শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
প্রচ্ছদদেশজুড়েওসি প্রদীপের স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক

ওসি প্রদীপের স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক

ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে টেকনাফের বরখাস্ত হওয়া আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তাঁর স্ত্রী চুমকি কারনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রোববার বিকেলে ৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত আয়ের অভিযোগে দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ মামলাটি দায়ের করেন সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর সহকারি পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন। এরআগে রোববার সকালে প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেন দুর্নীতি দমন কমিশন। মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৬(২)/২৭(১), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২), ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারাসহ দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। মামলায় প্রদীপ ও তাঁর স্ত্রীকে আসামী করা হলেও প্রদীপের ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ-সম্পদ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তর করার অভিযোগ থাকলেও শ্বশুর অজিত কুমার কারনকে আসামি করা হয়নি। এব্যাপারে মামলার বাদী সহকারি পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তদন্তে প্রদীপের শ্বশুর অজিত কুমার কারনের বিরুদ্ধে অপরাধের সত্যতা পাওয়া গেলে তাঁকেও আইনের আওতায় আনা হবে।’ প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ইন্সপেক্টর লেয়াকত ও ওসি প্রদীপের গুলিতে প্রাণ হারান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিহনা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এঘটনায় নিহত রাশেদের পরিবার কক্সবাজার আদালতে মামলা করলে আদালত মামলাটি এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করার জন্য টেকনাফ থানাকে নির্দেশ দেন। ওই মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত ওসি প্রদীপকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। মামলাটি আদালতের নির্দেশে র‌্যাব তদন্ত করছে।
দুদক সুত্রে জানা গেছে, ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারনের বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী জারি করে দুদক। পরবর্তীতে ১২ মে তাঁরা দুদকে সম্পদ বিবরণী জমা দেন। ওই সম্পদ বিবরণীতে ৪ কোটি ২২ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬৯ টাকার স্থাবর অস্থাবর সম্পদ থাকার তথ্য প্রকাশ করেন। এরমধ্যে দুদক সম্পদ বিবরণী যাচাই করে ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার তথ্য পান। একই সাথে ঘোষিত সব সম্পদ অর্জনের স্বপক্ষে আয়ের কোন ডকুমেন্ট উপস্থাপন করতে পারেননি। এরমধ্যে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকার সম্পদ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত আয়ের মাধ্যমে অর্জন করেন বলে প্রমাণ পান অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা।
প্রদীপের স্ত্রী চুমকি কারন তার পিতা অজিত কুমার কারনের কাছ থেকে দানপত্রমূলে জমিসহ একটি ৬ তলা বাড়ি দানপত্র হিসেবে পান বলে সম্পদ বিবরণীতে প্রকাশ করেন। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রাম সদর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে দানপত্র দলিলটি (নং-১১৮৮২) সম্পাদন হয়। দুদক অনুসন্ধানে জানতে পারে, প্রদীপের ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয়ের মাধ্যমে বাড়িটি তাঁর শ্বশুর নেন। যা পরে প্রদীপের স্ত্রী চুমকি কারনকে (অজিত কুমার কারনের মেয়ে) দানপত্র করেন।

এজাহারে বলা হয়, চুমকির পিতা বাড়িটি দানপত্র করে দিলেও তাঁর (চুমকি) অন্য দুই ভাই ও এক বোনকে কোনো বাড়ি দান করেননি। অথচ তার দুই ছেলের নামে উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদও নেই। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ তার ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ গোপন করতে তার শ্বশুরের নামে বাড়ি নির্মাণ করে পরে তার স্ত্রীর নামে দানপত্র করে নিয়ে ভোগ দখল করছেন। মামলায় অভিযোগে বলা হয়- “চুমকি একজন গৃহিনী হলেও তাকে কমিশন ব্যবসায়ী ও মৎস্য ব্যবসায়ী হিসেবে সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। চুমকি কমিশন ব্যবসায়ী হিসেবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রথম আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। পরবর্তীতে মৎস্য ব্যবসা ও বাড়ি ভাড়া থেকে আয় দেখিয়ে আয়কর রিটার্ন দাখিল করে আসছেন। কিন্তু অনুসন্ধানে চুমকির নামে কোনো কমিশন ব্যবসার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
২০১৩ সাল পর্যন্ত চুমকি মৎস্য ব্যবসা থেকে দেড় কোটি টাকা আয়ের হিসাব আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ করেন। এর সপক্ষে ২০০২ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে পাঁচটি পুকুর নগদ সাড়ে ১৬ লাখ টাকায় ১০ বছরের জন্য ইজারা নেয়ার চুক্তিপত্র দুদকে দাখিল করেন। কিন্তু দুদক যাচাই করে দেখে, চুমকি একজন গৃহিনী এবং তার স্বামী ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ১৯৯৫ সালে এসআই হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। ২০০২ সালে তাঁর কিংবা তাঁর স্বামীর ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা সঞ্চয় ছিল না।
প্রদীপের স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব বিবরণীতে মৎস্য ব্যবসা সম্পর্কিত কোনো লেনদেন না পাওয়ার কথাও মামলায় উল্লেখ করেছেন বাদী। এজাহারে বলা হয়, “এতে প্রমাণিত হয় যে, আসামি চুমকি মৎস্য ব্যবসা থেকে কোনো আয় করেননি। তিনি তাঁর স্বামী প্রদীপ কুমার দাশের অপরাধলব্ধ অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তর করার অসৎ উদ্দেশে ভুয়া মৎস্য ব্যবসা প্রদর্শন করে উক্ত আয় দেখিয়েছেন।
দুদকের অনুসন্ধানকালে আসামী চুমকি কারন তাঁর আয়ের স্বপক্ষে কমিশন ব্যবসার লাইসেন্স, সরকারী কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে ব্যবসা করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতিপত্র, ব্যাংক হিসাবের লেনদেন বা অন্য কোন প্রামাণ্য রেকর্ডপত্র সরবরাহ করতে পারেননি বলে মামলার বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন। সবমিলিয়ে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকার সম্পদ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত আয়ের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই দৈনিক আজাদীতে “দুদকের জালে স্ত্রীসহ ১২ পুলিশ কর্মকর্তা, আছেন নগরীর তিন থানার ওসি, চট্টগ্রামে আগে দায়িত্ব পালন করা ৯জন, নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ” শীর্ষক মূল প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে প্রদীপের নাম উঠে আসে। কাততালীয়ভাবে ওই প্রতিবেদন প্রকাশের এক বছরের মধ্যেই চলতি বছরের ৩১ জুলাই রাতে মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ