সোমবার, মে ৬, ২০২৪
প্রচ্ছদটপ২০ দলীয় জোট ছাড়ল জামায়াত! প্রার্থী দেবে ৩০০ আসনেই

২০ দলীয় জোট ছাড়ল জামায়াত! প্রার্থী দেবে ৩০০ আসনেই

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামির মধ্যকার রাজনৈতিক সম্পর্ক এখন আর নেই বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে দীর্ঘদিনের টানাপড়েনের পর ২০ দলীয় জোটের শরিক এই দুটি দল এখন আর একমঞ্চে রাজনীতি করতে চাইছে না। নীতিগতভাবে তারা এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিলেও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। সম্প্রতি জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের দেয়া এক ভিডিও বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে টানাপড়েনের সম্পর্ক গড়ে উঠে।

বিএনপি নেতারা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার দাবি জানানো হচ্ছে। প্রায় ১ বছর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে অধিকাংশ সদস্য জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার বিষয়ে তাদের মতামত জানান। নানা কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে এতদিন সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি বিএনপি। তবে এটা ঠিক যে, এরই মধ্যে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।

জামায়াত বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করার খবর সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, জামাতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা আর কোনো জোটে থাকবে না। তবে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।

২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান জানিয়েছেন, ‘আমি জামায়াতের আমিরের বক্তব্য শুনিনি। জামায়াতের জোট ছাড়ার খবর সম্পর্কে আমি কিছু জানি না।

সম্প্রতি এক ভিডিও বক্তব্যে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেন, আমরা এতদিন একটি জোটের সঙ্গে ছিলাম। আপনারা শুনে হয়ত ভাবছেন কিছু হয়ে গেছে নাকি? হ্যাঁ হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ জোট দেশের জন্য ছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের পর থেকে এই জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে এবং সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়েছে। তারপর সেটা আর ফিরে আসেনি। তিনি আরও বলেন, আমরা বহু চিন্তা করেছি, বাংলাদেশের জন্য এই জোটে আর উপকারি কিছু নেই। এই জোটের সঙ্গে বিভিন্ন দল যারা আছে, বিশেষ করে প্রধান দলের এই জোটকে কার্যকর করার কোনো চিন্তা নেই। শফিকুর রহমান বলেন, এখন বাস্তবতা হচ্ছে নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর ওপর ভর করে পথচলা। জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করব। এটা নিয়ে আমরা বিএনপির সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি। তারা একমত পোষণ করেছে। আর কোনো জোট করবে না। জোটের বাস্তবতাও নেই। তিনি আরও বলেন, এখন যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। যদি আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করেন তাহলে আমাদের আগামী দিনগুলোতে কঠিন প্রস্তুতি নিতে হবে। অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। দোয়া করেন, এসব ত্যাগ যেন আল্লাহর দরবারে মঙ্গলজনক হয়। এ ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ পাক যেন আমাদের পবিত্র একটি দেশ দান করেন, যে দেশটা কোরআনের আইনে পরিচালিত হবে। এদিকে রাজনীতিতে আরেকটি নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে সেটি হচ্ছে, জামায়াতের সঙ্গে সংলাপ নয়, সিপিবি-বাসদের সঙ্গে জোট করার অপেক্ষায় থাকবে বিএনপি।

জামায়াতের বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করা প্রসঙ্গে জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান জানিয়েছেন, ২০ দলীয় জোট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আমরা দিইনি। এ জাতীয় কোনো বক্তব্য আমাদের দলের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি। তাহলে জামায়াতের আমিরের বক্তব্য কি তার ব্যক্তিগত কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জোট ছাড়তে হলেও তো দলের সভা বা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হয়। কিন্তু দলের মধ্যে এ ধরনের কোনো সভা বা আলোচনা হয়নি। ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় জামায়াতের এক নেতার ‘২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পুরানা পল্টনে জামায়াতের সমাবেশে হামলা ও দলটির অনুসারী কয়েকজনের মৃত্যুর জন্য বিএনপি দায়ী’ এমন বক্তব্যের প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এই জামায়াত বাংলাদেশকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। এসবই জামায়াতের ফাজলামি। তার এই বক্তব্যের পর জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের কথার বাহাস চলে। এরপর ২০২২ সালের ২ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপির প্রতীকী অনশন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মারধরের শিকার হয় জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুলসহ কয়েকজন কর্মী। এরপর থেকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব আরও বাড়ে। যার ফলে জামায়াতের আমির জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন।

১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটকে সঙ্গে নিয়ে ‘চারদলীয় জোট’ গঠন করেছিল বিএনপি। পরে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি জোট থেকে বের হয়ে গেলেও যুক্ত হয় নাজিউর রহমান মঞ্জুর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। পরে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল নতুন ১২টি দলের সংযুক্তির মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা চারদলীয় জোট কলেবর বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ দলীয় জোটে। এরপর জোটের পরিধি দাঁড়ায় ২০ দলে।

৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে জামায়াত

এদিকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। নিবন্ধন বাতিল হওয়া দলটি এক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেবে। আর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগেই ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করবে দলটি। এজন্য দলের পক্ষ থেকে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। জামায়াতের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সামনের নির্বাচনে তাদের ২০ দলীয় জোটে না থাকার বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত। তবে কৌশলগত কারণে এখনই জোট ভাঙার ঘোষণা দিচ্ছে না। জামায়াত নেতারা মনে করেন, বিএনপির পক্ষ থেকে যে অবমূল্যায়ন হচ্ছে, তা আরও গাঢ় হলে বিভাজনটা স্পষ্ট করা সহজ হবে।

স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গাঁটছড়া বেঁধেছিল জামায়াত-বিএনপি জোট। আলাদা হলেও আওয়ামী লীগ আর বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন দুই জোটের যুগপৎ আন্দোলনেই পতন ঘটে এরশাদের। সংখ্যায় কম অথচ জামায়াতের ভোটে ভর করেই ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করে বিএনপি। ফিরে আসে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চারদলীয় জোট করে ফের ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত।

রাজনীতির এই মেরুকরণের তিন দশক পার হয়েছে। রাজনীতির পালাও বদলেছে অনেক। এই পালাবদলে সবচেয়ে বেকায়দায় আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতাকারী সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। প্রতিষ্ঠার পর এমন কোণঠাসায় আর পড়তে দেখা যায়নি দলটিকে। বিএনপির ঘাড়ে ভর করে মন্ত্রী বনে গেলেও জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী শীর্ষ নেতাদের শেষ রক্ষা হয়নি। দল হিসেবেও এখন অপরাধী জামায়াত। ভেঙে দেয়া হয়েছে জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামো। নিবন্ধন বাতিল হয়েছে বেশ কয়েক বছর হলো। দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরও সবচেয়ে বিপর্যস্ত সময় পার করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত শিবির এখন রাজনীতি করছে গোপনে। ঢাকা মহানগর জামায়াতের শীর্ষ স্থানীয় একজন নেতা বলেন, ‘জামায়াত ৩০০ আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা এককভাবেই বেশি নির্বাচন করে আসছি। তাছাড়া জোট তো আসলে চিরস্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নয়।’

২০ দলীয় জোটে গুরুত্ব বাড়াতে বা দরকষাকষির জন্য এমন ঘোষণা হতে পারে কি না- উত্তরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমাদের গুরুত্ব কী, তা সবাই জানেন। জোটের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বিষয় নয়। জামায়াত দেশের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কি না সেটিই মুখ্য বিষয়।’ জামায়াত প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘জামায়াতের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমরা মতামত দিতে পারি না। তবে এ নিয়ে জোটের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি এখনো।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ