রবিবার, মে ১৯, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়ফিরে দেখা ২০১৩: কান্নার বছর দুর্ভোগ, কষ্ট ও কান্নার বছর

ফিরে দেখা ২০১৩: কান্নার বছর দুর্ভোগ, কষ্ট ও কান্নার বছর

কুড়িয়ে পাওয়া ককটেল নিয়ে খেলতে গিয়ে মারা গেল অবুঝ শিশু রিয়া ও কুলসুম। পেট্রলবোমায় অগ্নিদগ্ধ মন্টু পাল চলে গেল দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে। আগুনের আলিঙ্গন থেকে বাঁচতে প্রতিবন্ধী আবদুল মান্নান চলাফেরার অবলম্বন ক্র্যাচ ছাড়াই লাফ দিয়ে জীবন বাঁচাল।
এমন নিষ্ঠুর ও অমানবিক অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী ২০১৩। চরম দুর্ভোগের আর কান্নাভেজা এই বছরটিতে রাজনৈতিক সংকটের জের ধরে সর্বস্তরের নাগরিক বিশেষ করে সাধারণ, দরিদ্র ও নিরীহ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় হাবুডুবু খেয়েছে।
‘যে পুলিশের কাজ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া, তাদের ওপর একের পর এক হামলা হচ্ছে। তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কে দেবে?’—এই প্রশ্ন তুললেন বাংলামোটর এলাকায় অবস্থিত একটি ভবনের নিরাপত্তাকর্মী আবদুল মোমেন। গত মঙ্গলবার রাতে বাংলামোটর মোড়ে দুষ্কৃতকারীদের পেট্রলবোমায় পুলিশ সদস্য ফেরদৌস খলিল (৪২) মারা যাওয়ার পর এ মন্তব্য করেন তিনি।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত দুই মাসেই পেট্রলবোমা, ককটেল বা রাজনৈতিক আগুনে পুড়ে মারা গেছে ৬৬ ব্যক্তি, আহত ব্যক্তির সংখ্যা চার শতাধিক। তাদের প্রায় সবাই নিরীহ পথচারী অথবা শ্রমজীবী।
সাম্প্রতিক সময়ে অগ্নিদগ্ধ মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটসহ বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্র। রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের আগুনে পোড়া যন্ত্রণাকাতর মানুষের আর্তনাদ, উদ্বিগ্ন স্বজনদের দীর্ঘশ্বাস, আর সন্তানহারা মায়ের আহাজারি এখনো থামেনি। অগ্নিদগ্ধ গৃহবধূ গীতা সেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সামনে পেয়ে তীর্যক মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আমাদের স্বামীরটা খাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।…আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।’ অগ্নিদগ্ধ সবার মনোভাবই গীতা সরকারের মতোই।
যাতায়াত ও জীবনযাত্রায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ: বিদায় বছরে রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে যানজটের চেয়েও বেশি ছিল যানশূন্যতা। ঘরের বাইরে বের হওয়া মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত ও ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত হয়ে ঘরে ফিরেছে। আর যেদিন রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকেনি, জমে থাকা কাজ শেষ করতে মিছিলের মতো মানুষ নেমেছে রাস্তাঘাটে। সেদিন যানজটে স্থবির থেকেছে শহর। এ বছরের বেশির ভাগ সময় গাড়িওয়ালাদের বের হতে হয়েছে গাড়ি রেখে। শত শত গাড়ি আগুনে পুড়েছে, ভাঙচুর করা গাড়ির সংখ্যাও অগণিত।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে সারা দেশে হরতাল ও বিভিন্ন সহিংসতায় যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা মূল্যের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত আগুনে পুড়ে গেছে মোট ৬৭৪টি যানবাহন। গত দুই মাসে পোড়া গাড়ির সংখ্যা ও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অন্যান্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে।
যানবাহন মালিক বা চালকদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে বছরজুড়ে। মালিকদের প্রায় সবারই রয়েছে ব্যাংকঋণ। এসব ঋণের কিস্তিও আটকে গেছে। গাড়িচালক মোক্তার হোসেন (৫৪) নিজে একটি গাড়ি চালান। ব্যংকঋণ নিয়ে আরেকটি গাড়ি কিনেছেন, সেটি ভাড়া দিয়ে যে টাকা পান, তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করেন। হাতিরপুল এলাকায় বসবাসকারী ওই চালক বললেন, ‘ঋণের টাকা দেওয়া দূরে থাক, দুই মাস বাসা ভাড়া দিতে পারছি না। স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে খুবই কষ্টে আছি।’
ককটেল হামলার বছর: সন্তান যাবে স্কুল বা কলেজে। কিন্তু মা-বাবার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। এই বুঝি বুক হিম করা কোনো দুঃসংবাদ আসবে। বাবা বা স্বামী অফিসে অথবা কর্মক্ষেত্রে যাবেন। অথচ আতঙ্ক ঘিরে ছিল পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে। রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক ককটেল বা বোমাবাজি হয়েছে এ বছর।
সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সিএনজি অটোরিকশায় লোহার শিকের বেড়া দেওয়া হয়েছিল ছিনতাই বা ডাকাতি থেকে রেহাই পেতে। কিন্তু গত কয়েক মাস অটোরিকশার গেট খুলে বা ছিটকানিতে হাত রেখে চলাচল করেছি। কারণ, ককটেল হামলা বা পেট্রল ঢেলে আগুন লাগানোর ভয়।’
শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার বছর: চারটি পাবলিক পরীক্ষা, স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার ভর্তি পরীক্ষা একের পর এক পিছিয়েছে এ বছরের শেষ ভাগে এসে। প্রায় চার কোটি পরীক্ষার্থী হয়রানি ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করেও দিশা পায়নি শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।
সরকারি হিসাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন কোটি ৭০ লাখ। এর বাইরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে আরও প্রায় ৩০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে।
বছরের শেষ ভাগে পরীক্ষার মৌসুমে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছিলেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। স্থবিরতা নেমে আসে শিক্ষা কার্যক্রমে। পাঠ্যবই পড়ানো শেষ হয়নি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। পরীক্ষা আংশিক নিয়ে বছর শেষ করেছে কিছু প্রতিষ্ঠান।
রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং সরকারি ছুটি হিসাব করে দেখা গেছে, বিদায় বছরে ২০০ দিনেরও বেশি বন্ধ ছিল অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে শেষ দুই মাসে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক কর্মদিবস না পেয়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্লাস-পরীক্ষা নিয়েছে।
গত ৪ নভেম্বর শুরু হওয়া জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেটের (জেএসসি) ১১টি বিষয়ের পরীক্ষার মধ্যে ছয়টি পরীক্ষাই পেছাতে হয়েছে। বারবার হরতাল-অবরোধের কারণে গত ২০ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার্থীদের দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়। ওই পরীক্ষায় অংশ নেয় ২৯ লাখ ৫০ হাজার শিশু। এর আগে গত এপ্রিলে শুরু হওয়া উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা আট দিন পেছানো হয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে হরতালের কারণে ছয় দিনের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা পেছানো হয়েছিল।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনিতেই সেশনজট বিদ্যমান। বারবার পরীক্ষা পেছানোর কারণে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আগে যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির আগে পরীক্ষার বিষয়টি চিন্তা করা হতো। এখন ওই চিন্তা কেউ করেন না। পদ্মা সেতু নির্মাণ না হওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব, কিন্তু শিক্ষার যে ক্ষতি এ বছর হয়েছে, তা কখনো পূরণ হবে না।
বছরজুড়ে শুধুই হাহাকার: সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ছাড়াও বছরজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিল চরম মন্দা অবস্থা। ব্যবসায়ীরা সাদা পতাকা হাতে রাস্তায় নেমে শান্তির ডাক দিয়েছেন। এর আগে ভিক্ষার থালা হাতে নিয়ে প্রতীকী প্রতিবাদ জানিয়েছেন খুদে ব্যবসায়ীরা।
দুর্ভোগের ওই বছরে কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পায়নি, বিশেষ করে শাক-সবজির উৎপাদন খরচ তুলতে পারেনি অনেকেই। কারখানা বন্ধ থাকায় শ্রমিকের কাজ ছিল না। ছোট ও দুর্বল কারখানা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে কর্মরতদের বেতন আটকে গেছে। গার্মেন্টস খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। হোটেল ও পর্যটন শিল্পে চলছে হাহাকার। বছরজুড়ে যে সংকট, সহিংসতা ও দুর্ভোগ চলেছে, তা নতুন বছরের দিকেও গড়াচ্ছে। অর্থাৎ বছর শেষ হতে চললেও দুর্ভোগের শেষ হয়নি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ