শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়গার্মেন্টস শ্রমিক বিক্ষোভের নেপথ্যে

গার্মেন্টস শ্রমিক বিক্ষোভের নেপথ্যে

ষ্টাফরিপোর্টার (বিডিসময়২৪ডটকম)

অব্যাহত শ্রমিক আন্দোলনের মুখে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও দেশের অর্থনীতির বৃহত্তম খাত তৈরি পোশাক শিল্প। নুন্যতম মজুরী ৮ হাজার টাকা করার দাবীতে কর্মবিরতি, বিক্ষোভ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, মহাসড়ক অবরোধ এবং সহিংসতা সৃষ্টির মাধ্যমে পুরো গার্মেন্টস সেক্টর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এ কারণে এ শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিক, মালিক ও ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

প্রতিদিন এ খাত ক্ষতির মুখ দেখছে কোটি কোটি টাকা। অন্যদিকে সহিংস আন্দোলনের সাথে কতিপয় শ্রমিক জড়িত থাকলেও অধিকাংশ শ্রমিকরা বিশৃঙ্খলা ও কারখানা বন্ধ রেখে দাবী আদায়ের পক্ষে নয়। ট্রেড ইউনিয়ন নামধারী এক শ্রেণীর কতিপয় নেতা ও বিদেশী ষড়যন্ত্র এসব সহিংস আন্দোলনের নেপথ্য ভূমিকা পালন করছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

তথাকথিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা কিছু কিছু শ্রমিকদেরকে উস্কানি দিয়ে সহিংসতার পথে নামিয়ে দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। অন্যদিকে মালিক শ্রমিক ও পোশাক কারখানা সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মালিক শ্রমিক উভয় পক্ষ আলোচনার মধ্য দিয়ে ফলপ্রসূ সিদ্ধান্তে আসতে চায়। সূত্র জানায়, মালিকপক্ষ শ্রমিকদের জন্য যুক্তিসংগত বেতন ভাতা বৃদ্ধি করতে আন্তরিক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে,  চলমান শ্রমিক আন্দোলনের সাথে ৯৯ ভাগ শ্রমিকদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। অল্প কিছু শ্রমিক সহিংস আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর এদের পেছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে ট্রেড ইউনিয়ন নামধারী কতিপয় শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। তারাই নানা অজুহাতে শ্রমিকদেরকে বিভিন্ন ইস্যুতে উত্তেজিত করে তুলছে। বেতনভূক্ত ও নানা অনৈতিক সুবিধাভোগী এসব নেতারা কিছু কিছু শ্রমিকদেরকে আন্দোলনে ঠেলে দিয়ে পুরো গার্মেন্টস সেক্টরকে অস্থির করে তুলছে । আর এসব আন্দোলনের পেছনে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী পার্শ্ববর্তী একটি দেশের গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেও মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক শিল্প মালিকরা।

গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ শ্রমিকরা জ্বালাও পোড়াও, ভাংচুর কিংবা সহিংস আন্দোলন পছন্দ করে না। তারা যুক্তিসংগত উপায়ে সরকার ও মালিকপক্ষের আলোচনা সাপেক্ষে বেতন বৃদ্ধির পক্ষে। তাদেরকে নিয়ে আন্দোলনের নামে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রেরও ঘোর বিরোধী। তাদের বক্তব্য, কর্মপরিবেশ যদি না থাকে, তবে উপার্জন করব কিভাবে।

গাজীপুরের হোতাপাড়া, বাঘের বাজার, কোনাবাড়ি, মৌচাক, বড়বাড়ি, চান্দনা চৌরাস্তা, টঙ্গী সহ বিভিন্ন এলাকার বেশ কিছু শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এভাবে সহিংস আন্দোলনকে তারা সমর্থন করেন না। যৌক্তিক ও শান্তিপূর্ণ আলোচনায় তারা বিশ্বাসী।

ওডেশা সোয়েটার কারখানার শ্রমিক রাহেলা খাতুন জানান, কয়েকদিন যাবত আন্দোলনের নামে যেগুলো হচ্ছে আমরা এগুলো সাপোর্ট করি না। প্রতিদিন সকালে কারখানায় আসি কাজ করতে। কিন্তু বহিরাগত কিছু শ্রমিকের বাধার কারণে মালিকরা কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। আমরাও কাজ বাদ দিয়ে বাসায় চলে যাই।

পশমী সোয়েটার কারখানার শ্রমিক আঞ্জু আরা বেগম জানায়, শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর দাবী যৌক্তিক। বর্তমান বাজারে সব জিনিসের দাম বেশী। কিন্তু আমাদের বেতন বাড়েনি দীর্ঘদিন ধরে। সরকারের উচিৎ মালিক পক্ষের সাথে আলোচনা করে ন্যুনতম বেতন ঠিক করা।

গাজীপুর সদর উপজেলার মনিপুর এলাকায় অবস্থিত এলিগেন্ট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শ্রমিক রুবেল(২৪) জানায়, আন্দোলনের সাথে জড়িত না থাকলেও মালিক পক্ষ গত ৪দিন আগে প্রায় ৩শ শ্রমিককে চাকরীচ্যুত করেছে। যারা আন্দোলন করে তারা পার পেয়ে যায়, আর আমরা যারা কাজ করি, তারাই ভোগান্তির শিকার হই। সামনে ঈদ, বাবা মা পরিবার নিয়ে সুন্দরভাবে ঈদ করতে চাই। এ মুহূর্তে চাকরী চলে গেলে ঈদের আগে কোথাও চাকরী পাব না । ঈদ বোনাস, বেতন না পেলে ঈদ করবো কিভাবে? আমরা চাই বিষয়টির একটি সুন্দর সমাধান। যত তাড়াতাড়ি এ সমস্যার সমাধান হবে, সবার জন্যই তা মঙ্গল হবে।

অন্যদিকে শ্রমিক লালন (২০)জানালেন,  কারখানার ভিতরে আমাদের যারা বস আছেন, মালিক আছেন, উপরের অফিসার আছেন তারা আমাদেরকে মানুষ মনে করেন না। খুব খারাপ  আচরণ করেন। কখনো কখনো মারধরও করেন।

এদিকে গাজীপুরে বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানার মালিক ও কারখানা সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে,  শ্রমিকদের দাবীকৃত ৮ হাজার টাকা ন্যুনতম বেতন বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও যুক্তিসংগত বেতন বাড়াতে তাদের কোন আপত্তি নেই। এ ব্যাপারে মালিকরা খুবই আন্তরিক বলে জানা গেছে। মালিক পক্ষের মতে, শ্রমিকদের দিয়েই মালিকরা ব্যবসা করছে। কাজেই তাদের দিকটি দেখতে হবে। তবে এ বিষয়ে দ্রুত একটি সিদ্ধান্তে আসা দরকার। দেশের স্বার্থে, শ্রমিক মালিকদের স্বার্থে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছা জরুরী। তা না হলে, এ সেক্টর আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, যা দেশের অর্থনীতির উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে, পিক এপারেলস লিমিটেড এর জেনারেল ম্যানেজার (এডমিন এন্ড অপারেশন) মেজর (অব.) খন্দকার হেলাল হোসাইন জানান, চলমান আন্দোলনের সাথে আমাদের কারখানার অধিকাংশ শ্রমিকদের একটিভ পারটিসিপেশন নেই। তারা আন্দোলন করে না। তবে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর চাহিদা আছে, তাদের দুঃখ আছে, কস্ট আছে। তাদের দাবী যুক্তিসঙ্গত। কারখানার টপ লেভেলের লোকদেরকে এটা রিয়েলাইজ (উপলব্ধি)করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের শ্রমিকদেরকে খুব সহজেই মোটিভেট করা যায়। তাদের চাহিদাও খুব কম। দুবেলা ভাল খাবার, একটু ভাল কাপড় কিংবা সামান্য উন্নত বাসস্থান পেলেই তারা খুশি। তাই আন্দোলনের পূর্বে তাদেরকে বুঝিয়ে সহিংস পথ থেকে বিরত রাখা উচিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যত দ্রুত ভাল একটা রেজাল্ট পাওয়া যাবে, ততই এটা শ্রমিকদের জন্য ভাল, দেশের জন্য ভাল, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির জন্য ভাল।

ভোগড়া এলাকায় অবস্থিত দিগন্ত সোয়েটার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল উদ্দিন আহমেদ এর কাছে শ্রমিকদের দাবীকৃত ৮ হাজার টাকা ন্যুনতম মজুরী সম্পর্কে জানতে চাইলে এ ব্যাপারে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি। তবে তিনি বলেন, আমার জানা মতে ৯৯ ভাগ শ্রমিকরা কাজের সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ চায়, কোন বিশৃঙ্খল পরিবেশ তারা আশা করে না।

ছয়দানা মালেকের বাড়ী এলাকায় অবস্থিত দিপ নিটওয়্যার লিমিটেড এবং ফায়াত ফ্যাশন লিমিটেড এর পরিচালক আতিকুর রহমান আতিক জানান, চলমান শ্রমিক আন্দোলনের কারণে মালিক পক্ষ উদ্বিগ্ন। কারণ সঠিক সময়ে শিপমেন্ট ডেলিভারি না দিতে পারলে এক দিনের ব্যবধানে কোটি কোটি টাকা লোকশান হয়। তিনি জানান, শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন নির্ধারণের বিষয়ে মালিকরা খুবই আন্তরিক। আমি যতটুকু জানি, শ্রমিক এসোসিয়েশন এবং মলিকপক্ষ এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তের খুবই কাছাকাছি আছে। আশা করি খুব স্বল্প সময়ে এ বিষয়ে ফলপ্রসূ সমাধান আসবে। গতিনি বলেন, দায়িত্বশীল শ্রমিকরা কখনো আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার সাথে জড়িত নয়। শ্রমিকরা কাজে ব্যস্ত থাকে, আন্দোলনের সময় তাদের নেই। তারা ঈদের আগে বেতন বোনাস পেতে চায়। ভালভাবে ঈদ করতে চায়। তৃতীয় একটি পক্ষ এ সেক্টরকে উত্তেজিত করছে। তবে এখন কারখানার পরিবেশ শান্ত, শ্রমিকরা কাজ করছে। তবে আমরা চিন্তিত যে, ঈদের আগ পর্যন্ত এ পরিবেশ আমরা ধরে রাখতে পারব কি না।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ