বৃহস্পতিবার, মে ২, ২০২৪
প্রচ্ছদঅর্থ ও বানিজ্য সময়অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ন্যাশনাল ব্যাংক

ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে ব্যাংকটি

অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ন্যাশনাল ব্যাংক

একসময়ের ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ন্যাশনাল ব্যাংক ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকের পথপ্রদর্শক এ ব্যাংকটি অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বেসরকারি খাতের সর্বপ্রথম ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ব্যাংক। ১৯৮৩ সালের মার্চে ব্যাংকটি উদ্বোধন করা হয়। চার দশক আগে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটি বেসরকারি ব্যাংক তৈরিতে পথিকৃৎ। ন্যাশনাল ব্যাংকের দেখাদেখি বর্তমানে দেশে ৪০টিরও বেশি বেসরকারি ব্যাংক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ ব্যাংকটি থেকে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, সরকারও সুবিধা নিয়েছে। বর্তমানে বেশিরভাগ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ন্যাশনাল ব্যাংকে চাকরি শুরু করেছেন। অথচ সেই ব্যাংকটিই এখন ধুঁকছে।

প্রতিষ্ঠার চার দশক পর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে ন্যাশনাল ব্যাংক। এর মধ্যে ২০২২ সাল থেকে এ চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকটির সার্বিক সম্পদ কমেছে ১৩ শতাংশ। এছাড়া গেল বছর ব্যাংকটি কোনো আয় করতে পারেনি। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ঋণের সুদ বাবদ লাভের পরিবর্তে উল্টো লোকসান গুনেছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। অথচ যেকোনো ব্যাংকের মুনাফা হয় সুদ থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়েই।

এদিকে ২০২৩ সালেও লোকসান গুনছে ব্যাংকটি। বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ব্যাংকটির সুদ খাতে লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫০৬ কোটি টাকা। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকটির সার্বিক ব্যবস্থাপনায়। ২০২২ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের নিট লোকসান ছিল ৩ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। চলতি বছরের শুরুর ৬ মাসেই অপারেটিং বা পরিচালন ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ৬২০ কোটি টাকারও বেশি।

ব্যাংকটির অবস্থা এতই খারাপ যে এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর), ঋণ-আমানত অনুপাত (এডি রেশিও), মূলধন, সঞ্চিতিসহ (মুনাফার অংশ বিশেষ দিয়ে গঠিত তহবিল) কোনো শর্তই ব্যাংকটি পূরণ করতে পারছে না ন্যাশনাল ব্যাংক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকটির সাবেক এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, একসময়ের সবচেয়ে ভালো এ ব্যাংকটির এ দুর্বল অবস্থার জন্য দায়ী অনিয়ম-দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা। এছাড়া পরিচালনা পর্ষদ ও প্রভাবশালীদের অনিয়মের বলি হতে হয়েছে ব্যাংকটিকে।’

ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ খারাপ বা মন্দ ঋণ। এসব ঋণ থেকে ব্যাংকটির কোনো আয় নেই। চলতি বছরের জুন শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৪২ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা উঠেছে খেলাপির খাতায়। মামলায় আটকা পড়েছে ৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। বাকি টাকা এখনো খেলাপি না হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ। আদায় অযোগ্য হওয়ায় অবলোপন করা হয়েছে আরও ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকার ঋণ।

তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, এ ব্যাংকটির দেওয়া তথ্যে অসংগতি ধরা পড়েছে। ব্যাংকটি অনেক তথ্য লুকিয়ে কিংবা ভুল তথ্য উপস্থাপন করে প্রতিবেদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এ কারণে ব্যাংকটিকে সতর্কও করা হয়েছে।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলেন, এ ন্যাশনাল ব্যাংকে সর্বপ্রথম সমস্যা শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ, জনবল নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালকদের অনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে দূর্বল হতে শুরু করে। সিকদার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জয়নুল হক সিকদারের হাতে থাকা ব্যাংকটির অবস্থা আরও ভয়াবহ হয় তার বড় ছেলে রণ হক সিকদারের একচ্ছত্র ক্ষমতায়। তবে সম্প্রতি রণ হক সিকদারকে ব্যাংক থেকে মূলত অকার্যকর করে রেখেছেন জয়নুল হক সিকদারের স্ত্রী ও বর্তমানে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি রণ হক সিকদারকে ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় অংশ না নেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছে বলে জানা গেছে।

ব্যাংকটির অব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এর প্রধান কার্যালয় নির্মাণ। ২০০৯ সালে তৈরি করা শুরু হলেও ২০২৩ সালে এসেও ১৪ বছরে নির্মাণ শেষ হয়নি ভবনটির। প্রধান কার্যালয় নির্মাণ করতে গিয়ে এরই মধ্যে বর্গফুটপ্রতি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭৩২ টাকায়। যা অন্যান্য ব্যাংকের কার্যালয় নির্মাণ খরচের চেয়েও অনেক বেশি। ২০২১ সাল থেকে অর্থের অভাবে ভবন নির্মাণ বন্ধ রয়েছে বলে জানায় ব্যাংকটির একটি সূত্র।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র অনুযায়ী, ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় নির্মাণে অনুমোদন ছিল ১৯৫ কোটি টাকা। যদিও এরই মধ্যে ব্যয়ের পরিমাণ অনুমোদনের পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ভবন নির্মাণে খরচ দাঁড়িয়েছে ৫২৩ কোটি টাকায়। তবুও নির্মাণ শেষ হয়নি প্রধান কার্যালয়ের।

অব্যবস্থাপনার অন্যতম নিদর্শন ছিল ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহীর পদত্যাগ। ২০২১ সালের শেষের দিকে ন্যাশনাল ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্ব নেন মেহমুদ হোসেন। তবে ব্যাংক পরিচালনায় তার স্বাধীনতা খর্ব করায় গত বছরের জানুয়ারিতে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে স্বপদে ফেরেন।

দেশের প্রথম প্রজন্মের একঝাঁক শিল্প উদ্যোক্তার সম্মিলিত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল ব্যাংক। কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৩ সালের ২৮ মার্চ। বর্তমানে সারাদেশে ২২১টি শাখা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ব্যাংকটি। ২০০৯ সালের পর ব্যাংকটির পর্ষদ থেকে উদ্যোক্তা পরিচালকদের অনেকেই ছিটকে পড়েন। কর্তৃত্ব বাড়ে জয়নুল হক সিকদার ও তার পরিবারের।

ন্যাশনাল ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির মোট সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ ছিল ৫৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি ২০২৩ সালের জুন শেষে মোট সম্পদ ও দায় নেমে এসেছে ৫০ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকায়। অর্থাৎ গত দেড় বছরে ব্যাংকটির সম্পদ কমেছে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ সময়ে আমানত ও বিতরণকৃত ঋণ দুটোই কমেছে ন্যাশনাল ব্যাংকের।

বেনামি ঋণ ও ঋণ বিতরণে অনিয়ম ঠেকাতে ২০২১ সালের ৩ মে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রভাবশালীদের তদবির ও চাপের মুখে অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ বিতরণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এরপর আবারো পরিস্থিতির অবনতি হলে ২০২২ সালের মে মাসে বড় ঋণ বিতরণে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তিন মাস পর ফের ঋণ বিতরণ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তবে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি তৃতীয় দফায় ব্যাংকটির বড় ঋণ বিতরণে বিধিনিষেধ আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ ব্যাংকটির খারাপ অবস্থা হওয়ার পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও দায় রয়েছে। ব্যাংকটিকে নিয়মমাফিক চালাতে না পারার দায় নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককেও। প্রভাবশালীদের তদবির ও চাপে বিভিন্ন সময়ের নেওয়া পদক্ষেপ থেকে ফিরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে করে অন্যায় ও দুর্নীতিবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এছাড়া গত এক দশকে ন্যাশনাল ব্যাংকে যা হয়েছে সেটিকে ব্যাংকিং বলা যায় না। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ যা চেয়েছে সেটিই হয়েছে। বিভিন্ন নিরীক্ষায় সেগুলো ধরা পড়লেও অজ্ঞাত কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিরব ছিল। পরিস্থিতি যে জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, সেটি থেকে উত্তরণ ঘটানো খুবই কঠিন।

এদিকে বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি থেকে কোনো আয় না থাকলেও গত বছর দুই হাজার ৩৪৭ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে দিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক।

ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি বড় কিছু গ্রাহকের কাছে কেন্দ্রীভূত। মাত্র ২৮টি শিল্প গ্রুপের কাছে থাকা ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে কিছু গ্রাহকের একাধিক বেনামি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, বড় গ্রাহকদের দুই-একজন ছাড়া কেউই টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। জামানত ছাড়াই বেশির ভাগ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এসব ঋণ যে আদায় হবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বলতার কারণে ন্যাশনাল ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হয়েছে বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ন্যাশনাল ব্যাংক খুবই ভালো ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃত ছিল। ব্যাংকটির কর্মকর্তারা দেশের ব্যাংক খাতের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এখন ব্যাংকটির যে পরিস্থিতি সেটি মোটেই ভালো নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে এ পরিস্থিতি হতো না। এখন বাঁচাতে হলে ন্যাশনাল ব্যাংককে অন্য যেকোনো সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দিতে হবে। অন্যথায় ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।

সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে বেশ কয়েকবার ফোন করা হয় ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহমুদ হোসেনকে। তবে তিনি ফোন ধরেননি। পরিচয় ও প্রশ্ন করে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যাংকটির এখন যে অবস্থা তাতে এ ব্যাংকটিকে মৃত ঘোষণা করা বাকি। ব্যাংকটি ক্লিনিক্যালি ডেড। এরকম ব্যাংক বাঁচিয়ে রেখে কোনো লাভ হয় না তার জ্বলন্ত উদাহরণ পদ্মা ব্যাংক। ব্যাংকটিকে অবসায়ন করে দেওয়াই উচিত। (ঢাকা টাইমস)

আরও পড়ুন

সর্বশেষ