রবিবার, মে ১৯, ২০২৪
প্রচ্ছদইন্টারভিউ দুর্গাপূজা : চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি

দুর্গাপূজা : চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি

ডেস্ক রিপোর্ট (বিডি সময় ২৪ ডটকম)

আগামী ১০ অক্টোবর থেকে ৫দিন ব্যাপী হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হতে যাচ্ছে। ধর্মীয় এ উৎসবকে ঘিরে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে এখন বইছে আনন্দের জোয়ার। তাদের মধ্যে লেগেছে প্রাণের ছোঁয়া। সৃষ্টি হয়েছে এক আনন্দমুখর পরিবেশের।

চারদিক আনন্দময়ীর আগমনী সুরে অনুরণিত। ঘরের বউ-ঝিরা নারিকেলের নাড়ু, মুড়ি, চিড়া, খইয়ের মোয়া, সন্দেশসহ বিভিন্ন উপচার বানানোর কাজে ব্যস্ত। অন্যদিকে পূজা উপলক্ষে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা নতুন পোশাক পড়ার আনন্দে আত্মহারা। রাজধানীসহ দেশের প্রত্যেক মার্কেটেই রয়েছে কেনা কাটার বেশ ভিড়।

দেশব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করা হবে এ উৎসব। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি মন্দিরে চলছে বর্ণাঢ্য আয়োজনের শেষ প্রস্তুতি।

সরেজমিনে রাজধানীর বেশ কয়েকটি পূজা মণ্ডপগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে প্রতিমা প্রতিস্থাপন, প্যান্ডেল সাজানো এবং সুষ্ঠু ও যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পূজা উৎযাপন কমিটির লোকজনদের মহাব্যস্ত সময় কাটছে। মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুর শুধু আনন্দ-উৎসবমুখর পরিবেশে পূজার আয়োজন দেখা গেছে। কোথাও কোথাও ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি নতুনত্ব আনার প্রচেষ্টা ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিমা, প্যান্ডেল, সাজসজ্জা কিংবা অন্যান্য আয়োজনে ব্যতিক্রমের ছোঁয়াও রয়েছে। সব মিলিয়ে পূজার আয়োজনে এখন মুখর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা:
এদিকে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও রয়েছে এ উৎসবকে ঘিরে প্রচুর ব্যস্ত। পূজা উদযাপনে সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারসহ উৎসবমুখর পরিবেশ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপনের জন্য তারা নিয়েছেন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রাজধানীতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য মণ্ডপগুলোর নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবেন।

এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার গত ২ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, একই সময়ে ঈদুল আযহা ও শারদীয় দুর্গা উৎসব শুরু হওয়ার এটা পুলিশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তাই রাজধানী জুড়ে সবোর্চ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ৪ অক্টোবর থেকে ঈদ পরবর্তী সময় পর্যন্ত এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

তিনি আরো জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। তাই পূজা মণ্ডপে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে অন্যান্য ধর্মের লোকজন আসবে। তাই পূজা মণ্ডপের আয়োজকদের নারী-পুরুষের জন্য আলাদা ব্যবস্থার রাখার কথা বলা হয়েছে। নারীদের যাকে কেউ উত্ত্যক্ত করতে না পারে সে জন্য পূজা আয়োজকদের আলাদা বলান্টিয়ার রাখার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া পুলিশের নিজস্ব ব্যবস্থাও থাকবে। নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রত্যেকটি পূঁজা মণ্ডপে আয়োজকদের সিসি ক্যামেরা স্থাপনের নির্দেশ দেয়ার কথাও জানান তিনি।

দেবীর আগমন ও প্রস্থান:
এবার দেবী দুর্গা দোলায় (পালকি) করে শ্বশুরবাড়ি কৈলাস থেকে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসবেন। আর ফিরে যাবেন গজে (হাতিতে) করে। ১০ অক্টোবর ষষ্ঠী পূজার (দেবী দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস) মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে ৫দিন চলার পর ১৬  অক্টোবর দশমীর (প্রতীমা বির্সজন) মধ্য দিয়ে শেষ হবে।

ষষ্ঠীর দিন মাতৃরূপে দেবী দুর্গা পূজা মণ্ডপে আগমন করবেন। সঙ্গে আসবেন তাঁর চার সন্তান। তাঁরা হচ্ছেন জ্ঞানের প্রতীক দেবী সরস্বতী, ধন ও ঐশ্বর্যের প্রতীক দেবী লক্ষ্মী, সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং বলবীর্য ও পৌরুষের প্রতীক কার্তিক। বছর বাদে মেয়ে আসছেন বাপের বাড়ি তাই মেয়েকে বরণ করতে আয়োজনেরও যেন কমতি নেই। ইতোমধ্যেই প্রায় শেষ হয়েছে ৫ দিনব্যাপী এ পূজার সব প্রস্তুতি।

এবারের পূজার সংখ্যা:
পূজা উদযাপন কমিটি সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে এ বছর প্রায় ২৮-২৯ হাজার পূজা মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা মহানগরীতে এ বছর ২০৬টি মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। প্রতি বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও পূজা মণ্ডপের সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় রাজধানীতে এবার বেড়েছে ৪টি। বিভিন্ন মন্দির, পূজা কমিটির পাশাপাশি  কোথাও কোথাও পারিবারিকভাবেও পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

এবার সূত্রাপুর ও ওয়ারিতে সবচেয়ে বেশি (৩৬টি) পূজা উদযাপিত হবে। এরপরের স্থান রয়েছে কোতয়ালীতে। এখানে প্রায় ২০টি পূজা উদযাপন হবে। গেণ্ডারিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে ১৩টি, তুরাগে ১১টি, হাজারীবাগে ৮টি, বাড্ডায় ১০টি, গুলশান ও বনানীতে ৫টি, মতিঝিলে ২টি, চকবাজারে ৫টি, লালবাগে ৪টি, বংশালে ২টি, কদমতলীতে ৭টি, শ্যামপুরে ৬টি, ডেমরায় ৮টি, যাত্রাবাড়িতে ৮টি, সবুজবাগে ৫টি, খিলক্ষেতে ৪টি, শাহবাগে ২টি, রমনায় ২টি, তেজগাঁওয়ে ৫টি, ধানমণ্ডিতে ৩টি, মোহাম্মদপুরে ৮টি, দারুসসালামে ৮টি, পল্লবীতে ৪টি, উত্তরায় ২টি, রামপুরা, খিলগাঁও, উত্তরখান, কাফরুল, মিরপুর ও শাহআলীতে ১টি করে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া রাজধানীর অন্যান্য স্থানেও আরো প্রায় ১০ থেকে ১২টি পূজা অনুষ্ঠিত হবে জানা গেছে।

প্রধান কয়েকটি পূজা মণ্ডপ:
রাজধানীর প্রধান প্রধান পূজা মণ্ডপগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির  কেন্দ্রীয় পূজা মণ্ডপ, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন, রমনা কালীমন্দির, গুলশান পূজা উদযাপন কমিটি, ধানমন্ডি কলাবাগান মাঠ, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, বাংলাবাজার পূজা কমিটি, নর্থব্রুক হল রোড, প্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁতীবাজার পূজা কমিটি, শঙ্ঘমিত্র শাঁখারীবাজার, পাণিটোলা, বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির ও শ্মশান কমিটি, হাজারীবাগ সুইপার কলোনি, গৌতম মন্দির, স্বামীবাগ লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম, ভোলাগিরি আশ্রম, হিন্দুপাড়া এজিবি কলোনির অরুনিমা সংসদ পূজা কমিটি, বৃহত্তর মিরপুর সার্বজনীন পূজা উদযাপন পরিষদ, বাসাবো বালুর মাঠ, নিমতলীর রায়ের বাজারের শিব মন্দির, সিটি কলোনীর দুর্গা মন্দির ইত্যাদি।

পূজাম-পগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, ইতিমধ্যে প্রতিমার মাটির কাঠামোর কাজ  শেষ করে রঙের প্রলেপ ও অন্য সাজসজ্জার কাজ চালানো হচ্ছে।

কুমারী পূজা:
রাজধানীর গোপীবাগের রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের পূজা মণ্ডপে এবারও ব্যতিক্রমী আয়োজন হিসেবে থাকছে কুমারী পূজা। মহাষ্টমীর দিন সকালে এ কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য দেবী দুর্গার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে অল্প বয়সী একটি মেয়েকে কুমারী হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। তবে প্রথা ও নিরাপত্তার কারণে মেয়েটির নাম ও পরিচয় পূজা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয় না।

উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পূজা মণ্ডপের বিবরণ:
গুলশান-বনানী সার্বজনীন পূজা উদযাপন পরিষদ আয়োজিত বনানী মাঠের পূজা মণ্ডপের পূজাটি এবার ষষ্ঠ বর্ষে পড়েছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর  থেকে এ এলাকায় কোনো দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়নি। পরে গুলশান, বারিধারা, বনানী ও ডিওএইচএসের হিন্দু বাসিন্দাদের উদ্যোগে ২০০৮ সাল থেকে এখানে পূজা শুরু হয়। এখানে ২০ হাজার বর্গফুটের বিশাল প্যান্ডেলের পাশাপাশি আকর্ষণীয় পূজা মণ্ডপ, প্রতিমা ও অন্যান্য সাজসজ্জা থাকছে। প্রতিদিনকার পূজার্চনা, আরতি প্রতিযোগিতা ও প্রসাদ বিতরণ ছাড়াও পূজার ৫ দিনই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে। প্রতি বছরের মতো এবারও বিপুলসংখ্যক পূজারি, ভক্ত ও দর্শনার্থীর সমাগম আশা করছেন আয়োজকরা।

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পূজা মণ্ডপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল মন্দিরকে পূজা উপলক্ষে বর্ণিল সাজে সাজানো হচ্ছে। মণ্ডপ ঘিরে বসবে অস্থায়ী খাবারের দোকান ও ধর্মীয় বইয়ের স্টল। এখানকার পূজা মণ্ডপ আকর্ষণীয় হওয়ার কারণে অনেক ছাত্র হলেই পূজা উৎসব উপভোগ করে থাকেন।

রমনা কালীবাড়ি ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের পূজা মণ্ডপের উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা একাডেমী সংলগ্ন সড়ক ছাড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক  কেন্দ্র ও দোয়েল চত্বর পর্যন্ত। পূজারি নারী ও পুরুষদের জন্য স্থাপিত হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন পথ। পূজা মণ্ডপসহ পুরো প্রাঙ্গণ সাজানো হচ্ছে বাহারি সাজে।

পুরান ঢাকার কোতোয়ালি থানার তাঁতীবাজারের প্রধান সড়কে তাঁতীবাজার পূজা কমিটি আয়োজিত দুর্গোৎসব এবার ৬০ বছরে পড়েছে। ব্যতিক্রম হিসেবে কলকাতার পূজার অনুসরণে নতুন ডিজাইনের প্রতিমা ও প্যান্ডেলের দুই দিকে প্রবেশপথ নির্মিত হচ্ছে। আলোকসজ্জায়ও থাকছে নতুনত্বের ছোঁয়া।

শাঁখারীবাজার কালীমন্দিরের পাশে শঙ্খমিত্র পূজা কমিটির পূজা মণ্ডপ আরেকটি ঐতিহ্যবাহী পূজা। প্রায় ৪০ বছর ধরে এখানে পূজা হয়ে আসছে। পূজাকে আকর্ষণীয় করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন আয়োজকরা। রাজধানীর সবচেয়ে বড় প্রতিমা এবং দীর্ঘ জায়গা নিয়ে মণ্ডপটি স্থাপিত হয় বলে আয়োজকদের দাবি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও জজকোর্টের মাঝে অবস্থিত প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের পূজা এবার ৪২ বছরে পড়েছে। প্রতি বছরই এখানে নতুন আঙ্গিকের প্রতিমাসহ সাজসজ্জা করা হয়। উত্তর মৈশুন্ডির টিপু সুলতান রোডের পাশে নন্দবণিক বান্ধব সমিতির পূজাটি ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে আয়োজিত হচ্ছে। স্থানীয় বণিক সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য এটি। তবে কালের পরিক্রমায় বণিক সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা অনেক কমে গেলেও এখনও যারা আছেন, তারাই বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে পূজার আয়োজন করে থাকেন। বণিক সম্প্রদায়ের আরেকটি পূজা মণ্ডপ দক্ষিণ মৈশুন্ডির ৫ নম্বর ভজহরি সাহা স্ট্রিটের মণ্ডপেও অর্ধশত বছর ধরে পূজা আয়োজিত হচ্ছে।

এছাড়া সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, পুরান ঢাকার নর্থব্রুক সার্বজনীন পূজা কমিটি, লালকুঠির পাশে বাংলাবাজার দুর্গোৎসব সমিতি, লালবাগের গিরি গোবর্ধন জিউ পঞ্চায়েত মন্দির, স্বামীবাগের  লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম মন্দির, সূত্রাপুর বাজার সংলগ্ন গৌতম মন্দির, বিহারী লাল জিউ আখড়া মন্দির এবং নারিন্দার গৌর মন্দিরসহ রাজধানীর অন্যান্য মণ্ডপেও উৎসবমুখর পরিবেশে পূজার আয়োজন চলছে। এসব মন্দির ও মণ্ডপে ১০ থেকে ৩৫ বছর ধরে দুর্গাপূজা আয়োজিত হয়ে আসছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ