শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে বোরকা কিংবা ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য না করার বিধান থাকলেও বাধা দানে কোন শাস্তির বিধান নেই। পর্দা করতে বাধ্য করলে ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়। কিন্তু বাধা দিলে কি? এই প্রশ্ন অভিভাবকদের। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে বোরকা কিংবা ধর্মীয় পোশাক পরতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না এই বিধান রয়েছে। ২০১০ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্ট এই নির্দেশ প্রদান করে। ফলে এই নির্দেশ অমান্য করে কাউকে বোরকা কিংবা ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু যদি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা কর্মস্থলে বোরকা, ধর্মীয় পোশাক কিংবা জামা লম্বা বা লম্বা জামার হাতা পরতে বাধা দেওয়া হয় কিংবা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তির নির্দেশনা নেই। তাই বোরকা পরতে কিংবা পর্দা করতে বাধ্য করলে শাস্তি হয় আর পর্দা করতে বাধা দিলে কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সব ক্ষেত্রে নিয়মের দোহাই দেওয়া হয়। ফলে ধর্মীয় কারণ কিংবা অন্য যে কোন কারণেই পর্দা কিংবা শালীন পোশাক পরতে গেলে প্রায় সময় বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হন অনেকে।
সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে। গত ২২ মে জামার হাতা লম্বা পরায় নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির অর্ধ শতাধিক ছাত্রীর জামার হাতা কেটে দেন স্কুলের ভাইস-প্রিন্সিপাল ও এক মন্ত্রীর স্ত্রী মাহবুবা খান কল্পনা। এই ঘটনার পর ছাত্রী ও অভিভাবকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ঘটনার সাথে জড়িতদের শাস্তি দাবি করলেও ঘটনার পরবর্তী তিনদিন কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। বরং স্কুলের প্রিন্সিপাল উম্মে সালেমা বেগম ভাইস-প্রিন্সিপালের পক্ষ নিয়ে ঘটনার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। অভিভাবকদের লাগাতার আন্দোলনের ফলে গতকাল উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর মাহবুবা খানম কল্পনাকে অব্যাহতি দিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা এটিই প্রথম নয় বরং এর আগে গত ২০১২ সালের ১ মার্চ উত্তরা রাজউক মডেল কলেজে বোরকা পরায় ছাত্রীকে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়। কলেজটির তৎকালীন অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার গোলাম হোসেন সরকার এই কাজ করেন। বোরকা সম্পর্কে সে সময় অধ্যক্ষ বলেন, মেয়েটি লম্বা পোশাক পরে আসা অড (দৃষ্টিকটু)। বোরকা পরে ক্লাসে আসার কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের তিন ছাত্রীকে ক্লাস রুম থেকে বের করে দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর শাইখুল ইসলাম মামুন জিয়াদ ওই তিন ছাত্রীকে শুধু বের করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি দম্ভক্তি দেখিয়ে বলেন যারা বোরকা পরে ক্লাসে আসবে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দরকার নেই। তারা কতবড় আন্দোলন করতে পারে তা দেখা যাবে। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও বিভিন্ন বিভাগের ক্লাস রুমে বোরকা পরা ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে নানারকম শ্রুতিকটূ মন্তব্য করেন তথাকথিত প্রগতিশীলতার দাবিদার শিক্ষকরা। বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রীরা অভিযোগ করেন, ক্লাসে প্রায় সময় শিক্ষকরা বোরকা পরা ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বানর, মধ্যযুগীয়, ভূত ইত্যাদি বলে গালাগালি পর্যন্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতে পরীক্ষার মার্কস থাকায় ভয়ে এর প্রতিবাদ কেউ করেন না বলে তারা জানিয়েছেন।
ছাত্রীদের বোরকা পরা কিংবা পর্দা করার নির্দেশ দিলে প্রায় সময় শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। গত ২০১০ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্ট নির্দেশ দেয় যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল বা কোনো সরকারি কার্যালয়ে বোরকা কিংবা ধর্মীয় পোশাক পরতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে (সুয়োমোটো) এসব আদেশ দেন। এর আগে একই বছরের ২ মার্চ হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ বোরকা না পরার কারণে কোনো মহিলা বা বালিকাকে গ্রেপ্তার বা নির্যাতন বা হয়রানি না করতে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ছাত্রীকে বোরকা পরতে বাধ্য করায় ২০১০ সালের আগস্ট মাসে নাটোরের সরকারি রানী ভবানী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হককে আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তার ওই কাজ কেন অবৈধ হবে না মর্মে রুল জারি করা হয়। মোজাম্মেল হক কলেজে যোগ দেওয়ার পর ছাত্রীদের বোরকা পরে আসার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ না মানায় অনেককেই কলেজে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শাস্তির বিধানের কারণে আর কোন প্রতিষ্ঠানে পর্দা কিংবা বোরকা পরার কথাও বলা হয় না। ওই সময় ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক আদালতে শুনানিকালে বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে। এ কারণেই দেশের সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ধর্মের লোক কর্মরত থাকেন। সেখানে বিশেষ ধর্মের পোশাক পরতে বাধ্য করা হলে অন্য ধর্মের যাঁরা আছেন, তাঁদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়। এ ছাড়া মুসলিমদের মধ্যে যাঁরা ধর্মীয় পোশাক পরতে ইচ্ছুক নন, তাদেরও ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়।
অভিভাবকরা বলেন, ওই সময় হাইকোর্ট স্বপ্রনোদিত হয়ে নির্দেশ দিয়েছিলো বোরকা পরতে বাধ্য করা হবে না। কিন্তু এখন উদয়ন স্কুলে ছাত্রীদের জামার হাতার পর তাহলে কেন আইন নয়। তারা বলেন, বোরকা পরতে বাধ্য করলে স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে যেসকল আইনজীবীরা মন্তব্য করেছিলেন তারা আজ কোথায়। তারা কি এখন কিছুই দেখছেন না?