বুধবার, মে ১, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়কালবৈশাখীতে নিহত ১৮

কালবৈশাখীতে নিহত ১৮

নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, নওগাঁ, রাজবাড়ী ও সিলেটে রোববার রাতে কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাতে ১৭ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক। বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ও বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। উপড়ে গেছে অসংখ্য গাছপালা। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে উঠতি ফসলের। এ ছাড়া গতকাল রাজবাড়ীতে বজ্রপাতে এক জেলে মারা গেছে। আমাদের প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর :
নেত্রকোনায় কালবৈশাখীতে নিহত ৯ : জেলার চারটি উপজেলার ওপর দিয়ে রোববার রাতে বয়ে গেছে কালবৈশাখী ঝড়। এতে ঘর চাপা পড়ে একই পরিবারের চারজনসহ নয়জন নিহত ও প্রায় ২০ জন আহত হয়েছে। দুই সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। শত শত গাছপালা ভেঙে গেছে বা উপড়ে পড়েছে।
ঝড়ে নিহতরা হচ্ছেন-কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটি ইউনিয়নের বিষমপুর গ্রামের আবদুল মোতালেবের স্ত্রী আফরোজা (২৮), তার তিন ছেলে পারভেজ (৯), রানা (৪) ও রনি (২), একই উপজেলার কলমাকান্দা ইউনিয়নের নয়ানগর গ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে মামুন (১৭), নাজিরপুর গ্রামের ডিপটি বেগম (৫৫), নেত্রকোনা সদর উপজেলার বরনী চকপাড়া গ্রামের হাবিবুর রহমান (৭২), বারহাট্টার গাদারকান্দা গ্রামের আবদুস ছোবহানের ছেলে এমদাদ (১৪) ও মোহনগঞ্জ উপজেলার হরিপুর গ্রামের জয়নাল মিয়ার মেয়ে সুমা আক্তার (৯)। আহতরা স্থানীয় হাসপাতালে চিকিত্সা নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাত পৌনে ১১টার দিকে জেলার কলমাকান্দা, নেত্রকোনা সদর, বারহাট্টা ও মোহনগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায়।
ঝড়ের পর থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত জেলায় বিদ্যুত্ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কলমাকান্দা উপজেলার বিষমপুর, হরিপুর, নয়ানগর, পাবই, বোবাহালা, কৈলাটি, বড়কাপন, সদর উপজেলার কালিয়ারা গাবরাগাতি, সিংহেরবাংলা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালা ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। খোলা আকাশের নিচে অসহায় অবস্থায় বসে আছে অনেক মানুষ। এ ছাড়া বারহাট্টার গাদারকান্দা, রায়পুর, মোহনগঞ্জ উপজেলার হরিপুর, তেঁতুলিয়া, মাঘান, সিয়াদার এলাকায় ঝড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন জানান, রাত পৌনে ১১টার দিকে হঠাত্ উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা প্রায় ৪৫ মিনিট স্থায়ী কালবৈশাখী ঝড়ে কিছু বুঝে ওঠার আগে আগেই সব তছনছ হয়ে গেছে। কলমাকান্দা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম ফিরোজ জানান, উপজেলার বিষমপুর দাখিল মাদ্রাসা, রিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নাজিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়, রাজনগর উচ্চ বিদ্যালয়, কলমাকান্দা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ উপজেলার ২০-২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাল উড়ে গেছে। নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সমীর কুমার সরকার জানান, ঝড়ে জেলায় প্রায় দেড়শ’ হেক্টর জমির কাঁচা-পাকা ধান, করলা, চিচিঙ্গা, শসাসহ ছয়শ’ হেক্টর সবজি ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়েছে।
কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তারী কাদেরী জানান, নিহতদের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রত্যেককে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, তাত্ক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে তিনশ’ টন চাল, ২০০ ব্যান্ডেল টিন ও ১২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। আরও ৫ হাজার টন চাল ও ১২ হাজার বান্ডেল টিনের প্রয়োজন।
সুনামগঞ্জে কালবৈশখীতে নিহত ৪ : জেলার ধর্মপাশায় কালবৈশাখী ঘূর্ণিঝড়ে চারজন মারা গেছে। এ ছাড়া জেলার দিরাই, জগন্নাথপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, সদর উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
নিহতরা হলেন-উপজেলার রাজারপুর গ্রামের কাচু মিয়া (৩৫), মধুপুর গ্রামের সামছু মিয়া (৬৫), দক্ষিণ সুখাইড় রাজারপুর গ্রামের বেবি আক্তার (৮), গাদিয়া গ্রামের দুদু মিয়া (৬০)। জেলার বিভিন্ন স্থানে অন্তত দুই শতাধিক আহত হয়েছে। ধর্মপাশায় উপজেলা হাসপাতালে ৩৫ জন চিকিত্সা নিচ্ছে। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইয়ামিন চৌধুরী জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিকভাবে সাহায্য দেওয়া হয়েছে।
নওগাঁয় শিশুসহ ৩ জন নিহত : নওগাঁ সদর, পত্নীতলা ও বদলগাছী উপজেলায় কালবৈশাখী ঝড়, বজ পাত ও বিদ্যুত্স্পর্শ হয়ে শিশুসহ চারজন নিহত হয়েছে। রোববার রাত ও গতকাল সকালে এরা মারা যায়। নিহতরা হলেন-নওগাঁ শহরের চকবিরাম মহল্লার আবু ইসা (২৫), পত্নীতলা উপজেলার শীতল গ্রামের মাহমুদুল হক (২৮) ও বদলগাছী উপজেলার সোয়াশা গ্রামের পিয়াস (৩)।
জানা গেছে, রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে নওগাঁ জেলার ওপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হয়। এ সময় শহরের বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন চকবিরাম এলাকায় ঘরের ছাউনি উড়ে আহত হন আবু ইসা। এতে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। একই সময় পত্নীতলা উপজেলার শীতল গ্রামের পাশের একটি মাঠে জমিতে সেচ দেওয়ার সময় বজ পাতে মারা যান কৃষক মাহমুদুল হক। একই সময় বদলগাছী উপজেলার সোয়াশা গ্রামের পিয়াস নামে এক শিশু গাছের ডাল পড়ে মারা গেছে। ঝড়ে উঠতি বোরো ধান, ভুট্টাসহ মৌসুমি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
কালবৈশাখীর থাবায় সিলেটে নিহত ১ : রোববার রাতে ঘণ্টায় ৮২ কিলোমিটার বেগে বয়ে যাওয়া মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছে সিলেট। সহস াধিক বাড়িঘর, দোকানপাট লণ্ডভণ্ড ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বৈদ্যুতিক লাইন উপড়ে পড়ে সিলেটের বিভিন্ন এলাকা বিদ্যুিবহীন ছিল ১৭ ঘণ্টা। সীমান্তবর্তী কানাইঘাট উপজেলায় ঝড়ে মারা গেছেন আলতাফুন্নেছা (৫৫) নামে এক বৃদ্ধা। এ ছাড়া সিলেটের ১২ উপজেলায় অন্তত আরও ৩০ জন আহত হয়েছে। আহতদের অনেকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন। সিলেট সদর, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাটে শত শত কাঁচা ঘরবাড়ির চালা উড়ে গেছে ও বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
রাজবাড়ীতে বজ পাতে জেলের মৃত্যু : গতকাল সকালে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার পদ্মা নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে বজ পাতে ফরিদ শেখ (৩০) নামে এক জেলে মারা গেছেন। এ সময় বজ পাতে তার আপন ছোট ভাই মো. ফরহাদ শেখ (২৫) আহত হয়েছেন। ফরিদ পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার মহনগঞ্জ গ্রামের মৃত জুলহাস শেখের পুত্র।
নীলফামারীতে সহস াধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত : জেলায় রোববার রাতে বিক্ষপ্তভাবে বয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ঝড়ে সহস াধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এ সময় বেশ কিছু গাছপালা উপড়ে বিদ্যুতের ৩৩ কেভি বৈদ্যুতিক লাইনের উপড়ে পড়ায় গোটা জেলা ১৮ ঘণ্টা বিদ্যুত্ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জানা গেছে, ঘণ্টাব্যাপী বয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ঝড়ে জেলা সদরের পলাশবাড়ি, টুপামারী, খোকশাবাড়ি, চওড়া বড়গাছা, ইটাখোলা, ডোমার উপজেলার বামুনিয়া, বোড়াগাড়ী, ভোডাবুড়ি, কেতকীবাড়ি, জোড়াবাড়ি, মেলাপাঙ্গা, ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই, পূর্বছাতনাই, বালাপাড়া, ডিমলা সদর, খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের সহস াধিক কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে।
কালবৈশাখীতে হবিগঞ্জে বিদ্যুত্ বিপর্যয় : রোববার রাত ১১টায় হবিগঞ্জে কালবৈশাখী ঝড় আঘাত হানে। এতে হবিগঞ্জ সদর, বানিয়াচং, লাখাই ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার অনেক লোকের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার সুতাং এলাকায় পিডিবির ৩৩ কেভি লাইনের একটি টাওয়ার ভেঙে পড়ে। এতে রোববার রাত ১১টা থেকে হবিগঞ্জ শহরসহ বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুত্ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
ঠাকুরগাঁওয়ে ব্যাপক ক্ষতি : কালবৈশাখী ঝড়ে ঠাকুরগাঁওয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। রোববার রাত ৮টার দিকে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ঘনিমহেষপুর, কুজিশহর, ফরিদপুর, সেনিহারী ও চাপাতি গ্রামে কালবৈশাখী ঝড় হানা দেয়। এতে বড় বড় গাছ ভেঙে পড়ে। ঘরের ঢেউটিন উড়ে যায়। এ ছাড়াও কালবৈশাখী ঝড়ে উঠতি ফসল বোরো ধান, ভুট্টা, মরিচ ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়।
ভালুকায় ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি : ময়মনসিংহের ভালুকায় কালবৈশাখী ঝড়ে পৌর এলাকাসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি, উঠতি রোরো ধান ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রোববার রাতে উপজেলার পৌর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার ওপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায়। এতে হাসপাতাল রোডে টিনশেট মার্কেটে ৮-১০ দোকান, গফরগাঁও রোডে ভালুকা প্রেসক্লাব ও ভাই ভাই হার্ডওয়্যার স্টোর, মিরকা হাসিনা বানু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, হালিমুন্নেছা চৌধুরানী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও বাটাজোর মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসার টিনের চালা উড়িয়ে নিয়ে যায়। এ ছাড়া পঞ্চগড় ও বগুড়ায় কালবৈশাখীতে উঠতি বোরো ধানসহ আম, লিচু, ভুট্টা, তরমুজেরও ক্ষতি হয়েছে।
আরও পড়ুন

সর্বশেষ