বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়থমকে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

থমকে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে গণহত্যার জেরে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় অন্তত সাত লাখ রোহিঙ্গা। এরই মধ্যে সংখ্যাটি ছাড়িয়েছে ১২ লাখ। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো রাখাইনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যার স্বীকৃতি দিলেও মিয়ানমারকে চূড়ান্ত বিচারের আওতায় আনা যায়নি এখনও।

 সংকটের শুরু যেভাবে

২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের তিনটি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ঘটনায় ৯ পুলিশসহ ১৮ ব্যক্তি নিহত হয়। এ ঘটনার পর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয় কয়েক হাজার ঘরবাড়ি। হেলিকপ্টার ও বিমান থেকে রোহিঙ্গাদের গ্রামে বোমা হামলা, নারীদের ধর্ষণ, গুলি করে হত্যাসহ বিভিন্নভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর দমনপীড়ন শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ২০১৬-১৭ সালে রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে গণহত্যা চালায় দেশটির জান্তা সরকার। জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞকে জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

রোহিঙ্গার সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১২ লাখ

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নামে। তাদের আশ্রয় হয় কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে। বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির এখন এ কক্সবাজার। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭২ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৩। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করছে বলে জানা গেছে। এ হিসেবে ৪ বছরে রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

থমকে আছে প্রত্যাবাসন

২০১৭ সালে এ সংকটের শুরুতে স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের স্বাগত এবং তাদের নানাভাবে সহায়তা করলেও স্থানীয় জনসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি এ রোহিঙ্গা এখন তাদের গলার কাঁটা হয়ে ওঠেছে। মানবিক কারণেই বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয় দেয়। তবে এতে শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বেড়ে চলা এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ নানা কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হলেও মিয়ানমারের গড়িমসিতে থমকে আছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া।

মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালে সীমান্তে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর দেশটির সরকার নিজ দেশের নাগরিকদের ফেরত নিতে ওই বছরই বাংলাদেশে সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। তবে সেই চুক্তি অনুযায়ী, একজনকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার সরকার। দেশটির সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই প্রত্যাবাসন সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

গত বছর জানুয়ারিতে মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের মধ্যস্থতায় একটি বৈঠকের পর প্রত্যাবাসন শুরুর আশা করা হয়েছিল। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দুই দেশের ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও পহেলা ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে অং সান সু চির সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সামরিক জান্তা। সু চিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং ক্ষমতা দখলের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসনের কাজ অগ্রসর হয়নি আর।

২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর চলতি বছরের শুরুতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দুই দেশের নবগঠিত ‘অ্যাড-হক টাস্কফোর্স ফর ভেরিফিকেশন অব দ্য ডিসপ্লেসড পার্সনস ফ্রম রাখাইন’-এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ত্রিপক্ষীয় এ বৈঠকের আগে সরকার বলেছিল, ছয় দফায় মোট ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ, যার মধ্যে মাত্র ৪২ হাজারের ‘ভেরিফিকেশন’ শেষ করেছে মিয়ানমার। আটকে থাকা ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে জটিলতা ও ঘাটতি দূর করতে পারলে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে বলে আশা বাংলাদেশের।

আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা

জাতিসংঘের সর্বোচ্চ বিচারিক সংস্থা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা করে গাম্বিয়া। গাম্বিয়া ও মিয়ানমার দুই দেশেই ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ।

অভিযোগে গাম্বিয়া বলে, রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস সামরিক অভিযান চালানোর মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার। কানাডা, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, তুরস্ক এবং ফ্রান্স জোর দিয়ে জানায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। ইসলামী দেশসমূহের সংগঠন ওআইসি তার ৫৭টি সদস্য দেশকে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে তোলার কাজে সহায়তা করে। একই বছরের ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর এ মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গাম্বিয়ার পক্ষে মামলার শুনানিতে নেতৃত্ব দেন দেশটির বিচার বিষয়কমন্ত্রী আবুবকর তামবাদু।

অন্যদিকে মিয়ানমারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন দেশটির নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি। সে সময় শুনানিতে মামলাকারী গাম্বিয়া রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যাতে আর কোনো ধরনের সহিংসতার ঘটনা না ঘটে সে লক্ষ্যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ৫টি আদেশ চেয়েছিল। শুনানির পর ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় অন্তর্বর্তীকালীন রায়ে মিয়ানমারের প্রতি চারটি নির্দেশনা দেয় আইসিজে। রাখাইনে বসবাসরত ঝুঁকিতে থাকা সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমকে সুরক্ষা দেবার জন্য মিয়ানমার সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লাগাম টেনে ধরতে নির্দেশ দেন আদালত।

আদালত বলেন, সেনাবাহিনী কিংবা অন্য যে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বাহিনী যাতে গণহত্যা না চালায় কিংবা উস্কানি না দেয় সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রোহিঙ্গা গণহত্যা সংক্রান্ত যেসব অভিযোগ এসেছে, সে সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষণ করারও নির্দেশ দেন আইসিজে।

মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ

মিয়ানমারের সামরিক সরকার দেশটিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর মামলার শুনানি প্রশ্নে গেল বছর আপত্তি জানায়। গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়া মামলা করার পর অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি কয়েকটি আপত্তি জানিয়েছিল মিয়ানমার সরকার।

মিয়ানমারের দাবি, গাম্বিয়ার এ মামলা করার অধিকার নেই এবং এই আদালতের বিচার করার এখতিয়ার নেই। তবে দীর্ঘ শুনানির পর চলতি বছরের জুলাইয়ে মিয়ানমারের সেসব আপত্তি খারিজ করে দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে গণহত্যা মামলা চলার পক্ষে রায় দিয়েছেন জাতিসংঘের সর্বোচ্চ বিচারিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা আন্তর্জাতিক বিচার আদালত। ১৬ সদস্যের আদালতে ১৫-১ ভোটে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ফলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে যে মামলা করেছে গাম্বিয়া, তার বিচারকার্য অব্যাহত থাকবে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় গ্রহণের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেহেতু আইসিজেতে মামলা করেনি, তাই গাম্বিয়া কোনোরকম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ না হয়ে মামলা করার অধিকার রাখে না বলে দাবি মিয়ানমারের। তবে আদালত বলেন, গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী যেকোনো দেশ অন্য দেশের গণহত্যা প্রতিকারের স্বার্থে মামলা করতে পারে, তাতে তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় না।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ