শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
প্রচ্ছদটপআ.লীগের ‘গণকমিটি’র পেটে ভুঁইফোঁড় অনেকেই

আ.লীগের ‘গণকমিটি’র পেটে ভুঁইফোঁড় অনেকেই

বরগুনার মশিউর রহমান শিহাব আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য। এই পরিচয়ে তিনি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বিদ্যুতের সব সেক্টরে। এলাকায়ও এখন ‘বড় নেতা’ শিহাব, অর্থবিত্তেরও কমতি নেই তার। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কোনো সংগঠনের সঙ্গে কখনই জড়িত ছিলেন না এই শিহাব।

২০১৬ সালের সম্মেলনের পর উপকমিটির সদস্য হন কেন্দ্রীয় শীর্ষ পদের এক নেতাকে ‘বাগে এনে’। গণহারে চিঠি দিয়ে সদস্য করায় এ কমিটি পরিচিতি পায় গণকমিটি হিসেবে। রাজধানীর গুলিস্তানের রমনা ভবনে দর্জি দোকানের মাস্টার ছিলেন মনির হোসেন। ‘দর্জি মনির’ হিসেবেই বেশি পরিচিত তিনি। তিনিও ২০১৬ সালের পর আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য হন। এরপর তিনি ‘জননেত্রী পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন খোলেন। সেখানে বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপিকে নিয়ে অনুষ্ঠান করে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। তারপরই শুরু হয় দাপট। টেন্ডার-ঠিকাদারি সব সেক্টরে দাপুটে নেতা বনে যান।

শিহাবের মতো আরেকজন কুমিল্লার মোখলেস। তিনিও আওয়ামী লীগের ‘গণকমিটির’ সদস্য। রাজনৈতিক কোনো পরিচয় না থাকলেও আওয়ামী লীগের সাবেক এক সাংগঠনিক সম্পাদককে ধরে তরতর করে উঠে যান রাজনীতিতে। গণকমিটির সদস্য নাম ভাঙিয়ে বড় বড় তদবির ‘ডিল’ করেন এই মোখলেস। এখন গাড়ির ব্যবসাও আছে তার। এরা সবাই ২০১৬ সালের পরে উপকমিটির নেতা বনে যান। ফ্রিডম পার্টির সাবেক ক্যাডার শাহজাহান বিপ্লবও আওয়ামী লীগের এই উপকমিটির সদস্য, যিনি মাদকের বড় ডিলার হিসেবে পরিচিত। ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সাবেক নেতা কবির হোসেনও ঠাঁই পেয়েছেন ‘গণকমিটিতে’।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির ‘বেহিসাবি’ সদস্যরাই একেকজন ‘সাহেদ’ হয়ে সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। করোনার ‘মনগড়া রিপোর্ট’ দিয়ে আলোচনায় আসা বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার মোহাম্মদ সাহেদ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপ-কমিটির সদস্য পরিচয়ে টক-শোতে কথাও বলতেন নিয়মিত।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলেন, ২০১৬ সালের পরে আওয়ামী লীগে বহু সাহেদের জন্ম হয়েছে। নিজের দল ভারী করতে যাকে তাকে নেতা বানিয়ে প্রটোকল নিয়েছে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। তারই ফল আজকে ভোগ করতে হচ্ছে। কতজন সাহেদকে কে কীভাবে নির্মূল করবে?

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও বলেন, দলের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটিই সাহেদ মার্কা নেতাদের জন্ম দেয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের অনুরোধে নাম পরিচয়হীন অনেকেই কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য হয়ে পড়েন এবং পরে দাপুটে নেতা বনে যান। হোমরাচোমরাও এরাই হন। আর এরাই দলের নাম ভাঙিয়ে ভাবমূর্তি নষ্ট করেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৬ সালে দলের জাতীয় সম্মেলনের পর কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য হন কমপক্ষে তিন হাজার জন। কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, এদের আমরা উপকমিটির সদস্য না বলে গণকমিটির সদস্য বলি। ওই সময় দলের দায়িত্বশীল কয়েক নেতা যাকে তাকে চিঠি দিয়ে, অনুরোধ করে উপকমিটির সদস্য বানিয়েছেন। চার বছরের মাথায় যার ফল পাওয়া যাচ্ছে। এরা অমুক ভাই, তমুক ভাইয়ের বিশেষ অনুরোধে উপকমিটির সদস্য হন। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, ২০১৬ সালের পর উপকমিটির সদস্য সংখ্যা বেহিসাবি হয়ে পড়ে।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য  বলেন, এমনও আছে আমাদের দলের কোনো এক নেতার বাসায় বিশাল বড় এক মাছ নিয়ে গিয়ে পরের দিন কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য হয়ে গেছেন। তিনি বলেন, যার বাসায় মাছ নিয়ে গেছেন ওই নেতা আরেক নেতার কাছে বিশেষ অনুরোধ করেন নেতা বানানোর। বিশেষ অনুরোধে ওই লোকটি পরে উপকমিটির চিঠি পেয়ে যান। কেন্দ্রীয় যেসব নেতা এসব চিঠি দিয়ে উপকমিটির সদস্য বানিয়েছেন তারা শুধু নিজের দল ও পকেট ভারী করার জন্য কাজটি করেছেন। কাকে বানাচ্ছেন, সেই লোক জামায়াত-বিএনপি না অন্য কোনো আদর্শের কি না তার কোনো খোঁজ নেননি।

ক্ষমতাসীন দলের সম্পাদকমণ্ডলীর আরেক সদস্য বলেন, ২০১৬ সালের সম্মেলনে বেশকিছু নতুন মুখ কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পান। আর ওইসব নতুন মুখের কাছে দলের পুরনো কোনো নেতা অনুরোধ করলেই বানিয়ে দিত উপকমিটির সদস্য। মূলত উপকমিটির মর্যাদা ওই সময়েই নষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালের সম্মেলনে নতুন যেসব নেতা হয়েছেন দুয়েকজন বাদে অধিকাংশ তাদের উপকমিটিতেই জঞ্জাল ঢুকিয়েছেন। তৈরি হয়েছে সাহেদদের মতো অনেক ভুঁইফোঁড় নেতা। সম্পাদকম-লীর ওই সদস্য বলেন, ‘দপ্তর, তথ্য, প্রচার ও আন্তর্জাতিক উপকমিটিতে ভুঁইফোঁড়দের আখড়া। এই উপকমিটির মাধ্যমে সাহেদদের উত্থান ঘটেছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, খেয়াল করলে দেখবেন ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা মিছিল করেছিলেন উপকমিটিতে না রাখার কারণে। তারা লিখিত অভিযোগও করেন কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। ওই আন্দোলন অনেকখানি জোরদারও হয়ে ওঠে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয়ে ওঠেনি। কথাটা এজন্য বলছি যে, নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে অমুকের অনুরোধ, তমুকের তদবির রাখতে গিয়ে বঞ্চিত হয়েছে ত্যাগী দুর্দিনের নেতারা। তাদের জায়গা উপকমিটিতে হয়নি। আর ভুঁইফোঁড়রা ঢুকে পড়েছে উপকমিটিতে, যার ফল আজকের সাহেদ। তিনি বলেন, ‘আগামীতেও আরও সাহেদ বের হবে। আমরা আবারও তাদের অস্বীকার করব, দায় নেব না।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘সর্বশেষ ২০১৯ সালের সম্মেলনের আগের সম্মেলন শেষ হওয়ার পর বেশকিছু অপরিচিত মুখ বিভিন্ন অসাধু উপায় ব্যবহার করে, কেউ আবার জাল-জালিয়াতি করে আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য হয়েছেন। তাদের কেউই বৈধ নন। তিনি বলেন, এখন উপকমিটির সদস্য কেউ নেই। কারণ সর্বশেষ সম্মেলনের পরে উপকমিটির সদস্যরা চূড়ান্ত হননি। এবার অধিকতর যাচাই-বাছাই করে উপকমিটির সদস্য করা হবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানও বলেন, গত সম্মেলনের আগের সম্মেলনের পর উপকমিটির নেতার সংখ্যা আসলে কত তা কেউ বলতে পারবে না। ওদের কাউকে বৈধ বলা যাবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগে এখন উপকমিটির সদস্য কেউ নন। কারণ সম্মেলনের পরে চূড়ান্তভাবে উপকমিটির সদস্য নির্বাচন করা হয়নি।

– দেশ রূপান্তর

আরও পড়ুন

সর্বশেষ