ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের প্রভাবে ১৮দিন ধরে কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। গত রবিবার এ নিয়ে বন্দর চেয়ারম্যানের কক্ষে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, পরামর্শ সংস্থা ও বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে ত্রিপক্ষীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্পের মেয়াদের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় অবহেলা ও গাফিলাতির অভিযোগে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক মেরিন সার্ভিসের প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী হাসান মিয়া পূর্বকোণেকে বলেন, বৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ১৭-১৮দিনের মতো ড্রেজিং কাজ বন্ধ রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় ড্রেজিং কাজের সরঞ্জাম নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এতে কয়েকটি ড্রেজার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির বিকল হয়ে পড়েছে। তা মেরামত করতে সময় লাগছে। দুই-একদিনের মধ্যে কাজ শুরু করা হবে বলে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাজ শেষ করতে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত লাগতে পারে। প্রকল্পের মেয়াদ জুনে শেষ হচ্ছে- এমন প্রশ্নের তিনি বলেন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর আবেদন করেছি। এটা বিবেচনায় রয়েছে।
প্রকল্পের কাজ গত জানুয়ারির মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও তা হয়নি। আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। এরই মধ্যেও শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতিমধ্যেই ড্রেজিং প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে ড্রেজিং কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি, ঢিমেতাল ও উল্টো নদী ভরাটের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। গত মাসে বন্দরের বোর্ড সভায় এ নিয়ে খোদ নৌ-পরিবহনমন্ত্রী মো. শাহজাহান খানও ড্রেজিং নিয়ে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
প্রকল্প পরিচালক খাদেমুল বাশার পূর্বকোণকে বলেন, এ পর্যন্ত ৭৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মেয়াদের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে বার বার চাপ দেয়া হচ্ছে। অন্যথায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, ঝড়-বৃষ্টির কারণে ড্রেজিং প্রকল্পের যন্ত্রপাতি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রাখার কারণে কাজ কয়েকদিন বন্ধ ছিল। নদী ড্রেজিং ছাড়া প্রকল্পের অন্যান্য কাজ চলছে বলে জানান তিনি। সভায় কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা আমাদের রুটিন ওয়ার্ক কাজ। মাসের শেষে কাজের অগ্রগতি নিয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু গত মাসে প্রকল্প পরিচালক বলেছিল ৭৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আর প্রকল্প ব্যবস্থাপক বলেছিল ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এর প্রায় এক মাস পর ৭৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খানে উপস্থিতি বন্দর বোর্ড সভায় ৭৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল। প্রকল্প কর্মকর্তা ভাষ্যমতে, এক মাসে কাজের গতি কমেছে এক শতাংশ। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এরিই মধ্যে কাজ শেষ করা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে ড্রেজিং কাজ চলছে ঢিমেতালে। এছাড়া নদীর তীরে রাখা ড্রেজিং মাটি ঘূর্ণিঝড়র ও বৃষ্টির কারণে নদীতেই গিয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যেই ড্রেজিং মাটিতে ভরাট ও সরু হয়ে পড়েছে নগরীর প্রধান দুই খাল চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মোহনা। এরফলে নগরীর স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি ও জনদুর্ভোগ বেড়েছে। ড্রেজিং কাজের সুফল নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গত বছরের ২৯ আগস্ট চসিকের ২৬তম সাধারণ সভায় কাউন্সিলররাও এ নিয়ে আশঙ্ক প্রকাশ করেছিল। ওই সভায় কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং কার্যক্রমকে অপরিকল্পিত আখ্যায়িত করেছেন কাউন্সিলরা। তারা বলেন, ক্যাপিটাল ড্রেজিং নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কোন সুফল বয়ে আনবে না। এতে শুধু কোটি কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বন্দর ও নদী রক্ষায় ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে প্রায় ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১১ সালের জুলাই মাসে ড্রেজিং কাজ শুরু হয়। নৌ-পরিবহনমন্ত্রী মো. শাজাহান খান ড্রেজিং কাজের উদ্বোধন করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে ড্রেজিং কাজ পরিদর্শন করেছেন তিনি। গত মাসে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ বোর্ড সভায় কাজের গতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে মন্ত্রী চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে গত ৮ এপ্রিল পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং এন্ড এনফোর্সমেন্ট) মো. আলমগীর ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করেছেন। তদারিকর অভাবে ড্রেজিং কাজের গতি কমেছে বলে জানান তিনি। গত মাসে বন্দর বোর্ডের উপদেষ্টা কমিটির সপ্তম সভায় ড্রেজিং কাজের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন কমিটির সদস্য-সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন। তবে অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে তিনি সভায় উপস্থিত হননি। অভিযোগে তিনি বন্দরের বিভিন্ন কর্মকান্ডে নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খানের অবৈধ হস্তক্ষেপ এবং অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি নৌ-সচিব ও বন্দর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলেছেন।
জানুয়ারি মাসে ড্রেজিং কাজের নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আগামী সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময় বাড়ানোর আবেদন করেছেন। অথচ প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে জুন পর্যন্ত। অতিরিক্ত সময়ের আবেদন এখনও মঞ্জুর হয়নি। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সুপারিশ পেলেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আবেদন বিবেচনায় আনা হবে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।
জানা গেছে, সদরঘাট থেকে তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু পর্যন্ত তীর সংরক্ষণ ও জেটি সুবিধা সম্প্রসারণসহ নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প হাতে নেয়। ২০০৫ টেন্ডার আহবান করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২৫৩ কোটি টাকা দরে চায়না হারবার নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ২০০৫ সালে এ প্রকল্পের কার্যাদেশ দেয়া হয় তবে দর বেশি অজুহাতে তা বাতিল করা হয়। ২০১০ সালে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের জন্য পুনরায় টেন্ডার আহবান করা হলে ১৪টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এরমধ্যে সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে মালয়েশিয়ান মেরিটাইম এন্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন ২২৯ কোটি ৫৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকায় এই প্রকল্পের কার্যাদেশ পায়। গত বছরের ২৮ এপ্রিল সরকারের সঙ্গে কোম্পানিটির চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তিতে গত জানুয়ারি মাসের মধ্যে প্রকল্প কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। সূত্র জানায়, চুক্তি অনুযায়ী ৩৬ লাখ ঘনমিটার নদীর তলদেশ খনন ও তলানি অপসারণ, এক লাখ ৪৮ হাজার ৫০ ঘনমিটার নদী তীর ও খালমুখের বর্জ্য অপসারণ, ৫০ একর ভূমি পুনরুদ্ধার, ৩ হাজার ৫০০ মিটার শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, ৪০০ মিটার জেটি সুবিধা সম্প্রসারণ, ৩ হাজার ৪৩০ মিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ, ৩টি কালভার্ট নির্মাণ, ৪ লাখ ৪১ হাজার ৮০০ স্লোপ প্রোটেকশন সিসি বক স্থাপন ও ৩৫ হাজার ৪৪৪ মিটার পাইলিং করার কথা রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে নির্মাণাধীন বাঁধ ভেঙে যাওয়া, বুয়েট কর্তৃপক্ষ তাদের সময়মতো সয়েল টেস্ট রিপোর্ট দিতে না পারা এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদে সময়ক্ষেপণসহ নানা কারণে নির্ধারিত সময়ে তারা কাজ শেষ করতে পারছে না।