শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪
প্রচ্ছদচট্রগ্রাম প্রতিদিনবেপরোয়া ছাত্রলীগ অচল চট্টগ্রাম ভার্সিটি

বেপরোয়া ছাত্রলীগ অচল চট্টগ্রাম ভার্সিটি

নাহিদ উল আলম, চবি প্রতিনিধিঃ (বিডি সময় ২৪ ডটকম)

আবারো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশের অবরোধের ডাক। যার জের ধরে অচল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। প্রতিবারই যার মাশুল গুনতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। অবরোধের কারণে যাদের নষ্ট হয় শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। কোন ধরণের রাজনীতির সাথে জড়িত না থেকেও বারবার এভাবে শিক্ষাজীবন পিছিয়ে পড়ায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। তারা চান এসব নোংরা রাজনীতির অবসান, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষ ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ, ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দল এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত সাধারণ শিক্ষার্থীরা। উদ্বিগ্ন তাদের অভিভাবকরাও। তারা বলছেন, এ ধরণের ঘটনায় প্রশাসন বারবার নীরব থাকায় আন্দোলনের নামে স্বেচ্ছাচারিতার সাহস পাচ্ছে আন্দোলনকারীরা।

বর্তমানে চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠটিতে আওয়ামীলীগের উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক ও চবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসির হায়দার বাবুলের অনুসারীদের ডাকা অবরোধ চলছে। গত দুই দিন ধরে তারা শাটল ট্রেনের চালককে অপহরণ, মারধর, লাইনের সংযোগ পাইপ (হুস পাইপ) খুলে ফেলে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন, শিক্ষকদের বহনকারী বাসে হামলা ইত্যাদি তান্ডব চালিয়ে আসছে। তাদের দাবি বাবুলকে লাঞ্ছনাকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আশ্বাস দিয়ে এখনো এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। এদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, আন্দোলন হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক। এভাবে সাধারণ শিক্ষার্থী ও প্রশাসনকে জিম্মি করে আন্দোলন কোনভাবেই কাম্য নয়। আর এভাবে আন্দোলনকারীদের কোন শাস্তি হয়না বলেই তারা বারবার এ ধরণের কাজ করার সাহস পায়।  ছাত্রলীগের একাংশের ডাকা এই অবরোধে এখন অচল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। গতকাল অবরোধের দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। চবি, রেল ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সকালে অবরোধকারীরা রেল লাইনের সংযোগ পাইপ (হুসপাইপ) খুলে ফেলায় সকাল থেকে নির্ধারিত সময়ে শাটল ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে হুস পাইপ মেরামত করে সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে শাটল ট্রেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য পিলখানা এলাকায় পৌঁছালে ট্রেন লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছুঁড়ে হামলা করে অবরোধকারীরা। এতে লোকোমাস্টার (ট্রেনের চালক) আনোয়ার হোসেনসহ একজন পুলিশ সদস্য আহত হন। হামলার কারণে সেখানেই আটকা পড়ে শাটল ট্রেন। পরে আহত লোকো মাস্টারকে উদ্ধার করে নগরীর রেলওয়ে হাসপাতালে ও পুলিশ সদস্যকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার পর নিরাপত্তাজনিত কারণে বিশ্ববিদ্যালয় রুটে গতকাল আর কোনো ট্রেন চলাচল করেনি। এতে দুর্ভোগে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থী আতঙ্কে ফের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। আর যারা সকালে বাসে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন তাদের অনেককেই নন্দীরহাট এলাকায় বাস থামিয়ে নামিয়ে দেয় অবরোধকারীরা। একইসাথে নন্দীরহাটে রেল লাইনের স্লিপারে আগুন দেয় অবরোধকারীরা। এসর্ম্পকে রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আলী  বলেন, আজকের (বৃহস্পতিবার) হামলার ঘটনায় লোকো মাস্টার ও পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এধরনের অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়রুটে ট্রেন চলাচল সম্ভব নয়। তাই অবস্থার উন্নতি না হলে এ রুটে আর শাটল চলবে না।

শাটল ট্রেন চলাচল করতে না দেওয়ায় এবং নগরী থেকে কোন শিক্ষক-কর্মচারী বাস চলাচল না করায় বৃহস্পতিবারও কোন বিভাগে ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। শিক্ষার্থীশুন্য হয়ে পড়ে পুরো চবি ক্যাম্পাস। বিভিন্ন বিভাগে ক্লাসরুমগুলো ছিল তালাবদ্ধ। প্রশাসনিক কাজকর্মও ছিল অন্যদিনের তুলনায় কম। এদিকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন অবরোধকারী ছাত্রলীগের একাংশের নেতারা । চবি ছাত্রলীগের মানবসম্পদউন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক এস. এম. আলাউদ্দিন আলম জানান, আমাদের ৭ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন নিয়ে এ আন্দোলন আমরা চালিয়ে যাবো।
তবে এ আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থনের কথা বলে হলেও আদতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ ধরণের আন্দোলনে আতঙ্কিত, উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ। তারা চান বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ। অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ফাতেমা পান্না  বলেন, কয়দিন শিবির-ছাত্রলীগ মারামারি, কিছুদিন পর ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগ মারামারি, আবার কিছুদিন পর ছাত্রদল-ছাত্রলীগ সংঘর্ষ। এভাবে আর কত দিন ? আর কিছু হলেই ট্রেনের লাইনে আগুন, চালককে মারধর, শিক্ষক বাসে হামলা। আন্দোলনের আরো অনেক পথ আছে। এভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে নিজেদের স্বার্থে আন্দোলন কোনভাবেই কাম্য নয়। ছাত্র সংগঠনগুলোতো কখনো সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোন সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করে না। শুধু তাদের স্বার্থে টান পড়লেই আন্দোলন শুরু হয়। আর যেটার মূল্য দিতে হয় আমাদের মত শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন। বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রেজাউল করিমের বাবা আমিনুর রহমান বলেন, ছেলে-মেয়েদের আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাই পড়ালেখা শিখে মানুষ হওয়ার জন্য, সুন্দর জীবন গড়ার জন্য। কিন্তু শিক্ষার্থী নামধারী কতিপয় দুর্বত্ত প্রতিনিয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার পরিবেশ নষ্ট করছে। তাদের কাছে মারামারি, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি এগুলোই মূল বিষয়। আর এসবের মূল্য দিতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। কত ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসছে, তবুও এদের মন ভরছে না। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দিচ্ছে। আর প্রশাসন যেন ঠুটো জগন্নাথ। এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না বলেই বারবার এসবের পুনরাবৃত্তি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২ হাজার শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে ছিনিমিন খেলার অধিকার কারো নেই। অন্যদিকে শিক্ষক বাস ও শাটল ট্রেনে হামলার প্রতিবাদে গতকাল চবি ছাত্রলীগের অপর অংশ ক্যাম্পাসে মিছিল ও সমাবেশ করেছে। পরে এই ন্যাক্কারজনক হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি নিয়ে তারা চবি উপ-উপাচার্য এবং প্রক্টরের সাথে সাক্ষাত করেন। অন্যথায় তারাও আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস, পরীক্ষা ও দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেবেন তারা জানান।

এ ব্যাপারে চবি ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিন বলেন, বিগত ২ বছর ধরে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমে বাইরে থাকা কয়েকজন নেতাকর্মীর বিশ্ববিদ্যালয় ট্রেন বন্ধ করার এখতিয়ার নেই। এটা খুবই উদ্বেগের ও হতাশাজনক। বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন চাইলে এটা প্রতিকার করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সিরাজ উদ দৌলাহ  বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।

প্রসঙ্গত, গত ৫ এপ্রিল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ কমিটির সহ সম্পাদক ও চবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসির হায়দার করিম বাবুলকে গলায় জুতার মালা পড়িয়ে লাঞ্ছিত করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশ। বাবুলকে  লাঞ্ছনাকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারসহ ৭দফা দাবিতে গত বুধবার থেকে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক ছাত্রলীগের একাংশ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ