মঙ্গলবার, মে ৭, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়অর্থনীতি পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১...

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পেশ

চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে বিশাল ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের প্রত্যাশা দেখেছেন অর্থমন্ত্রী। এমনকি করোনা সংকট কেটে গিয়ে দেশে অর্থনীতি আবারও ঘুরে দাঁড়াবে স্বমহিমায়। বর্তমান পরিস্থিতি বেশি দিন থাকবে না।

দেশ স্বাভাবিক হলে আবারও বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদী তিনি। 

করোনা সংকটে জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ শিরোনামে ০৩ জুন বেলা ৩টায় জাতীয় সংসদে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট এটি। এবারের বাজেট মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

আর চলতি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন বাজেটের আকার বাড়ছে ৬৪ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। এটি হবে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট এবং বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট ও বর্তমান অর্থমন্ত্রীর তৃতীয় বাজেট। 

রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা
বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে সরকারের মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে যা ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় বা অনুন্নয়ন ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। করোনা মহামারির ফলে সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়েছে। চলতি বছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। সে তুলনায় আসছে বছরে পরিচালন ব্যয় বাড়বে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর আবর্তক ব্যয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় ধরা হচ্ছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ধরা হচ্ছে ছয় হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।

এডিপি
বাজেটে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি ৯ লাখ টাকার ব্যয় সম্বলিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৬১ হাজার ৬৩১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে বিদ্যুৎ খাত।

অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের এডিপির সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৬১ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা, যা মোট এডিপির ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এরপরেই বিদ্যুৎখাতে গুরুত্ব দিয়ে ৪৫ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরপর গৃহায়ণ খাতে ২৩ হাজার ৪২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নতুন এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে চতুর্থ স্থানে শিক্ষা খাতে ২৩ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যা মোট এডিপির ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ।

বাজেটে আয়
আগামী বাজেটে ব্যয়ের বিপরীতে মোট আয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে আয় বাড়ছে ১১ হাজার কোটি টাকা। মোট আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরেও এনবিআরকে একই পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া রয়েছে।

প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি
বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি বাজেটে প্রবৃদ্ধির এই হার ধরা হয় ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের মোট জিডিপির আকার ধরা হচ্ছে ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এদিকে করোনার কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে মানুষের হাতে টাকার সরবরাহও কমেছে। যার যার ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয়ই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আসছে বছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

ঘাটতি
উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত ঘাটতি বাজেট দিয়ে থাকে। বাংলাদেশও প্রতি অর্থবছর ঘাটতি বাজেট দেয়। করোনা ভাইরাসের কারণে এই ঘাটতি এবার সব সীমা অতিক্রম করছে। আগামী বাজেটে ঘাটতি ধরা হচ্ছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি বাজেটে তা ৬ দশমিক ১ শতাংশ।

যে সব পণ্যের দাম কমতে পারে
এবারের বাজেটে কিছু পণ্যের ভ্যাট, আমদানি শুল্ক, আগাম কর অথবা সম্পূরক শুল্কে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে কোভিড-১৯ টেস্ট কিট, পিপিই এবং ভ্যাকসিন, তাজা ফল, মুড়ি, ক্রোকারিজ সামগ্রী, হাইব্রিড গাড়ি এসব পণ্যের দাম কমতে পারে।

প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন ইউডার (নিড়ানি) ও উইনোয়ারের (ঝাড়াইকল) উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ের ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে থ্রেসার মেশিন, পাওয়ার রিপার, পাওয়ার টিলার, অপারেটেড সিডার, কম্বাইন হারভেস্টর, রোটারি টিলার, নিড়ানি ও ঝাড়াইকলের আমদানি পর্যায়ের আগাম কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম কমতে পারে।

দাম বাড়তে পারে যে সব পণ্যের
২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শুল্ক-কর বাড়ানোর ফলে এসব পণ্যের বাড়তে পারে।

মোবাইল: দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে আমদানিকৃত মোবাইলের ওপর শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ করা হয়েছে। তবে যেসব ফোন দেশে উৎপাদন হয় না, সেসবের দাম বাড়তে পারে। এ তালিকায় আইফোন ও স্যামসাংয়ের প্রিমিয়াম ফোন রয়েছে।

এছাড়া মদ-বিয়ার, সুগন্ধি সিগারেট, থিম পার্কের রাইড, বিদেশি সবজি, প্রক্রিয়াজাত মাংস, গাড়ির সুরক্ষা কাঁচ, টয়লেটের কমোডের দাম বাড়বে।

করোনা মোকাবিলায় থোক বরাদ্দ:
এবারও করোনা মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক উৎস আসবে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস হতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস ব্যাংক ব্যবস্থা হতে সংগৃহীত হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থেকে আসবে ৩৭ হাজার ১ কোটি টাকা। বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা।

ভ্যাট ফাঁকির জরিমানা কমানোর প্রস্তাব
ভ্যাট ফাঁকি, ব্যর্থতা বা অনিয়মের ক্ষেত্রে আরোপিত জরিমানার পরিমাণ জড়িত রাজস্বের ‘দ্বিগুণের’ পরিবর্তে ‘সমপরিমাণ’ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পাশাপাশি বকেয়া ভ্যাটের ওপর মাসিক সুদের হার ‘২ শতাংশের পরিবর্তে ১ শতাংশ’ করার প্রস্তাব করেছেন। এ ক্ষেত্রে বার্ষিক সুদের হার ২৪ শতাংশের পরিবর্তে ১২ শতাংশ নির্ধারিত হবে।

বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে কর দিতে হবে
২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।

১০টি মেগা প্রকল্প:
প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্পকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে একক প্রকল্পে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে। এ প্রকল্পে ১৮ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে বাজেটে। ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টে (মেট্রোরেল) ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া মাতারবাড়ি ১২শ’ মেগাওয়াট আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পে ৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে ৫ হাজার ৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পদ্মাসেতু রেল লিংক প্রকল্পে ৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এক্সপানশন অ্যান্ড স্ট্রেনদেনিং অব পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্ক আন্ডার ডিপিডিসি এরিয়া প্রকল্পে ৩ হাজার ৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পে বরাদ্দ থাকছে ২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পে ৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ