বৃহস্পতিবার, মে ১৬, ২০২৪
প্রচ্ছদইন্টারভিউরমজানের প্রস্তুতি নেবেন যেভাবে

রমজানের প্রস্তুতি নেবেন যেভাবে

আমলের সওয়াব বহুগুণে বর্ধিত। মুমিনের মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে উন্নীত। পুণ্য জোয়ারে অন্তরাত্মা বিধৌত। জান্নাতের দুয়ার অবারিত। জাহান্নামের দুয়ার রুদ্ধ। শৃঙ্খলিত শয়তান। রহমতের দরিয়ায় আকাশচুম্বী ঢেউ। রাশি রাশি পাপ বিমোচিত। রহমত, মাগফিরাত ও মহামুক্তির আসমানি ওয়াদা। সহস্র মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ‘লাইলাতুল কদর’। এসব বৈশিষ্ট্যের অপূর্ব সমাহার মাহে রমজান। ইবাদতের ভরা মৌসুম। ঈমান নবায়নের এক মহা বিদ্যাপীঠ। চরিত্র মাধুর্যমণ্ডিত করার সময়। আত্মাকে শাণিত করার সময়। নাফসকে ইসলাহ করার সময়। কুপ্রবৃত্তিকে দমন করার সময়।
এই সুবর্ণ সুযোগ লুফে নিতে স্বয়ং স্রষ্টা মুমিনদের দিয়েছেন গভীর উত্সাহ। ইরশাদ হয়েছে—‘আর প্রতিযোগিতাকারীদের উচিত এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা করা’ (আল-মুতাফফিফিন : ২৬)। রাসুল (সা.) বলেন : ‘তোমরা সর্বদা ভালো কাজ কর। আর আল্লাহর অপার রহমতভরা বিশেষ বিশেষ সময়গুলোকে কাজে লাগাও।’ তবে সেজন্য প্রয়োজন সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
রমজান পাওয়ার জন্য দোয়া করা
নবী (সা.) রজব মাসের পদার্পণে এ দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের রজব ও শাবানে বরকত দাও। আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও।’ সাহাবারা ছয় মাস দোয়া করতেন রমজান পাওয়ার জন্য, আর বাকি ছয় মাস দোয়া করতেন আমল কবুল হওয়ার জন্য। তাই মুমিনের উচিত রমজান পাওয়ার জন্য প্রভু সমীপে প্রার্থনা করা।
আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাভরে আনত হওয়া
আল্লাহ তায়ালা আমাদের রমজানের মতো একটি সুমহান নিয়ামত দান করেছেন। সেজন্য আমাদের উচিত তাঁর প্রতি হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা, ভক্তি-অনুরাগ নিঃসরিত করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। শুকরিয়া দ্বারা নিয়ামত স্থায়ী ও বর্ধিত হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আজাব বড় কঠিন’ (সূরা ইব্রাহিম : ৭)। আর পাঁচটি উপাদান দ্বারা কৃতজ্ঞতা অর্থবহ হয় : ক. নিয়ামতের স্বীকৃতি; খ. নিয়ামতদাতার প্রশংসা; গ. নিয়ামতদাতার প্রতি ভালোবাসা; ঘ. নিয়ামতদাতার প্রতি আনুগত্য; ঙ. নিয়ামতদাতার নিয়ামতকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনে ব্যবহার করা।
আনন্দানুভূতির বহিঃপ্রকাশ
রমজান বিশ্বমানবতার জন্য আসমানি সুসংবাদ। তাই এ মাসের আগমনে আমাদের আচার-আচরণে, কথায়-কর্মে অনুপম আধ্যাত্মিক আনন্দানুভূতির বহিঃপ্রকাশ ও পরস্পরের মধ্যে এর আদান-প্রদান ঈমানের অপরিহার্য দাবি। আল্লাহর নিয়ামত পেয়েও আনন্দিত হয় না, মুমিন কি এমন হতে পারে? এদিকে ইঙ্গিত করেই ইরশাদ হয়েছে, “বলো, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়।’ এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম” (ইউনুস : ৫৮)।
রাসুল (সা.) সাহাবিদের এ মাসের সুসংবাদ দিতেন। এর প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানোর জন্য উত্সাহিত করতেন। তিনি বলতেন, ‘তোমাদের কাছে রমজান আগমন করেছে। পবিত্র মাস। আল্লাহ তোমাদের ওপর এর সিয়াম ফরজ করেছেন। এসময় জান্নাতের দুয়ারগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দুয়ারগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এ মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। এ মাসের মধ্যে এমন একটি রজনী আছে, যা সহস্র মাসের চেয়ে উত্তম। যে এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো, সে (সব কল্যাণ থেকে) বঞ্চিত হলো।’
হাফিজ ইবনি রাজাব বলেন, ‘কতিপয় আলেম বলেছেন, এই হাদিসটি রমজান মাস উপলক্ষে পরস্পরকে অভিনন্দন জানানোর প্রমাণ।’
সমাজ জীবনে সবার সঙ্গে সদ্ভাব প্রতিষ্ঠা করা
শাবান রমজানের প্রস্তুতির মাস। এ মাসের একটি অন্যতম পবিত্র রজনী হচ্ছে ১৫তম রজনী। এ রাত সম্পর্কে হাদিসে রয়েছে, ‘এ রাতে আল্লাহ তাঁর সব সৃষ্টির প্রতি তাকান। অতঃপর মুশরিক ও মুশাহিন (বিদ্বেষ পোষণকারী) ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সব পর্যায়ের মানবীয় সম্পর্ক সুসংহত ও উন্নয়নের মাধ্যমে রমজানকে বরণ করা এ হাদিসের একটি অন্যতম দাবি। এতে মন পবিত্র হয়। আর পবিত্র মনই আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের যোগ্য। আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং পরস্পরের মধ্যকার অবস্থা সংশোধন করে নাও’ (আনফাল : ১)।
বিশুদ্ধ নিয়ত ও দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ
‘আগামী রমজানে আমি সর্বশক্তি দিয়ে আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করব। অপরাধের সব ধরন-প্রকরণ, পথ-পদ্ধতি বর্জন করব।’ এখন থেকেই এরকম প্রতীজ্ঞাদীপ্ত অভিপ্রায় গ্রহণ করতে হবে। এই বিষয়টি মুমিন জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মানুষ জানে না সে কখন মারা যাবে? সত্যিই যদি আমরা জীবনের চূড়ান্ত সময়সীমা জানতাম, তাহলে মিথ্যা স্বপ্নের কুহেলিকায় ঘুরপাক খেতাম না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা পুণ্য ও পাপগুলো লিখে তা প্রকাশ করে দিয়েছেন। অতএব, যারা পুণ্য সাধনের সংকল্প করল কিন্তু তা করতে পারল না, আল্লাহ তাদের জন্য নিজের কাছে পরিপূর্ণ সওয়াব লিখে রাখবেন।’
জীবনধারার পুনর্বিন্যাস
রমজান মাসে করণীয় ইবাদতগুলোর সময়সূচি অনুযায়ী জীবনধারার পুনর্বিন্যাস করা। যাতে রমজান ও জীবন একাকার হয়ে যায়। আন্তঃবিরোধের অবসান ঘটে।
খাঁটি তওবা করা
গুনাহ থেকে তওবা করা সর্বাবস্থায়ই ফরজ। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’ (আননূর : ৩১)। কিন্তু রমজানের প্রাক্কালে এর অপরিহার্যতা আরও বৃদ্ধি পায়। কারণ গুনাহ মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ফলে সে ইবাদতের স্বাদ পায় না। ইবাদতের নির্মল সৌন্দর্য তাকে স্পর্শ করে না। বিশেষ করে হারাম উপার্জন থেকে তওবা করার এখনই মোক্ষম সময়। হারাম ভক্ষণকারীর দোয়া ও ইবাদত কবুল হয় না। এ ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেন, ‘… সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কীভাবে কবুল হবে!’
টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, জাতীয় অর্থ লোপাট, ধোঁকা-প্রতারণা, মজুতদারি, কৃত্রিমভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, মিথ্যা মামলা-গ্রেফতার, রিমান্ড, ভর্তি ও চাকরি বাণিজ্য ইত্যাদি উপায়ে অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়ে যারা কালো টাকা সাদা করার কথা ভাবছে, তাদের জন্য রমজানপূর্ব এই সময় তওবা করার সর্বোত্তম সুযোগ। প্রাপকদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে সততা ও হালাল উপার্জনের পথে ফিরে আসার এখনই সময়। বসন্তকালেও যদি গাছে ফুল না ফোটে, তাহলে কখন আর ফুটবে?
সিয়াম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন
এর মাধ্যমে সিয়াম সাধনা হবে বিশুদ্ধ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য। মুসলিম তার দ্বীন সম্পর্কে থাকবে সম্যক জ্ঞানের অধিকারী, এমনটিই ইসলামের নির্দেশনা। বিশেষ করে ফরজ দায়িত্ব। কারণ মূর্খতা ও অজ্ঞতার দোহাই দিয়ে এ দায়িত্ব থেকে বাঁচার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য ইরশাদ হয়েছে : ‘তোমরা যদি না জানো, তাহলে যারা জানে তাদের জিজ্ঞাসা কর’ (আন-নাহল : ৪৩)।
বিশেষ বিশেষ কাজের অভ্যাস গড়ে তোলা
ক. শাবানের সিয়াম : যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ পূর্ণাঙ্গ নৈপুণ্যের সঙ্গে সম্পাদন করার লক্ষ্যে আগে থেকেই এর অনুশীলন করতে হয়। এ কারণেই রাসুল (সা.) শাবানের রোজা রাখতেন।
খ. রাত জেগে নামাজ পড়া : রমজানের আগে থেকেই রাত জেগে নামাজ পড়ার কিছু কিছু অভ্যাস গড়তে পারলে রহমতের মৌসুমে তা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এজন্যই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কিয়ামুল লাইল কর। কারণ এটি তোমাদের পূর্ববর্তী পুণ্যবানদের অভ্যাস। আল্লাহর সান্নিধ্য। অপরাধ থেকে নিবৃত্তি। গুনাহের জন্য কাফফারা। দেহ থেকে রোগ অপসারণকারী।’
গ. কোরআন তিলাওয়াতের অভ্যাস : রমজান কোরআনের মাস। তাই রমজানের মাহাত্ম্য অর্জনে কোরআনের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। ইমাম ইবনে রজব আল-হাম্বলী বলেন, ‘শাবান যেহেতু রমজানের ভূমিকাস্বরূপ, তাই রমজানে যা কিছু শরিয়তসিদ্ধ, শাবানেও তা-ই শরিয়তসিদ্ধ। যেমন, সিয়াম, কোরআন তিলাওয়াত। যাতে রমজানকে গ্রহণ করে নেয়ার প্রস্তুতি অর্জিত হয়। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি নাফস বশীভূত হয়। হজরত আনাস (রা.) বলেন, শাবান মাসের আগমন হলেই মুসলমানরা কোরআন নিয়ে ব্যাপৃত হয়ে পড়ত। কোরআন পাঠ ও চর্চা করত। মালের জাকাত বের করত। দুর্বল ও মিসকিনরা যেন রমজানের সিয়াম পালন করার সামর্থ্য লাভ করতে পারে।’ সাহাবি-তাবেয়িদের যুগে শাবানকে বলা হতো শাহরুল কুররা অর্থাত্ কোরআন তিলাওয়াত ও চর্চাকারীদের মাস।
ঘ. ওয়াজিবগুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ : যেমন, জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়। এতে রমজানে জামাত ছুটে যাওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
মুহাসাবাতুন নাফস
আত্মসংশোধনের চলমান প্রক্রিয়ার নাম ইসলামের ভাষায় মুহাসাবাতুন নাফস। এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আর প্রত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা সে আগামীকালের জন্য কী প্রেরণ করেছে; তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত’ (সূরা আল-হাশর : ১৮) । রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রকৃত বুদ্ধিমান সে ব্যক্তি, যে আত্মপর্যালোচনা করে…।’
এজন্য মুমিনের উচিত রমজানের আগেই আত্মপর্যালোচনার মধ্যে অতীত ভুল-ত্রুটির আলোকে আগামীকে সংশোধিত করার চেষ্টা করা।
মোট কথা, অতীতের সব গ্লানি, পাপাচারের কালিমা ও ব্যর্থতার পিছুটান থেকে মুক্ত হয়ে এক নতুন জীবনধারা গড়তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবার সঙ্গে সম্পর্কের নতুন পাতা খুলতে হবে। নতুন পাতা আল্লাহর সঙ্গে, তাঁর আনুগত্যের শপথ নিয়ে, নাফরমানি বর্জনের ঘোষণা দিয়ে। নতুন পেইজ রাসুলের সঙ্গে। তাঁর আদর্শ ধারণের মাধ্যমে। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে। প্রত্যেকের হক যথার্থভাবে আদায় করে। সব মুসলমানের সঙ্গে। ন্যায়ানুগ আচরণ ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে। তাহলেই রমজানের কল্যাণ অর্জন সহজ ও সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ। অন্যথায় রমজানের প্রস্তুতির নামে বেশি বেশি খাদ্যপণ্য মজুত করে নিজেদের ধোঁকার কোনো অর্থ নেই। হ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ