শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪
প্রচ্ছদদেশজুড়েচট্টগ্রাম বিভাগএক মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীর সব খালে অবৈধ দখল উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত

এক মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীর সব খালে অবৈধ দখল উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত

আগামী এক মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীর সব খালে অবৈধ দখল উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নদীর নাব্যতা রক্ষার্থে গঠিত টাস্কফোর্স।  এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রশাসনের সমন্বয়ে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বুধবার নগরীর সার্কিট হাউসে আয়োজিত টাস্কফোর্সের ২৬তম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।  বক্তাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সভার সভাপতি নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

নৌপরিবহন মন্ত্রী বলেন, এটি অনেক দুর্ভাগ্যজনক যে, চট্টগ্রাম নগরীর ৫১টি খালের মধ্যে কেবল ২৯টি খাল দৃশ্যমান রয়েছে।  দৃশ্যমান খালগুলোও দখল-দূষণে বিপর্যস্ত।  কর্ণফুলীকে বাঁচাতেই এ খালগুলোকে দখলমুক্ত করা প্রয়োজন।  তিনি বলেন, আগামী একমাসের মধ্যে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রশাসন সমন্বয় করে খালগুলোকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে হবে। সভায় কাপ্তাই লেক খননের ব্যাপারে শিগগিরই উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রী বলেন, কাপ্তাই লেক খননের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খননের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে শিগগিরই একটি জরিপ চালানো হবে।

সভায় এছাড়াও শিগগিরই কর্ণফুলী নদীকে দখলমুক্ত করা, সীমানা চিহ্নিত করতে জরিপ চালানো, হালদা নদীর লবণাক্ততা দূর করতে উদ্যোগ গ্রহণ, গঠিত চারটি সমন্বয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব বন্দর চেয়ারম্যানকে হস্তান্তর এবং  কর্ণফুলী পেপার মিলের দূষণ রোধে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নির্মাণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান।

সভায় গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, কর্ণফুলী ও এর আশেপাশের খালগুলোকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে না পারলে কর্ণফুলীকে ঘিরে যত উন্নয়ন কাজই হাতে নিন, তা কাজে আসবে না।  দ্রততম সময়ের মধ্যেই সব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা উচিত। তিনি বলেন, রাজধানীর কিছু জায়গায় খাল-নদীর সীমানা পিলার দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। চট্টগ্রামেও অবৈধ দখল রোধে এ উদ্যোগ নিতে হবে।

পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, এখন ব্যাপারটা এমন হয়ে গেছে যে, কোনো নদী থাকতে তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ব্যবহার উপযোগিতা হারানোর পর তার কদর বাড়ে। কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।  কর্ণফুলী নদীর ক্ষেত্রে যেন সে রকম কিছু না হয়। তিনি বলেন, এখন নদীটিকে রক্ষা করা না গেলে পরে কয়েকশ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে আসতে হবে।

কর্ণফুলী নদীকে দখলমুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বর্জ্য ও দূষণ দুটিই কর্ণফুলীর জন্য হুমকি।  তবে, দূষণের চেয়েও দখল বিপজ্জনক। দখলের পর ঘর-বাড়ি হয়ে গেলে ‍তা উচ্ছেদ করতেও নানা সমস্যা দেখা দেয়। এসময় নদীর দুই পাড়ের উপজেলা প্রশাসনকে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালানার জন্য শক্তিশালী করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সভায় ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ বলেন, কর্ণফুলী শুধু চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য নয়, সারাদেশের জন্য প্রয়োজন।  এ নদী রক্ষায় যে কোনো উদ্যোগে ভূমি মন্ত্রালয় থেকে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। কর্ণফুলী নিয়ে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের দাবি করে বোয়ালখালী আসনের সংসদ সদস্য মঈনউদ্দিন খান বাদল বলেন,  সারা দেশের নদীগুলোর সঙ্গে কর্ণফুলীকে একই দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না।  কর্ণফুলী নদীর চরিত্র ভিন্ন। এখানকার স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এ নদী রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর খালগুলো নিয়ে কী করা হচ্ছে, তার স্বচ্ছ কোনো ধারণা জনগণের নেই। সংশ্লিষ্টদের কিছু জিজ্ঞাসা করলেই তারা খালি মাস্টার প্ল্যান দেখায়। কিন্তু, ওই মাস্টারপ্ল্যানে কী রসগোল্লা আছে, তা আমাদের জানার সুযোগ হলো না!

খালগুলোর দখল প্রসঙ্গে প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে মঈনউদ্দিন খান বাদল বলেন, খালের মুখে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে এত দূর্বল নয় যে, কয়েকজন দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না! কিন্তু সমস্য যদি নিজেরাই সৃষ্টি করি, তা হলে প্রতিকার হবে কীভাবে! তিনি বলেন, চট্টগ্রামে ২৫০ বছরের পুরনো পুকুর ভরাট হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি।

কাপ্তাই লেক খননের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, ১৯৬০ সালে বাঁধ দিয়ে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পর লেকটিকে খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এর কারণে একদিকে বিদ্যুতের উৎপাদন কমে গেছে। অন্যদিকে, কর্ণফুলীর পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে।  বোয়ালখালী এলাকায় চাষাবাদ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। এ লেকটি খননের উদ্যোগ নিতে হবে।

সভায় এছাড়াও কোতোয়ালি আসনের সংসদ সদস্য জিয়া উদ্দিন আহমেদ বাবলু, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সিটি মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ চট্টগ্রাম বন্দর, পরিবেশ অধিদফতর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিভাগীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সিডিএ-সিটি-কর্পোরেশন ও ওয়াসা প্রধান নিয়ে ক্ষোভ:
সভায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধানরা উপস্থিত না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আলোচকরা। সংসদ সদস্য মাইনুদ্দিন খান বাদল বলেন, টাস্কফোর্সের টাস্ক আছে, ফোর্স নেই।  ফোর্স থাকলে চারজন মন্ত্রী উপস্থিত থাকার পরও একটি বৈঠকে কী করে এ তিন প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা অনুপস্থিত থাকেন।

জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেন, কর্ণফুলী নদী দখল-দূষণের জন্য ওয়াসা, সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ তিনটি প্রতিষ্ঠানই দায়ী। অথচ, বৈঠকে তাদের প্র্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকার প্রয়োজন ছিল। একইভাবে এ তিন প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের অনুপস্থিত থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন নৌপরিবহন মন্ত্রী ও গণপূর্ত মন্ত্রী।

কেপিএম নিয়ে নানা মত:
সভায় রাষ্ট্রায়ত্ত কর্ণফুলী পেপার মিল কাগজ একদিকে বন উজাড় এবং অন্যদিকে কর্ণফুলী দূষণ করছে বলে মন্তব্য করে প্রতিষ্ঠানটিকে চালু রাখার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেওর সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেন বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক জাফর আলম। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদনও তেমন একটা নেই। আর ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপনের জন্য অনেক অর্থ প্রয়োজন। জাফর  আলমের এ মন্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিষয়টি বিবেচনার দাবি জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়াসহ আরো কয়েকজন আলোচক। কিন্তু, পেপার মিল বন্ধের এ সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী উল্লেখ করে এর কঠোর সমালোচনা করেন ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ।

তিনি বলেন, এ ধরনের ঠুনকো ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াত নর্থবেঙ্গল পেপার মিলকে বন্ধ করে দিয়েছিল। কেপিএমের শোধনাগার না থাকলে তার ব্যবস্থা করতে হবে।  যারা বন্ধ করার কথা বলছেন, তারা ষড়যন্ত্রকারীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। বৈঠকে একই রকম মন্তব্য করেন গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ।

তিনি বলেন, কেপিএম ঐতিহ্যবাহী মিল। বন্ধ করার ষড়যন্ত্রের পেছনে অনেক লোক আছে। বিশেষ প্ল্যান্ট করার জন্য প্রয়োজনে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশেষ বরাদ্দ চাইবো। কিন্তু, কারখানা বন্ধ করা যাবে না।

উচ্ছেদে বাধা জরিপ:
বৈঠকে জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন জানান, কর্ণফুলী নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও হাইকোর্টের নির্দেশে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় উচ্ছেদ কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, হাইকোর্ট উচ্ছেদ করতে বলেছে। কিন্তু একেক জরিপে সীমানা একেক ধরনের; যার কারণে আমরা হাইকোর্টের কাছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা চেয়েছি।  নির্দেশনা পেলে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা যাবে। জেলা প্রশাসকের এ মন্তব্যের জবাবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ীই, উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হবে। কিন্তু বৈঠকে এ ধরনের মন্তব্যের বিরোধিতা করেন পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিস।

তিনি বলেন, সরকার কখনো নদী বিক্রি করেনি।  সিএস জরিপে যা ছিল, বিএস জরিপেও তাই-ই থাকার কথা। যদি নাও থাকে, তবুও আগের জরিপ অনুসরণ করতে হবে। নদী, খাল, পুকুর ভরাট করলেও সেটা জরিপে একই অবকাঠামো হিসেবে থাকতে হবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ