শনিবার, মে ১৮, ২০২৪
প্রচ্ছদদেশজুড়েচট্টগ্রাম বিভাগপ্রাক্তন ছাত্রীদের পুনর্মিলনীতে সরকারি মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণ পরিণত হয় মিলন মেলায়

প্রাক্তন ছাত্রীদের পুনর্মিলনীতে সরকারি মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণ পরিণত হয় মিলন মেলায়

পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়/ ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়/ আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়, মোরা সুখের দুঃখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়…।’ চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের আঙ্গিনাজুড়েই যেন ক্ষণে– ক্ষণে বাজছিল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ গানের সুর। গলা ধরা ধরি করে এক সুরে কণ্ঠও ছেড়েছেন আবার কেউ কেউ। পুরনো বন্ধুদের কাছে পেয়ে ফিরে গেছেন সেই পুরনো দিনে। দিন কেটেছে স্মৃতি রোমন্থনে। কারো কারো কণ্ঠে ঝরেছে আক্ষেপ– আহ! সেই দিন যদি আবার ফিরে পাওয়া যেতো! কিন্তু সেই দিন ফিরে পাওয়া যাক আর না যাক, শুক্রবার একদিনের জন্য যেন সবাই ফিরে গেলেন পুরনো দিনে! প্রাক্তন ছাত্রীদের পুনর্মিলনী উপলক্ষে কলেজ প্রাঙ্গণ পরিণত হয় মিলন মেলায়। ১২ শতাধিক প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রীর উপস্থিতিতে এ যেন প্রাণের উৎসব। প্রত্যেকের গলায় শোভা পেয়েছে উত্তরীয়। তাতে লেখা রি–ইউনিয়ন। রাজনীতিক, শিক্ষক, ব্যাংকার, পুলিশ ও বিভিন্ন পেশাজীবী কিংবা জুনিয়র–সিনিয়র পরিচয় ছাপিয়ে সবাই হয়ে ওঠেছিলেন কলেজের প্রাক্তন, প্রাণের বন্ধু। সবার পরিচয় যেন একটাই। ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠা এবং ১৯৬৮ সালে সরকারিকরণের পর এ নিয়ে দ্বিতীয়বার পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন হলো কলেজটিতে। এর আগে ১৯৯৯ সালে প্রথম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আবেগের বন্যার পাশাপাশি গতকাল সারাদিন উচ্ছ্বাসে মেতেছিলেন কলেজের প্রাক্তনরা। দলে দলে আড্ডা–গল্প–গুজবের পাশাপাশি ছিল খুনসুটিও। দোলনায় চড়তেও দেখা যায় অনেককে। প্রতিনিয়ত কর্মব্যস্ততার চাপের ফাঁকে যেন একদিনের অবাধ স্বাধীনতা। উড়ন্ত পাখির মতো আকাশে ডানা ছড়ানো।

সকালে নয়টায় বর্ণাঢ্য র‌্যালির মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিনের কর্মসূচি। র‌্যালিতে নেতৃত্ব্ব দেন পুর্নমিলনী উদযাপন কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ও কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল হাসান। পরে বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ। অনুষ্ঠানে উদ্বোধক ছিলেন সংসদ সদস্য সাবিহা মুসা, প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ–উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন লায়ন্স ক্লাবের দ্বিতীয় জেলা ভাইস গভর্নর লায়ন কামরুন মালেক। আমন্ত্রিত অতিথিদের সবাই আবার কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্রী। সকালের পর্বে ব্যতিক্রমী এই আয়োজন যেন অনুষ্ঠানে যোগ করে নতুন মাত্রা। পুর্নমিলনী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলামের সভাপতিত্বে প্রথম পর্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সালমা রহমান। পরে পর্যায়ক্রমে স্মৃতি রোমন্থন করে বক্তব্য দেন আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ। অন্যান্যের মধ্যে প্রফেসর রীতা দত্ত, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের মূল্যায়ন কর্মকর্তা শুক্লা রক্ষিত, জিনাত আজম, জেসমিন সুলতানা পারু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

উদ্বোধকের বক্তব্যে কলেজের বিভিন্ন সংকট নিরসনে নিজের জায়গা থেকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার ঘোষণা দেন সংসদ সদস্য সাবিহা মুসা। প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. শিরীণ আখতার বলেন, আমাদের সময় নারী শিক্ষার ততটা সুযোগ ছিলনা। বহু বাধা পেরিয়ে আমাদের এতদূর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। কিন্তু এখন তুলনামূলক অনেক উন্নতি ঘটেছে। নারীরা অনেক দূর এগিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে লায়ন্স ক্লাবের দ্বিতীয় জেলা ভাইস গভর্নর লায়ন কামরুন মালেক বলেন, কলেজে অনেক গরীব–অসহায় ছাত্রীরা পড়ালেখা করছে। আমাদের নিজেদের একটি পত্রিকা আছে। এর মাধ্যমে যতদূর সম্ভব সেসব গরীব–অসহায় ছাত্রীদের সহায়তা করার চেষ্টা করবো। পাশাপাশি কলেজের উন্নয়নে কিছু করতে পারলে আন্তরিকভাবে তাও করবো। অনেক বছর পর কলেজে এসে পুরনো সময়ে, ফেলে আসা বহু আনন্দময় মূহুর্তে ফিরে যাওয়ার কথা বলেন অতিথিরা। কথায়–কথায় জানা যায়, সংসদ সদস্য সাবিহা মুসা ও লায়ন কামরুন মালেক ছিলেন কলেজের একই ব্যাচের (১৯৬৬ সাল) ছাত্রী। প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার ও প্রফেসর শাহেদা ইসলাম দুজনই ছিলেন ১৯৭৫ ব্যাচের।

আলোচনা পর্বের পর দুপুরজুড়েই ছিল সাংস্কৃতিক আয়োজন। যেখানে প্রাক্তন ছাত্রীরা নিজেরাই নাচে–গানে মাতিয়ে রাখেন গোটা কলেজ প্রাঙ্গণ। সন্ধ্যায় দ্বিতীয় পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। বিশেষ অতিথি ছিলেন সিএমপি কমিশনার মো. ইকবাল বাহার। ছাত্রীদের রাস্তা পারাপারের সুবিধার্থে কলেজের সামনের সড়কে অতি দ্রুত একটি ওভারপাস করে দেয়ার ঘোষণা দেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। পরে শিল্পী সন্দীপন ও চিরকুট ব্যান্ডের মনমুগ্ধকর পরিবেশনায় মেতে উঠেন সকলে। অনেকদিন পর কাছের বন্ধুদের কাছে পেয়ে যেন অন্যরকম অনুভুতির কথা জানালেন সোমা দে নামের প্রাক্তন এক ছাত্রী। তিনি বর্তমানে একটি সরকারি ব্যাংকে কর্মরত। বললেন– সুযোগ পেয়ে বন্ধুদের নিয়ে দোলনায়ও চড়েছেন।

যেন কলেজে পড়ার পুরনো সময় নতুন করে ফিরে পেয়েছেন বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা মর্জিনা আকতার। তিনি বর্তমানে নগরীর সদরঘাট থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এ বিদ্যাপীঠের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব সালমা রহমান বলেন, আজ যেন ফিরে গেছি সেই ৩৫ বছর আগে। একই সাথে মেয়ে ফেরদৌস আরাও এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী জানিয়ে সালমা রহমান বলেন, ভালো লাগছে। আমরা মা–মেয়ে দুজনই এই কলেজে পড়েছি। একই সাথে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরেছি। এটা খুবই উপভোগ্য।

স্মৃতি রোমন্থন করে আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ও শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম বলেন, বহু সময় পর একটা দিন যেন আমরা নিজেদের মতো করে পেয়েছি। একটা দিন যেন উৎসবের মধ্য দিয়ে কেটেছে আমাদের। এই সুযোগ সচরাচর মেলেনা। এই কলেজ থেকে পড়ালেখা করে পরবর্তীতে একই কলেজেরই অধ্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য হয়েছিল জানিয়ে প্রফেসর শাহেদা ইসলাম বলেন, আমার মনে হয় এরকম সৌভাগ্য খুব কমজনেরই হয়। আমি এই কলেজের ছাত্রী ছিলাম। আবার এই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলাম। এত বড় আয়োজন সফল করায় উদযাপন কমিটির সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন উদযাপন কমিটির এই আহ্বায়ক।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ