শনিবার, মে ১৮, ২০২৪
প্রচ্ছদইন্টারভিউসাবজেলে ফুল ভালোবাসতেন দুই নেত্রী : মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকী (অব.)

সাবজেলে ফুল ভালোবাসতেন দুই নেত্রী : মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকী (অব.)

ওয়ান-ইলেভেনে দায়িত্বপ্রাপ্ত আলোচিত ডিআইজি প্রিজন তৎকালীন মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেছেন, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া সাব জেলে থাকা অবস্থায় ফুল খুবই পছন্দ করতেন। আমি নিয়মিত তাদের দুজনের জন্য ফুল নিয়ে যেতাম। একদিন দেখলাম, আজকের প্রধানমন্ত্রী আমার দেওয়া ফুলটি একটি পানিভরা বোতলে রেখে দিয়েছেন। পরে দুজনের জন্যই একটি করে ফুলদানি দিয়ে আসি। তারা দুজনই আমাকে খুব পছন্দ করতেন। জেল কোড অনুযায়ী আমি তাদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করলেও তারা কখনই মনঃক্ষুণ্ন হতেন না। একই স্থান থেকে রান্না করা খাবার খেতেন দুই নেত্রী। কখনই তারা নিজে থেকে খাবার মেন্যু দিতেন না। আমরা যা দিতাম তা-ই তারা স্বাচ্ছন্দ্যে খেতেন। তাদের আচরণে আমি সত্যিই বিমোহিত। জাতীয় নেত্রীর মতোই তাদের আচরণ করতে দেখেছি আমি। একান্ত আলাপচারিতায় ওয়ান-ইলেভেনে দুই নেত্রীর সাব জেলের দায়িত্ব পালনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সে সময়কার ডিআইজি প্রিজন এসব কথা বলেন। ডিআইজি প্রিজন হিসেবে প্রায় সাড়ে তিন বছর দায়িত্ব পালন শেষে ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি। বর্তমানে সাভারে ‘স্টিল স্ট্রাকচার’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জিএম (এইচআরডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্ত্রী, সন্তান, মা ও ভাই-বোনদের নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসের পাশেই বাউনিয়ায় বসবাস করছেন। জামালপুর সদরে তার পৈতৃক বাড়ি। সেখানে আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হন। ১৯৮২ সালে কমিশন পদে সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর মেজর হিসেবে পিজিআর, এসএসএফসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালন করেন। ওয়ান-ইলেভেনে দুই নেত্রীর সাব জেলে প্রায় এক বছর দায়িত্ব পালন শেষে সর্বশেষ যশোরে ডিআইজি প্রিজন ছিলেন। এরপর সেনাবাহিনীতে গিয়ে অবসরে যান ওয়ান-ইলেভেনে এই আলোচিত সেনা কর্মকর্তা।

শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, দুই নেত্রীর সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। জাতীয় নেত্রী হিসেবে আমিও তাদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করেছি, কথা বলেছি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারাও আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। এটাও সত্য, ওই সময় আমি ছাড়া তাদের সঙ্গে কথা বলার আর তেমন কেউ ছিল না।

সাবেক ডিআইজি প্রিজন বলেন, দুই নেত্রী পৃথক জেলে থাকলেও তারা কে কী খেতেন, তা জানতে পারতেন। রাজনীতিতে কাদা ছোড়াছুড়ি বক্তব্য দিলেও ওই সময় তারা একে অন্যকে সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। আজকের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার মা মারা যাওয়ার পর তিনি প্যারোল নিয়ে মায়ের লাশ দেখতে যান। কিন্তু তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোও পৃথকভাবে মুক্তি পেলে কেউ কারও সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ পাননি। এ নিয়ে আজকের প্রধানমন্ত্রী আফসোস করে তখন আমাকে বলেছিলেন, ‘তাদের একসঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ কেন দিলেন না। হাজার হোক মায়ের মৃত্যু তো। এটা আপনারা চাইলে করতে পারতেন।’ আমি তখন তাকে বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলাম, জেল কোডের বাইরে যাওয়ার নিয়ম ও ক্ষমতা আমার নেই।

এরপর আজকের প্রধানমন্ত্রীর চোখের সমস্যা নিয়ে গণমাধ্যমে নানা সংবাদ প্রকাশিত হলে একদিন আজকের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া আমাকে বললেন, ‘গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, শেখ হাসিনার চোখের সমস্যা। ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন না কেন? কারণ যার চোখের সমস্যা তিনিই বোঝেন তা কত যন্ত্রণার।’ তখন আমি তাকে সবিনয়ে বলেছিলাম, জেল কোড অনুযায়ী আমরা যথাসাধ্য চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি।

সাবেক ডিআইজি প্রিজন বলেন, এরপর আমি কয়েক দিন কোমরের ব্যথায় সাব জেলে ডিউটিতে যেতে পারিনি। একদিন আজকের প্রধানমন্ত্রী আদালতে গিয়ে আমাদের কোনো এক সহকর্মীকে আমার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি আমার অসুস্থতার কথা জানালে প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি যেন ভালো চিকিৎসা নিই। এর একদিন পরই বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমান আমাকে টেলিফোনে বললেন, আমার স্বাস্থ্যের কী অবস্থা মা (খালেদা জিয়া) জানতে চেয়েছেন। একজন বঙ্গবন্ধুকন্যা আরেকজন শহীদ জিয়ার সহধর্মিণী আমার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিচ্ছেন। সত্যিই আমি ওই সময় অভিভূত হয়ে পড়ি। আজও আমার সেই দিনগুলোর কথা মাঝেমধ্যে মনে পড়ে।

শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, আজকের প্রধানমন্ত্রী গরুর মাংস রান্না করতে খুবই পছন্দ করতেন। তিনি নিজেই গরুর মাংস রান্না করতে চাইতেন। কিন্তু আমি অনেক বুঝিয়ে তাকে রান্না করা থেকে বিরত রাখতাম। অন্যদিকে আজকের বিরোধীদলীয় নেতা খুবই সাধারণ খাবার খেতে পছন্দ করতেন। তিনি খেতেনও খুবই অল্প। রাজনীতিতে আসার কোনো ইচ্ছা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আমি আগেও কোনো রাজনীতিতে ছিলাম না। ভবিষ্যতেও রাজনীতি করার ইচ্ছা নেই। তবে আজকের রাজনীতিতে সহনশীলতার খুবই অভাব বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে। রাজনীতিতে সহনশীলতা না থাকলে গণতন্ত্রও স্থিতিশীল থাকবে না। একে-অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে, প্রতিহিংসামূলক আচরণ করলে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোই নয়, পুরো গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ