শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪
প্রচ্ছদইন্টারভিউদেশের মানুষ সরকারকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে : ভয়েস অব আমেরিকাকে খালেদা জিয়া

দেশের মানুষ সরকারকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে : ভয়েস অব আমেরিকাকে খালেদা জিয়া

ষ্টাফ  রিপোর্টার  (বিডিসময়২৪ডটকম)

দেশের মানুষ সরকারকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, দেশে কোনো নির্বাচন হয়নি। যেটা হয়েছে তা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণের মতামতের কোনো প্রতিফলন এখানে হয়নি। এটা ভাগাভাগির নির্বাচন। বাংলাদেশের জনগণ সত্যিকারের একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়।

গত বৃহস্পতিবার ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন খালেদা জিয়া। জামায়াতের সাথে জোট বা ঐক্যের বিষয়টি কৌশলগত ব্যাপার বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জামায়াতের সাথে আঁতাত, জোট বা ঐক্য যেটাই বলেন তা আওয়ামী লীগই আগে করেছে। এরশাদের আমলে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কেউ নির্বাচনে যাবো না। তারপর মাঝ রাতে এরশাদের সাথে আঁতাত করে নির্বাচনে গেল আওয়ামী লীগ। জামায়াতের সাথে কথা বলে তাদের নিয়ে গেল। নিরপেক্ষ সরকারের দাবিটা আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের। সে জন্য তখন আওয়ামী লীগ অনেক নাশকতা করেছে। আওয়ামী লীগ এখনো জামায়াতের সাথে সেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। বিএনপির সাথে জামায়াতের এই জোট সম্পূর্ণভাবে কৌশলগত।

ভয়েস অব আমেরিকা : গত ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল। শপথ গ্রহণও হলো।  এরপর কী? আপনারা কী ভাবছেন? কী কর্মসূচি দেবেন?
খালেদা জিয়া : দেখেন প্রথম কথা আমি বলব দেশে কোনো নির্বাচন হয়নি। যেটা হয়েছে সেটা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের মানুষ এই সরকারকে সম্পূর্ণভাবে রিজেক্ট করেছে। আপনি নিজেই দেখেন যেখানে ১৫৩টি সিটে কেউ কনটেস্ট করেনি, কেউ আগ্রহীই নয় নির্বাচন করতে, সেখানে একদলীয় নির্বাচনে ১৫৩টি সিটে কোনো নির্বাচনই হয়নি।
দ্বিতীয়ত : যে ১৪৭টি সিটে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে, সেখানে ভোটকেন্দ্রে মানুষই নেই। প্রিজাইডিং অফিসার কোনো কোনো জায়গায় ঘুমাচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় তারা নিজেরাই ভোট দিচ্ছে। এমনকি ৪৭টি-৪৮টি সেন্টারে কোনো ভোটই পড়েনি। তারপর অনেক কেন্দ্র বন্ধ, যা ভোটিং হয়েছে তাতে পাঁচ পারসেন্টও হবে না ভোট কাস্ট হয়েছে। এটা কি জনগণের রায়? জনগণের রায়ের কোনো প্রতিফলনই এ নির্বাচনে হয়নি। কাজেই এটাকে আমি কোনো ইলেকশনই বলি না। এটাকে ভাগাভাগির নির্বাচন বলতে পারেন। তারা সিট ভাগাভাগি করে নিয়েছে এবং ক্ষমতার ভাগাভাগি হয়েছে। এটা নির্বাচন হয়নি আসলে। বাংলাদেশের জনগণ একটা অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। যেখানে সবার ও সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে। এই ধরনের নির্বাচন হতে হবে একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। বাংলাদেশের মানুষ এখন আরো পরিষ্কারভাবে জানতে পেরেছে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়, জনগণ আরো জানতে পারল যে এই নির্বাচন কমিশনের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এই নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন ও সম্পূর্ণ দলীয় সরকারের অধীনে কাজ করেছে।
যেখানে পাঁচ পারসেন্ট ভোট পড়েনি সেখানে কমিশন কিভাবে ৪০ পারসেন্ট ভোট পড়েছে বলে? এটা তো নির্লজ্জ মিথ্যাচার। আর এই হিসাবটা করতে কিভাবে কী করবে তা নির্ধারণ করতে দুই দিন সময় নিয়েছে। কাজেই জাতি এটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
ভিওএ : আপনি সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সঙ্কট নিরসনে অবশ্যই আলোচনায় যাওয়া প্রয়োজন। আপনার দলের সবাই এ ধারণা পোষণ করেন কি না ও ক্ষমতাসীনরা যেমন বলছেন যে, দশম সংসদ নির্বাচন-উত্তর বিএনপি চাইলে একাদশ সংসদীয় নির্বাচন নিয়ে সমঝোতা হতে পারে। আপনারা কি যাবেন এ ধরনের আলোচনায়?
খালেদা : দশম তো মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে, একাদশের কথা পরে হবে। আমরা সব সময় বলি আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক দল, আমি ঠিক আজকে নয় অনেক আগে থেকেই গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি। এর আগে আপনি আমাকে বলতে শুনেছেন, আমরা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরা শান্তি চাই। জনগণ যেন তার ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে সেটা আমরা চাই। আমরা বলেছি, আমরা শান্তি চাই, উন্নয়ন চাই, আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এই যে নিউ জেনারেশন, তারা পুরোপুরি তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে।
সে জন্যই আমরা বলেছি, আলোচনার মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন করে দেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এ জন্যই আমরা বলেছি আলোচনায় আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
ভিওএ : জামায়াতের সাথে বিএনপির জোটবদ্ধতা নিতান্তই রাজনৈতিক ও যেকোনো রাজনৈতিক আঁতাতের মতো এটিও কৌশলগত অবস্থান এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আপনার মন্তব্য কী?
খালেদা জিয়া : আপনি যেটা বলেছেন এটাই আমার মত। আমি বলছি জামায়াতের সাথে আমাদের আঁতাত বলেন, জোট বলেন বা ঐক্য বলেন, সেটা আওয়ামী লীগই প্রথম করেছে। আপনি যদি দেখেন এরশাদবিরোধী আন্দোলন, তখন আপনারা সবাই আমাদের সাপোর্ট দিয়েছেন। দেখেন, আমাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত হলো ’৮৩ সালে আমরা কেউ এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাবো না। পরে আওয়ামী লীগ আঁতাত করে সেই নির্বাচনে গেল। তখন জামায়াতের সাথে কথা বলে জামায়াতকে সাথে নিয়ে গেল। কাজেই বুঝতে হবে জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগের আঁতাত অনেক আগে থেকেই।
তারপরে এই যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এটা এলো কোথা থেকে। তত্ত্বাবধায়কের এই দাবিটা আওয়ামী লীগের এবং জামায়াতের। এ দাবিতে আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাতীয় পার্টি আন্দোলন ভাঙচুর, মানুষ খুন সবই তারা করেছে।
জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগের আঁতাতটা একটু বেশি। এখনো তারা এটা মেনটেইন করে যাচ্ছে তলে তলে। কাজেই জামায়াতের সাথে আমাদের এ জোট সম্পূর্ণভাবে কৌশলগত।
ভিওএ : বাংলাদেশের সঙ্কট নিরসনে বাইরের, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের, প্রাচ্যের হস্তক্ষেপ আপনাকে বিব্রত করে কি?
খালেদা জিয়া : দেখুন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। কাজেই স্বাধীন দেশের মানুষই বাংলাদেশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এ ক্ষেত্রে আমরা অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপ পছন্দ করি না। আমরা মনে করি যেসব দেশ আমাদের সাহায্য করে, সে ক্ষেত্রে তারা কথাবার্তা বলতে পারে। কিন্তু এ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের হস্তক্ষেপ কখনো আমরা সমর্থন করি না। এটা তাদেরও যেমন কাম্য নয়, একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদেরও কাম্য নয়।
ভিওএ : সাম্প্রতিক অস্থির পরিস্থিতিতে ব্যবসায়, বাণিজ্য, গার্মেন্ট, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অচলাবস্থা, প্রাণহানি, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন এসবের দায় কার ওপর বর্তায় বলে আপনি মনে করেন?
খালেদা জিয়া : যা কিছু হচ্ছে, এর সব কিছুর দায় বর্তায় এ সরকারের ওপর। তাদের একগুঁয়েমি জেদের ওপরে। এই যে গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংসের পথে, এর জন্য সম্পূর্ণভাবে সরকার দায়ী।
সরকারদলীয় লোকজনেরাই এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। বিভিন্ন গার্মেন্টে যে সন্ত্রাস হচ্ছে এসব সরকারদলীয় লোকজন করছে। আপনারা দেখছেন কিভাবে তারা মানুষ হত্যা করছে, গুম করছে, বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে।
বাসের মধ্যে আগুন দিচ্ছে তারা, ধরা পড়ছে তারা, কিন্তু সরকার তাদেরকে ধরছে না। ধরলেও ছেড়ে দিচ্ছে।
সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর তারা পুড়াচ্ছে। অতীতে যদি দেখেন এই সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, জমি-জায়গা, তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সব কিন্তু আওয়ামী লীগই দখল করেছে এবং এখনো করছে। তারা তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের অধীনে চেপে রাখতে চায়। যাতে তারা তাদের স্বাধীন চিন্তাধারা, স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে না পারে। সংখ্যালঘুদের সাথে তারা খারাপ আচরণ করে, ভয়ভীতি দেখায়। এখনো তারা এসব করছে এবং পুলিশের সামনেই এসব করছে। পুলিশ তাদের ধরছে না। পুলিশ ধরছে না তার কারণ, যেহেতু এরা সরকারি দলের লোক। সরকারের আদেশ নির্দেশ আছে, তাদেরকে না ধরার। এই অশান্তি আমরা চাই না। আমরা চাই শান্তি এবং আমরা মনে করি বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে সব ধর্মের সমান অধিকার আছে। আমরা সব ধর্মের লোক নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
ভিওএ : বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম এই শব্দগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
খালেদা জিয়া : অবশ্যই আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। কাজেই স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি বলেন, সেই চেতনা আমাদের মধ্যে আছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? গণতন্ত্র, জনগণের অধিকার, মানবাধিকার, বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ নয়। বাংলাদেশের উন্নতি অগ্রগতিÑ জনগণের দ্বারাই হবে। সেটাই আমরা চাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য এ দেশের মানুষ সব সময় সচেতন। বাংলাদেশের জনগণ যে যতই ভাবুক না কেন, যে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, এ দেশের মানুষ কখনোই নিজেদের সার্বভৌমত্বের ওপর কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেবে না এবং আমি সব সময়ই জনগণের সাথে ছিলাম, জনগণের জন্য, সার্বভৌমত্বের জন্য কাজ করেছি, অতীতেও করেছি এবং ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও জনগণের সাথে থাকব।
দেশের পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত খারাপ, অত্যন্ত ভয়াবহ এবং আমি বলতে চাই দেশে এখন একদলীয় সরকার চলছে, একদলীয় নির্বাচন করেছে। এই সরকার সারাজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশের মানুষকে গুম করছে, হত্যা করছে। যারা এসব জুলুম অন্যায়-অত্যাচার নিয়ে একটু কথা বলে, দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে তাদের ওপরই চলে নির্যাতন।
আজকের বাংলাদেশে জেলখানা বিএনপি ও অন্য নেতাকর্মীদের দিয়ে ভরিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী জেলে রয়েছেন। অসংখ্য নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে। গুম, হত্যা প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে, যেটা সরকার পত্রিকায় আসতে দেয় না। মিডিয়াকেও তারা কন্ট্রোল করছে এবং চ্যানেলগুলোতেও এসব বিষয় আসতে দেয় না। সবকিছুই এখন সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে।
ভিওএ : আপনি আমাদের সাথে কথা বললেন, আমাদেরকে সময় দিলেন। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
খালেদা জিয়া : আপনাকেও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ