শুক্রবার, মে ১৭, ২০২৪
প্রচ্ছদআরো খবর......রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলার বছরপূর্তি আজ ।। হামলার চিহ্ন মুছে গেলেও মনের ক্ষত...

রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলার বছরপূর্তি আজ ।। হামলার চিহ্ন মুছে গেলেও মনের ক্ষত শুকায়নি

ন্যাশনাল ডেস্কঃ (বিডি সময় ২৪ ডটকম)

রামুর বৌদ্ধ বিহার ও পল্লীতে হামলার এক বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। সেই হামলার ক্ষতচিহ্ন এখন আর নেই। বছর পার না হতেই সেই ধ্বংসস্তুপের উপর সরকারী উদ্যোগে পুনর্নির্মিত হয়েছে বিহার ও বসতবাড়িগুলো। বৌদ্ধ স্থাপত্য অনুসরণ করে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত এসব বৌদ্ধ বিহার এখন দেশের বৌদ্ধদের তীর্থস্থান। অনন্য স্থাপত্যে গড়া দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনাগুলো পর্যটকদের জন্যও আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও কৃতজ্ঞতার কমতি নেই। তবে সেই রাতের হামলাকারীদের অনেকেই এখনও প্রকাশ্যে ঘুরছেন বলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মনের ক্ষত সহজে শুকোচ্ছে না।

রামু চৌমুহনী স্টেশন থেকে বৌদ্ধ মন্দির সড়ক ধরে আধা কিলোমিটার গেলেই চোখে পড়ে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে দেয় এ বিহারটি। এখন সেই ধ্বংসস্তুপের উপর আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরী করা হয়েছে তিনতলা সুরম্য ভবন। একইভাবে সেদিন দুর্বৃত্তরা পুড়িয়ে দিয়েছিল উত্তর মিঠাছড়ির ‘বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র’। যেখানে আগে থেকেই তৈরী করা ছিল ১শ ফুট দীর্ঘ গৌতম বুদ্ধের সিংহ শয্যা বুদ্ধমূর্তি। সেই রাতে চেষ্টা করেও দুর্বৃত্তরা এ মূর্তিটির বড় কোন ক্ষতি সাধন করতে পারেনি। এরপরও কোটি টাকা ব্যয় করে সিংহশয্যা মূর্তির পাশে তৈরী করা হয়েছে দৃষ্টি নন্দন দোতলা পাকা বিহার। আরও প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিহারের আঙ্গিনাকে সাজানো হয়েছে আধুনিক সুযোগসুবিধায়। বর্তমানে এটি রামুর সবচেয়ে আকর্ষনীয় স্থান।

এছাড়াও রামু মৈত্রী বিহার, লাল চিং, সাদা চিং ও অপর্ণা চরণ চিং, চেরাংঘাটা উসাইসেন বৌদ্ধ বিহার বা বড় ক্যাং, জাদীপাড়া আর্যবংশ বৌদ্ধ বিহার, উখিয়ারঘোনা জেতবন বিহার, উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বন বিহার, চাকমারকুল অজন্তা বৌদ্ধ বিহারসহ ক্ষতিগ্রস্ত সবকটি বিহার তৈরী করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দনভাবে। এ মাসের ৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নব নির্মিত এসব বৌদ্ধ বিহারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

২৯ সেপ্টেম্বর রাতে সীমা বিহার সংলগ্ন, শিক্ষক ববিতা বড়ুয়ার বাড়ীও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এক বছর আগের ঘটনা সম্পর্কে রামু কলেজের এই শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘যখন এক বছর আগের কথা চিন্তা করি, খুব কষ্ট পাই। রাস্তায় বের হয়ে যখন দেখি সেই রাতের হামলাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরছে, তখন সেই কালো রাতের স্মৃতি চিহ্ন মনের ভেতরে আবারও দগদগ করে জ্বলে ওঠে।’’

ববিতা বড়ুয়া বলেন, সেদিনের হামলার পর প্রধানমন্ত্রী বৌদ্ধ সমাজের প্রায় সব দাবিদাওয়া পূরণ করেছেন। এতে বৌদ্ধ সমাজ খুবই খুশি। তবে হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় বৌদ্ধ সমাজে এখনও স্বস্তি ফেরেনি।

রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের বলেন, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করেছেন। তাঁর নির্দেশে সেনাবাহিনী অল্প সময়ে গড়ে তুলেছে দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ বিহার। এখন নবনির্মিত সব বৌদ্ধ বিহারে নিয়মিত পূজাপ্রার্থনা শুরু হয়েছে। এখন আমরা বিহারগুলোর স্থায়ী নিরাপত্তা এবং উপযুক্ত পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের নিশ্চয়তা চাই।

রামু উপজেলা কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ ঐক্য ও কল্যাণ পরিষদের সভাপতি প্রবীর বড়ুয়া বলেন, হামলার পর খুব সল্প সময়ের মধ্যে সেই কাল রাতের ধ্বংসযজ্ঞের অশুভ চিহ্ন মুছে দিয়ে সেনাবাহিনী ধ্বংসস্তুপের উপর গড়ে তুলেছে দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ বিহার। যা এখন সারা দেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। পর্যটকদের কাছেও বিহারগুলো এখন বাড়তি আকর্ষণ।

তাঁরা ক্ষোভের সাথে জানালেন, হামলার এক বছর পার হলেও হামলাকারীদের মধ্যে যারা সামনের সারিতে ছিল এদের অনেকেই এখনো প্রকাশ্যে ঘুরছে। আইনের আওতায় আসেনি। প্রকৃত আপরাধীরা যদি পার পেয়ে যায় তাহলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, যে কারণে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মাঝে আস্থার সংকট কাটছেনা।

কক্সবাজার জেলা বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বংকিম বড়ুয়া বলেন, ঘটনার পর গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও ২০৫ জন এবং চট্টগ্রামের দায়রা জজ আবদুল কুদ্দুস মিয়ার নেতৃত্বে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ২৯৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এগুলোসহ পুলিশের মামলায় অভিযুক্ত যারা এদের অনেকেই প্রকাশ্যে ঘুরলেও পুলিশ এদের ধরছেনা। এমনকি আমরা শুনছি, প্রথম সারির অভিযুক্তদের অনেককে চার্জশিট থেকেও বাদ দেওয়া হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে বৌদ্ধদের অনেকেই স্বাক্ষ্য দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে স্বাক্ষীদের জবানবন্দীসহ এ প্রতিবেদন অভিযুক্তদের হাতে হাতে চলে আসায় আবার নতুন করে হুমকির মুখে পড়ে বৌদ্ধরা। ফলে ভয়ে এখন আর কেউ স্বাক্ষ্য দিতে আগ্রহী হচ্ছেনা।

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে রামুর বৌদ্ধ যুবক উত্তম বড়ূয়ার ফেসবুকে (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম) কোরআন অবমাননামূলক একটি ছবিকে কেন্দ্র করে রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা চালায় একদল উগ্রপন্থী। পরদিন উখিয়া ও টেকনাফেও ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ঘটনার পর থেকে বৌদ্ধ পল্লীতে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে।

এ ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে একটি চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি উত্তম বড়ুয়াসহ ২০৫ জনকে অভিযুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে আরেকটি বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠন করা হয়। বিচার বিভাগীয় তদন্তেও ২৯৮ জনকে ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়।

প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির সদস্য ও কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার জানান, রামু ও উখিয়ার বৌদ্ধ বিহারে হামলার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে বাদি হয়ে ১৩টি এবং পাবলিকের পক্ষ থেকে বাদি হয়ে ৬টিসহ মোট ১৯টি মামলা রুজু করা হয়। এর মধ্যে রামু থানায় দায়ের করা হয় ৮টি, কক্সবাজার সদর থানায় ২টি, টেকনাফে ২টি ও উখিয়া থানায় ৭টি মামলা। এসব মামলায় এজাহারনামীয় ৩৭৫ জন এবং সন্দিগ্ধ ১৪ হাজার ৮০৭ জনসহ মোট ১৫ হাজার ১৮২ জনকে আসামী করা হয়। এরমধ্যে এজাহারনামীয় ১৮৭ জন এবং ‘তদন্তে প্রাপ্ত’ ৩৩৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ২৩ জন আসামী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে।

তিনি আরো জানান, দায়েরকৃত মামলার মধ্যে চলতি মাসের প্রথম দিকে ৩৬৪ জনকে অভিযুক্ত করে ৭টি মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে ১৯৩ জন এবং পলাতক রয়েছে ১৭১ জন। চার্জশিট হওয়া মামলাগুলো হল রামু থানার মামলা নং ৩, তারিখ ২.১০.১২, উখিয়া থানার মামলা নং ৪ তাং ২.১০.১২ ইংরেজী ও মামলা নং ১১, তারিখ ১৬.১০.১২ ইংরেজী, কক্সবাজার সদর মডেল থানার মামলা নং১ ও মামলা নং২ তারিখ ১০.১০.১২ ইংরেজী এবং টেকনাফ থানার মামলা নং১ ও ২, তারিখ ১.১০.১২ ইংরেজী।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, আরো ৫টি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিলের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাকি মামলার চার্জশিটও শীঘ্রই দেয়া হবে।

অপরদিকে রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। রামু বৌদ্ধ পরিষদের অনুষ্ঠান উদযাপন পরিষদের আহবায়ক বিপুল বড়ুয়া ও সদস্য সচিব দিপক বড়ুয়া জানান, দিনব্যাপী এ কর্মসূচিতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দেশবরণ্য নেতৃবৃন্দ যোগ দেবেন।

লালচিংমৈত্রী কমপ্লেক্সে ‘রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ’ আয়োজিত দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভোরে বুদ্ধ পূজা, সকালে মহা সংঘদান ও অষ্ট পরিস্কার দান, অতিথি ভোজন, দুইটায় শান্তি শোভাযাত্রা, বেলা তিনটায় স্মরণ সভা এবং সন্ধ্যায় বিশ্ব শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা।

দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানে প্রফেসর ড. আনু মোহাম্মদ, প্রফেসর সলিমুল্লাহ খাঁন, মানবাধিকার কর্মী খুশি কবীর, লেখিকা মেঘনা গুহ ঠাকুরতা, প্রফেসর স্বপন আদনান, প্রফেসর মোশতাক আহমদ, মানবাধিকার কর্মী শিপ্রা বোস, প্রফেসর মকবুল আহমদ, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, কবি ও সংগীত শিল্পী অরুপ রাহি, সাংবাদিক উদিসা ইসলাম, গণসংহতির কেন্দ্রীয় নেতা ফিরোজ আহমদ ও সংগীত শিল্পী কৃঞ্চকলি ইসলামসহ বিশিষ্টজনেরা অতিথি হিসেবে থাকবেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন রামু বৌদ্ধ যুব পরিষদের আহবায়ক রজত বড়ুয়া রিকু।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ