শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪
প্রচ্ছদইন্টারভিউচলছে না এলজিআরডি মন্ত্রণালয়: এই মেয়াদে একদিন অফিসে গেলেন সৈয়দ আশরাফ

চলছে না এলজিআরডি মন্ত্রণালয়: এই মেয়াদে একদিন অফিসে গেলেন সৈয়দ আশরাফ

ষ্টাফ  রিপোর্টার  (বিডিসময়২৪ডটকম)

তিনি দ্বিতীয়বারের মতো মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন ১২ জানুয়ারি। ১৩ জানুয়ারি গিয়েছিলেন সচিবালয়ের নিজ দফতরে। সাক্ষাৎ করেছেন সচিবসহ মন্ত্রণালয়ের সব দফতর ও অধিদফতরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে। ফুলেল শুভেচ্ছা বিনিময়। সংবর্ধনা গ্রহণ। সবার উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য। তারপর সেই যে গেলেন মন্ত্রণালয় থেকে আর তার দেখা নেই গত প্রায় দুই মাসে।

মহাজোট সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদেও তিনি দফতরে গিয়েছিলেন মাত্র ২০ থেকে ২৫ দিন। তিনি হচ্ছেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি এখন মিন্টো রোডে মন্ত্রীপাড়ার সরকারি বাসভবনেই কাটান দিন-রাতের অধিকাংশ সময়। মন্ত্রী অফিসে না গেলেও সমস্যা নেই। অফিসের কাজ চালান এপিএস এ এম কাজী সেলিম খান। এপিএসে বন্দী তার সব কর্মকাণ্ড। আর সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে আটকে আছে মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকাণ্ড। ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়ন কাজ। খুব জরুরি নথিপত্র থাকলে তাতে বিশেষ ব্যবস্থায় মন্ত্রীর স্বাক্ষর নেওয়া হয়। সে কাজটাও করেন তার এপিএস।মন্ত্রীর একান্ত সচিবের (পিএস) ভূমিকা এখন গৌণ।

গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রী আর দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দেখা পান না মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। এমনকি তার নির্বাচনী এলাকা থেকে লোকজন কোনো কাজে এলেও মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। গতকাল সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

মন্ত্রীর এই অনুপস্থিতির বিষয়টিকে সঠিক মনে করেন না সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি  বলেন, মন্ত্রী হিসেবে তিনি শপথ নিয়েছেন দায়িত্ব পালনের জন্য। তিনি মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী। তাকে প্রত্যেক কর্মদিবসেই দফতরে থাকা উচিত। তার অনুপস্থিতিতে অবশ্যই দাফতরিক কাজের ব্যাঘাত ঘটে। যদি মন্ত্রী অসুস্থ থাকেন, কিংবা দলের জরুরি কাজে, কোনো অনুষ্ঠানে অথবা বিদেশে থাকেন তাহলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। দেশে থাকলে তাকে অবশ্যই মন্ত্রণালয়ে অফিস করা উচিত।এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেনসি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গতকাল  বলেন, মন্ত্রীর অনুপস্থিতির বিষয়টি একটা রহস্যময় ব্যাপার। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। আমরা সব সময় দেখে আসছি দলের সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিবকে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটার মধ্যে স্ববিরোধিতা কাজ করছে। দলের শীর্ষ একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, অথচ তিনি দফতরে না গিয়ে কীভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে সরকার বা মন্ত্রীর নিজের একটা ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, মন্ত্রণালয়ে নির্বাহী প্রধানের অনুপস্থিতিতে যেমন জবাবদিহিহীনতার জায়গা প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি তিনি কীভাবে অনুপস্থিত থাকেন সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ।

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একাধারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী। গত মহাজোট সরকারের সময়ও তিনি একই দায়িত্ব পালন করেছিলেন দলে এবং সরকারে। ওই সময়ে পাঁচ বছরে তিনি সচিবালয়ে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন গড়ে ২০ থেকে ২৫ দিন। মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, গত মেয়াদে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রথম তিন-চার মাস মাঝে মাঝে মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত থেকে কাজ করতেন। কিন্তু হঠাৎ করে মন্ত্রণালয় থেকে গায়েব হয়ে যান মন্ত্রী।

মহাজোট সরকারের প্রথম তিন-চার মাস বাদ দিলে বাকি সময়টুকুতে আর তেমন একটা সচিবালয়ে যাননি মন্ত্রী। এর ফলে গত পাঁচ বছরে বড় ধরনের শূন্যতাও সৃষ্টি হয় গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়ে। যার ফলে মাঠ পর্যায় থেকে দলীয় সংসদ সদস্য এবং দলের জেলা পর্যায়ের নেতারা ঢাকায় মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিজের এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কথা বলতে চাইলেও মন্ত্রীর দেখা পেতেন না। একই অবস্থা নতুন সরকার গঠনের পরও বিদ্যমান। যার ফলে মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর অনুপস্থিতি আর মাঠ পর্যায়ের নেতাদের দেখা করতে না পারার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-দলীয় প্রার্থীদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও এ কথা স্বীকার করেন। এই মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব বলেন, মন্ত্রীর সঙ্গে আমার তেমন দেখা হতো না।

দায়িত্বশীল মহলের মতে, স্থানীয় পর্যায়ে গণমানুষকেন্দ্রিক উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় হচ্ছে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে ব্যাপক উন্নয়ন হয়। বিশেষ করে গ্রামীণ রাস্তাঘাটের উন্নয়নে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন সেই রাস্তাঘাটের অবস্থাই সবচেয়ে বেহাল। মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) নিজের ইচ্ছামতো ও পছন্দের কিছু এলাকায় কাজ করালেও সারা দেশের দিকে তাদের নজর নেই।

যার ফলে গত পাঁচ বছরে অধিকাংশ এলাকা উন্নয়ন-বঞ্চনার শিকার। এখনো একই অবস্থা বিরাজমান।  এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকারি দল। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত মেয়াদে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনিই মন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে নেতা-কর্মীদের সামাল দিতেন। যার ফলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মন্ত্রীর অনুপস্থিতিটা টের পেতেন না। কিন্তু এবার সরকার গঠনের পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকাণ্ডই যেন থমকে আছে। জরুরি অনেক ফাইলই মন্ত্রীর অনুমোদন কিংবা স্বাক্ষরের অপেক্ষায় পড়ে আছে।জানা গেছে, এবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল দায়িত্ব পালন করলেও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে জাতীয় পার্টির মসিউর রহমান রাঙ্গা শুধু পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন।

একটি সূত্র জানায়, প্রতিমন্ত্রীকে বলে দেওয়া হয়েছে যে, তার বিভাগের জরুরি নথিতে তিনিই যেন স্বাক্ষর করে দেন। খুব জরুরি না হলে মন্ত্রীর কাছে পাঠানোর প্রয়োজন নেই। মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানান, শপথ নেওয়ার পরদিন মন্ত্রীর দেখা পেয়েছিলেন। তারপর গত এক মাস ১৮ দিনে মন্ত্রীর চেহারা দেখার সুযোগ হয়নি। তিনি অনেকটাই সোনার হরিণ। এককথায় মন্ত্রী দফতর বিচ্ছিন্ন।

মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুব জরুরি কাজ না হলে কোনো কর্মকর্তাই যান না মন্ত্রীর বাসভবনে। মন্ত্রীর অনুপস্থিতির কারণে মন্ত্রণালয়ে ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ কাজই সচিব পর্যায়ে সম্পন্ন করা হয়।অবশ্য স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন গতকাল  বলেন, জরুরি কোনো কাজ হলে নথি মন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেই। মন্ত্রীর এপিএস তাতে স্বাক্ষর করিয়ে দেন। তিনি বলেন, আমরা সব নথিই মন্ত্রীর বাসায় পাঠাই। সেগুলোতে তিনি স্বাক্ষর করেন। কাজে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ