মঙ্গলবার, মে ১৪, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী কায়সারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় যেকোনো দিন

সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী কায়সারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় যেকোনো দিন

সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ মো. কায়সারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় যেকোনো দিন ঘোষণা করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বুধবার তাঁর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম শেষে রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি-কেস অ্যায়োটিং ভারডিক্ট) রাখা হয়।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে আজ আসামিপক্ষের দেওয়া যুক্তি খণ্ডন শেষ করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর ট্রাইব্যুনাল রায় অপেক্ষমাণ রাখেন। শারীরিক কারণে এত দিন জামিনে ছিলেন সৈয়দ মো. কায়সার। আজ তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির ছিলেন। তবে আজ তাঁর জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনাল-২-এ আরেকটি মামলা রায়ের অপেক্ষায় থাকল। এর আগে ৪ মে এই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। ওই রায় এখনো ঘোষণা করা হয়নি।

২ ফেব্রুয়ারি কায়সারের বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তাঁর বিচার শুরু হয়েছিল। অভিযোগ গঠনের আদেশ অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধকালে কায়সারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ একটি। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের অভিযোগ ১৩টি এবং ধর্ষণের অভিযোগ দুটি। ৯ মার্চ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষে ৩২ জন সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য দেন এক যুদ্ধশিশু। অভিযোগ গঠনের আদেশ অনুসারে, ৭৩ বছর বয়সী কায়সার ১৯৬২ সালে কনভেনশন মুসলিম লীগে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করেন।

রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, একাত্তরে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের নিয়ে তিনি ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নৃশংসতায় অংশ নেন। তবে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের প্রাক্কালে তিনি যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরার পর তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। পরে তিনি এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনের সাংসদ হন। এরশাদ আমলে তিনি কৃষি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

গত বছরের ২১ মে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কায়সারকে গ্রেপ্তার করার পর ট্রাইব্যুনাল তাঁকে কারাগারে পাঠান। তবে শারীরিক কারণে জামিনের আবেদন জানালে ৫ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল কায়সারকে জামিন দেন। এরপর থেকে তিনি জামিনে রয়েছেন।

কায়সারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

২২ গ্রামের ১০৮ হিন্দুকে গণহত্যা: কায়সারের বিরুদ্ধে ১৬তম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর কায়সারের নেতৃত্বে কায়সার বাহিনী, শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা এবং পাকিস্তানি সেনারা যৌথভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানার দেউড়া, নিশ্চিন্তিপুরসহ ২২ গ্রামে হামলা চালায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশে চালানো ওই হামলার সময় নির্বিচারে গুলি, বাড়িঘরে আগুন, লুটতরাজে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। সকাল সাতটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত চালানো ওই হামলায় কায়সার ও তাঁর সহযোগীরা ১০৮ জন নিরস্ত্র হিন্দুকে হত্যা করেন। ওই ঘটনায় কায়সারের বিরুদ্ধে গণহত্যা অথবা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে নিপীড়নে অংশগ্রহণ ও সহায়তার অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।

হত্যার ১৩টি অভিযোগ: কায়সারের বিরুদ্ধে গঠন করা ১৩টি অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রথম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইসলামপুর থানার শাহজাহান চেয়ারম্যানকে কায়সারের নির্দেশে তাঁর বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে হত্যা করে। পরে কাজীবাড়ি গ্রামের ১৫টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালানো হয়। দ্বিতীয় অভিযোগ অনুসারে, ২৭ এপ্রিল বিকেলে হবিগঞ্জের মাধবপুর বাজারের পশ্চিম পাশে ও কাটিয়ারা গ্রামের ১৫০ দোকান ও ঘরবাড়িতে লুটপাট চালানো হয়। তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটার দিকে মাধবপুরের কৃষ্ণনগর গ্রামে চারজনকে হত্যা করে কায়সারের নেতৃত্বাধীন বাহিনী।

কায়সারের বিরুদ্ধে চতুর্থ ও পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল সকালে কায়সারসহ তাঁর বাহিনীর ১০-১৫ জন সদস্য এবং ৩০-৩৫ জন পাকিস্তানি সেনা মাধবপুর বাজারের উত্তর-পূর্ব অংশে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৫ জনকে হত্যা করে, ১৫০-২০০ ঘরে আগুন দেয়। ২৯ এপ্রিল হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ খাদ্যগুদামে কায়সার ও তাঁর লোকজন হামলা চালান। গুদামের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এক মাস আটকে রাখা হয়। পরে ২৯ মে আটকে রাখা সাতজনকে খোয়াই রেলব্রিজের কাছে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে হত্যা করে।

ষষ্ঠ অভিযোগ অনুসারে, ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল বিকেল সাড়ে তিনটা-চারটার দিকে শায়েস্তাগঞ্জের পুরান বাজার এলাকায় কায়সার পাকিস্তানি সেনাদের জিপ থামাতে বলেন। ওই সময় ডা. সালেহউদ্দিন ও হীরেন্দ্রচন্দ্র রায় সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে যাচ্ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ধরে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সপ্তম অভিযোগে বলা হয়েছে, ৩০ এপ্রিল কায়সার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা হবিগঞ্জ শহরের ৪০-৪৫টি ঘর লুণ্ঠনের পর আগুন দেয়। কায়সারের বিরুদ্ধে গঠন করা নবম থেকে ১১তম অভিযোগ এবং ১৩ থেকে ১৫তম অভিযোগেও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

ধর্ষণের দুই অভিযোগ: অষ্টম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১১ মে কায়সার একদল পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানা এলাকার চানপুর চা-বাগানে যান। একপর্যায়ে চা-বাগানের এক সাঁওতাল নারী শ্রমিকের ঘর দেখিয়ে দিলে দুই-তিনজন পাকিস্তানি সেনা ওই নারীকে ধর্ষণ করে।

১২তম অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে কায়সারের নেতৃত্বে তাঁর বাহিনীর সদস্য ও কয়েকজন রাজাকার মাধবপুর থানার জগদীশপুর পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে এক নারী, তাঁর বাবা আতাব মিয়া ও চাচা আইয়ুব মিয়াকে ধরে নিয়ে যায়। পরে ওই নারীকে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে হস্তান্তর করা হলে তাঁকে ৮-১০ দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়।

  • বিষয়:
  • top
আরও পড়ুন

সর্বশেষ