বৃহস্পতিবার, মে ২, ২০২৪
প্রচ্ছদআরো খবর......পারলেন না দিলীপ বড়ুয়া

পারলেন না দিলীপ বড়ুয়া

চট্টগ্রাম অফিস (বিডি সময় ২৪ ডটকম)

টানা তিনবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রত্যেকবারই জামানত খুঁইয়েছেন। সর্বশেষ গতবার জোটের প্রার্থীকে আসন ‘ছেড়ে দেয়ার’ বিনিময়ে পেয়েছেন মন্ত্রিত্ব। মন্ত্রী হয়ে নতুন আশায় শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। চলতে থাকে ‘গ্রাউন্ড ওয়ার্ক’। তবে চেষ্টা ব্যর্থ এবারও। বলা হচ্ছে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার কথা।
আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের শরিক দল হিসেবে একটিমাত্র আসনে প্রার্থী হতে চায় শিল্পমন্ত্রীর সাম্যবাদী দল। আর সেটি হলো চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই)। তিনি নিজেই এ আসনে মহাজোটের পক্ষে প্রার্থী হওয়ার আশা ব্যক্ত করেছেন  প্রতিবেদকের কাছে। আগের তিনবারের জামানত হারানোর অপবাদ ঘোচানোর একটি সুযোগ তৈরিতে মনোবল শক্ত থাকলেও মাঠের অবস্থা ভিন্ন। শরিক দল হলেও অন্য কোনো দলের প্রার্থীকে মানতে চাইছেন না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের পর অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনের মধ্যে তিনটিতে অংশ নেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসন থেকে ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও ২০০৮ সালে অংশ নেওয়ার সুযোগই পাননি। তবে টেকনোক্র্যাট কোটায় পেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে মাঝে-মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন নিজের এলাকায়। মন্ত্রীর নিজের ভাষায় বিষয়টা এমনই- ‘মন্ত্রী হওয়ার পর আমি গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করেছি’। বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তিনি কোন অবস্থানই তৈরি করতে পারেননি। নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবলও নেই তার। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে-আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও মেনে নিতে চাইছে না সাম্যবাদী দলের নেতা দিলীপ বড়ুয়াকে।
১৫৫২, ৫১১, ৩০৭ :
দিলীপ বড়ুয়া সেই তিন নির্বাচনে কেমন অবস্থানে ছিলেন তা যাছাইয়ে পেছনের তথ্যগুলোই যথেষ্ট। পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯১ সালে দিলীপ বড়ুয়া প্রথমবারের মতো পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তার বিপরীতে নির্বাচনে অংশ নেন আওয়ামী লীগের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, বিএনপির এমএ জিন্নাহ, জামায়াতের মাওলানা শামসুদ্দীনসহ আরও কয়েকজন। দুই লাখ ১৩ হাজার ৩২ জন ভোটারের মধ্যে সেবার এক লাখ ২৭ হাজার ৮১০ জন ভোট প্রদান করেন। এর মধ্যে দিলীপ বড়ুয়ার মার্কায় সিল পড়েছিল মাত্র এক হাজার ৫৫২টি। যা মোট প্রদত্ত ভোটের এক দশমিক ২১ ভাগ। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি হয়েছিলেন চতুর্থ। ৬৬ হাজার ৯৬৯ ভোট পেয়ে ওই নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির প্রার্থী এমএ জিন্নাহ।
এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তিনি অংশ নেননি। চার মাস পরে অনুষ্ঠিত ১২ জুনের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে আরও পতন ঘটে সাম্যবাদী দলের এ কেন্দ্রীয় নেতার। এক লাখ ৭৫ হাজার ৩৪৩ ভোটারের মধ্যে সেবার মোট ভোট পড়েছিল এক লাখ ৩৮ হাজার ৮২২টি। দিলীপ বড়ুয়ার চেয়ার প্রতীকে ভোট পড়ে মাত্র ৫১১টি। যা মোট প্রদত্ত ভোটের শূন্য দশমিক ৩৭ ভাগ। তিনি সেবার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হয়েছিলেন পঞ্চম। ওই আসন থেকে ৬৬ হাজার ৩৩৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। পরে উপ-নির্বাচনে অবশ্য বিএনপির প্রার্থী হেরে যান আওয়ামী লীগের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের কাছে।
দিলীপ বড়ুয়া সর্বশেষ অংশ নেন ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। দুই লাখ ২৪ হাজার ৮৩৬ জন ভোটারের মধ্যে ওইবার মোট প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা এক লাখ ৭১ হাজার ৩৫১। তবে দিলীপ বড়ুয়া উন্নতি করতে পারলেন না। তিনি পান মাত্র ৩০৭ ভোট। যা মোট প্রদত্ত ভোটের শূন্য দশমিক ১৮ ভাগ। সেটি ছিল ওইবার অংশ নেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে সর্বনিম্ন। ওই আসন থেকে ৮৬ হাজার ৮৩৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন বিএনপির এমএ জিন্নাহ।
এদিকে পরপর তিনটি নির্বাচনে জামানাত বাজেয়াপ্ত হওয়া দিলীপ বড়ুয়ার সাম্যবাদী দল ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যোগ দেয় মহাজোটে। শরিক দল হয়ে ওই আসনে প্রার্থী হতে চাইলেও সুযোগ দেয়নি মহাজোট। তবে ১০ শতাংশ টেকনোক্র্যাট কোটার সুযোগে সংসদ সদস্য না হয়েও প্রথমবারের মতো মন্ত্রিত্ব পান দিলীপ বড়ুয়া। কিন্তু মহাজোট সরকার গঠনের কিছু সময়ের মধ্যেই নানা কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকস গত বছরের ৩০ আগস্ট এক তারবার্তা ফাঁস করে দিলীপ বড়ুয়ার মন্ত্রিত্ব প্রসঙ্গে। ওই তারবার্তায় দিলীপ বড়ুয়া প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে দিলীপ বড়ুয়াকে কম হুমকি বলে মনে করেছিলেন। এ কারণেই বাম রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাকে বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার হাতে তুলে দেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়।’ সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ওয়াশিংটনে পাঠানো তারবার্তায় এসব কথাই উল্লেখ করেছিলেন।
নির্বাচনের প্রয়োজনে গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করেছি : দিলীপ বড়ুয়া
আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া গতকাল  বলেন, ‘মহাজোটের শরিক দল হিসেবে সাম্যবাদী দল একটি আসনে নির্বাচন করতে চায়। সেটা হচ্ছে চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই)। এ আসনে নির্বাচন করার জন্য যা যা দরকার তার সবই আমি করেছি। মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি আমি গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করেছি।’
বিষয়টি খুব শিগগিরই মহাজোটের কর্ণধার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উত্থাপন করা হবে বলেও জানান শিল্পমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, ‘প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে এখনো নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে আলোচনা হয়নি। আশা করি, সফল হবো। তৃণমূল পর্যায়ে আমার জনসম্পৃক্ততা রয়েছে। মানুষও আমার সঙ্গে আছে।’ মহাজোট মনোনয়ন না দিলে প্রার্থী হবেন কি-না জানতে চাইলে সরাসরি কোন মন্তব্য না করে তিনি বলেন, ‘সেটা সময় হলে বোঝা যাবে।’
প্লাটফরম তৈরিতে ব্যর্থ
দিলীপ বড়ুয়া যে আসনে তিনবার ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন সেই চট্টগ্রাম-১ আসনে এখন তার অবস্থা কেমন- তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর ক্রমেই মিরসরাইমুখী হতে শুরু করেন তিনি। তবে প্রথম দিকে দীর্ঘবিরতি করে করে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও গত দুই বছর ধরে মিরসরাইয়ের পথগুলোতে খানিকটা জোরে ঘুরতে থাকে তার গাড়ির চাকা। হঠাৎ করে তার এই গতিবৃদ্ধি নজরে আসে অনেকের।
তবে এখন পর্যন্ত তিনি নিজের সাম্যবাদী দলের কোন কমিটিও করতে পারেননি মিরসরাইয়ে। তার হয়ে নির্বাচন পরিচালনার জন্য গড়ে তুলতে পারেননি ন্যূনতম জনবল। মিরসরাইয়ে যেসব অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করেন সেখানে প্রশাসনিক প্রটোকল এবং অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবিশেষ ব্যতীত অন্য কারো উপস্থিতিও পাওয়া যায় না বলে জানা গেছে। ফলে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের যে প্লাটফরম তৈরি করতে চেয়েছেন দিলীপ বড়ুয়া, সেটা আপাতত ব্যর্থ বলে ধরে নিয়েছেন স্থানীয়রা।
প্রার্থী বাছাইয়ের লক্ষ্যে আগামী শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম অঞ্চলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রাম-১ মিরসরাই আসনের প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য সেখান থেকে বৈঠকে অংশ নেবেন মিরসরাই উপজেলা ও বারইয়ারহাট পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকেরা। যোগাযোগ করা হলে তারা সুপ্রভাতের সঙ্গে সরাসরি কোন মন্তব্য না করলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন- মন্ত্রী হয়েও দিলীপ বড়ুয়া নিজের অবস্থান পোক্ত করতে পারেননি।
মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী  বলেন, ‘মিরসরাইয়ের আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের নাম মিশে আছে। এখানে অন্য কোন প্রার্থী কল্পনাও করা যায় না।’
ওই বৈঠকের পরই অনেকটা পরিষ্কার হতে পারে মহাজোটের পক্ষে কে হচ্ছেন মিরসরাই আসনের প্রার্থী! আওয়ামী লীগের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, নাকি সাম্যবাদী দলের কাঙ্ক্ষিত একটিমাত্র আসনের ‘প্রার্থী’ শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া?

আরও পড়ুন

সর্বশেষ