গী দুই সাংবাদিকের মধ্যে তুমুল আড্ডা চলছে। খালেদ মাহমুদ হঠাৎই আবেগাক্রান্ত হয়ে আলাদা ডেকে নিয়ে খুলে দিয়েছিলেন হূদয়ের দরজা। ‘আমি জানি, আমার আর খুব বেশি দেওয়ার নেই। আমি দলে থেকে একজন তরুণ খেলোয়াড়ের জায়গা আটকেও রাখতে চাই না। কিন্তু এই যে সফরে আসছি, দলের সবাই মিলে একসঙ্গে মজা করছি, এটা আর আমার জীবনে থাকবে না, এটা যে ভাবতেই পারি না’—বলতে বলতে মাহমুদের কণ্ঠটা ধরে এসেছিল। এই খেলাটাই তাঁর জীবন বলে জানতাম। মাঠ থেকে বিদায় নেওয়ার পরও কখনো কোচ, কখনো বা সংগঠকের ভূমিকায় তাঁর ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে থাকায় তাই একটুও বিস্মিত হইনি। বিস্মিত হয়েছি ‘ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ’ সেই খালেদ মাহমুদই ক্রিকেটকে এমন কলঙ্কিত করেছেন জেনে!
খালেদ মাসুদ খুব প্রাণোচ্ছল স্বভাবের। দুষ্টুমি করে আমাকে ডাকতেন ‘ব্র্যাডম্যান’ বলে। রাজশাহীতে বন্ধু ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া তাঁর ক্রিকেট একাডেমি দেখে এমনই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, ফিরে এসে তা নিয়ে উচ্ছ্বাসভরা একটা লেখা লিখেছিলাম। এখন লিখতে লিখতে তাঁর আতিথেয়তার কথা মনে পড়ছে আর দুচোখ ভরে আসছে জলে।
চোখের জল আড়াল করতে হচ্ছে কয়েক দিন ধরেই। মোহাম্মদ আশরাফুলের প্রসঙ্গ উঠলে সব সময় তা করতেও পারছি না। কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে আশরাফুল ষাটের ঘরে যাওয়ার পর থেকেই প্রেসবক্সে দাঁড়িয়ে। অভিষেকেই সেঞ্চুরিটা হবে তো, হলেই তো ইতিহাস—টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরি! সেই সেঞ্চুরি হলো, প্রেসবক্সের নিয়মনীতি ভুলে গিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিলাম। এখন কোন আশরাফুলকে মনে রাখব?
টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরির আশরাফুলকে, কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে বধ করা আশরাফুলকে, নটিংহামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঝড় তোলা আশরাফুলকে, ভারতের বিপক্ষে চট্টগ্রামে অসাধারণ ওই সেঞ্চুরির আশরাফুলকে…বললে তো আরও কতই বলা যায়! ২০০৭ বিশ্বকাপে গায়ানার আশরাফুল, সে বছরই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জোহানেসবার্গের আশরাফুল… বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রথম বড় সব সাফল্যেই তো আছেন আশরাফুল। তামিম ইকবাল সেদিন কথায় কথায় বলছিলেন, ‘আশরাফুল ভাইকে আমি বলি বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রথম প্রেম। প্রথম প্রেম যেমন কোনো দিন ভোলা যায় না, আশরাফুল ভাইকেও মানুষের চিরদিন মনে থাকবে।’
এ দেশের মানুষকে অনেকবারই আনন্দে ভাসিয়েছেন আশরাফুল। তাঁর দুঃসময়ে কেউ সেসব মনে রাখেনি। কিন্তু প্রথম আলো সব সময়ই পাশে ছিল তাঁর। ব্যঙ্গ করে অনেকে এমনও বলতেন, ‘প্রথম আলো তো “আশরাফুলের আলো”। যে যা-ই বলুক, এই বিশ্বাস থেকে সরে আসার এখনো কোনো কারণ দেখছি না যে, বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানের নাম মোহাম্মদ আশরাফুল। কিন্তু আশরাফুল নামটি যে এখন মনে প্রতারিত বোধ করার মতো অনুভূতিরও জন্ম দেয়!
আশরাফুলকে নিয়ে কত লেখাই না লিখেছি! তাঁকে নিয়েই এমন কিছু লিখতে হবে, এটা কোনো দিন কল্পনাও করিনি। গত পরশু ওকে নিয়ে লিখতে লিখতে বারবারই চোখ মুছতে হয়েছে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এটি এমনই এক ধাক্কা যে, একজন সাংবাদিকের পরম প্রার্থিত এমন একটা ‘স্কুপ’ মারাও একেবারেই আনন্দের কোনো অনুভূতির জন্ম দিতে পারছে না। হতাশা-দুঃখ-ক্ষোভে ভারাক্রান্ত মনে এই প্রশ্নটাও অবশ্য জাগছে—ক্রিকেট বিশ্ব যেখানে এই ফিক্সিং-বিষে জর্জরিত, বাংলাদেশ এর বাইরে থাকে কীভাবে? একটা সময় রসিকতা হতো, বাংলাদেশ দলকে কেউ ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য কেন প্রস্তাব দেবে, বাংলাদেশ হারবে, এটা তো সবাই জানে। কিন্তু স্পট ফিক্সিংয়ের আবির্ভাব বদলে দিল সব। ক্রিকেট প্রশাসকদের অর্থের লোভ খেলাটাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বিতর্কিত অনেক লোকজন। যাদের কাছে ক্রিকেট আর কিছু নয়, শুধুই যেনতেন উপায়ে অর্থ উপার্জনের এক মাধ্যম। আইপিএল-বিপিএল জাতীয় টুর্নামেন্টগুলো হয়ে উঠেছে এর উর্বর ক্ষেত্র। সব মিলিয়ে ক্রিকেট খেলাটা থেকেই মানুষের বিশ্বাস উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা!
ক্রিকেটারদের পদে পদে এখন লোভের হাতছানি। একটা নো বল করলে যদি লাখ লাখ টাকা পাওয়া যায়, টেস্ট ম্যাচে তিন ওভারে ৬ রান করার মতো স্বাভাবিক কাজেও যদি বিশাল অর্থযোগ ঘটে, কারও না কারও পা তো ফসকাবেই। প্রথম আলোর অনুসন্ধান তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটকে জেগে ওঠার ডাক দিচ্ছে। ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’—এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে ক্রিকেটারদের। আরও সজাগ হতে হবে ক্রিকেট বোর্ডকে। অসততাকে বিন্দুমাত্র ছাড় না দিয়ে মন্ত্র হতে হবে ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’।
এই অন্ধকারের মধ্যেও আশায় বুক বাঁধতে চাই, শেষ পর্যন্ত জয় হবে ক্রিকেটেরই। পুরো দেশকে বিনি সুতার মালায় গেঁথে লাল সবুজের প্রতীক হয়েই জ্বলজ্বল করবে বাংলাদেশের ক্রিকেট।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্ধকার জগৎ: সত্য যে কঠিন…
