শুক্রবার, মে ২৪, ২০২৪
প্রচ্ছদঅর্থ ও বানিজ্য সময়বিনিয়োগ বাড়ছে বাংলাদেশে

বিনিয়োগ বাড়ছে বাংলাদেশে

বিশ্বজুড়ে বিদেশি লগ্নি হ্রাস পেলেও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাড়ছে বাংলাদেশে। সরকারের নানা সুবিধা বিদেশি লগ্নি টানতে সহায়ক হয়েছে। গত বছরে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি (এফডিআই ) এসেছে ২৩৩ কোটি কোটি ২৭ লাখ ডলার।২০১৬ সাল বিদেশি লগ্নির ক্ষেত্রে মন্দার বছর হিসেবে চিহ্নিত। বিশ্বজুড়ে বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে দুই শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিদেশি লগ্নিতে কার্যত ধস নেমেছে। এসব দেশে বিদেশি লগ্নি কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। মন্দার দুঃসময়ে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশে।

নানা সুযোগ–সুবিধা দেয়া বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিও পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে লগ্নি করার ক্ষেত্রে বর্তমানে অন্তত ১৭টি খাতে কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছেন বিদেশিরা। তাদের মুনাফা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রেও বিধি–বিধান শিথিল করা হয়েছে। মুনাফাসহ শতভাগ মূলধন ফেরত নেয়ার পাশাপাশি নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠায় যন্ত্রপাতির অবচয় সুবিধা, শুল্কমুক্ত যন্ত্রাংশ আমদানি এবং রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কম সুদে ঋণ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন বিদেশিরা। পাশাপাশি রয়েছে সস্তা শ্রমের সহজলভ্যতা। এসব সুযোগ–সুবিধার জন্যই বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে ঝুঁকছেন। বিশেষ করে তারা টেলিকমিউনিকেশন, টেক্সটাইল, জ্বালানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ এবং ব্যাংক–বীমায় বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি লগ্নি আকর্ষণে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর জন্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, জমি সংকট, গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাব, অবকাঠামো সমস্যা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি ও আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে দায়ী করেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১১ সালে দেশে বিদেশি লগ্নি ১০০ কোটি ডলার অতিক্রম করে। পরিমাণ ১১৩ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। পরবর্তী ৩ বছরে অবশ্য তা শত কোটি ডলারের মধ্যে ছিল। ২০১৪ সালে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি হ্রাস পায় প্রায় ৪ শতাংশ। তবে ২০১৫ সালে আশাতীত সাফল্য আসে। প্রথমবারের মত এফডিআই ছাড়িয়ে যায় ২০০ কোটি ডলার। নিট এফডিআইর পরিমাণ ছিল ২২৪ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় তা ৪৪ শতাংশ বেশি। আর গতবছরে তা ছাড়িয়ে গেছে ২৩৩ কোটি ডলার। এই ইতিবাচক ধারায় চলতি ২০১৭ সালে তা ৫০০ কোটি ডলারে পৌঁছুবে বলে আশা করেছে আঙ্কটাড।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এফডিআই বৃদ্ধি জাতির জন্য অত্যন্ত সুসংবাদ। তবে, প্রত্যাশা আরও বেশি। কারণ, ছোট দেশ কম্বোডিয়ায়ও বছরে এফডিআই আসে প্রায় ৮০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ আমাদের প্রায় ৪ গুণ। তারা মনে করেন, অবকাঠামোগত নানা সমস্যার সমাধান এবং জমি সহজলভ্য হলে বিদেশি লগ্নি আরও বাড়বে। বিদেশি লগ্নি বাড়লে দেশি বিনিয়োগও বাড়বে। গত ২৮ জুন বাজেট নিয়ে সমাপনী বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, মূলত দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকা, নীতি কৌশলগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা ও এগুলোর সুসমন্বিত প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অব্যাহত সরকারি উদ্যোগ ইত্যাদির প্রভাব ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথকে প্রশস্ত করেছে। তারই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিদেশি লগ্নিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬ সালে দেশে যে পরিমাণ বিদেশি লগ্নি এসেছে, তার অর্ধেকেরও বেশি হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানির পুনর্বিনিয়োগ হিসেবে। এর পরিমাণ ১২১ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। ২০১৫ সালে এর পরিমাণ ছিল ১১৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালেও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) চেয়ে বাইরে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে বেশি। এ সময় ইপিজেড এলাকায় বিনিয়োগ এসেছে ৪১ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। ২০১৫ সালে যার পরিমাণ ছিল ৪০ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। অন্যদিকে ২০১৬ সালে নন–ইপিজেড এলাকায় বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ১৯১ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। ২০১৪ সালে যার পরিমাণ ছিল ১৮২ কোটি ৮৭ লাখ ডলার।

বাংলাদেশে যে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসে তার বেশিরভাগই হয় জ্বালানি খাতে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জ্বালানি খাতের পাশাপাশি অন্য খাতগুলোতেও লগ্নি নিয়ে আসতে হবে। এজন্য সরকারকে বিদেশি উদ্যোক্তাদের কাছে বিনিয়োগের সম্ভাব্য খাতগুলো তুলে ধরতে হবে। এফডিআই–এ খাত বহুমুখীকরণ করতে না পারলে সরকার বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য নানা ধরনের সুবিধা যে উদ্দেশ্যে দিয়েছে তা সফল হবে না। এফডিআই–এ নানা ধরনের সুবিধা দিয়েছে উচ্চ হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য। তাদের মতে, জ্বালানি ও টেলিকমিউনিকেশন খাতে বেশি উদারীকরণ করা হয়েছে, তাই এ খাতে এফডিআইও বেশি। এমনিতেই আমরা ব্যবসা সহজীকরণ সূচক ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সূচকে পিছিয়ে রয়েছি। তাই রিয়েল এস্টেট, চিকিৎসা এবং পরিবহন খাতসহ আরো কিছু খাত নির্ধারণ করে এ খাতগুলোকে উদারীকরণ করতে হবে। বিদেশি লগ্নি আসলে এ খাতের আধুনিকায়ন হবে এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ বরাবর বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বান করেছে। বিদেশি উদ্যোক্তারাও বাংলাদেশে লগ্নি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু এখানে এসে নানা বাধার কারণে অনেক বিনিয়োগ ফিরে যাচ্ছে। বিশেষ করে আবাসন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ একেবারেই আশাব্যঞ্জক নয়। এখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে চেয়েও করতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কারণে। মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারের সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আন্তরিক সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে, সেখানে আমাদেও দেশে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো আইনি–বেআইনি নানা বাধার সৃষ্টি করে আবাসন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ অসম্ভব করে তুলেছে।

উল্লেখ্য, গতবছর সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে টেলিকমিউনিকেশন খাতে। এর পরিমাণ ছিল ৫৭ কোটি ২৭ লাখ ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার এসেছে টেক্সটাইল খাতে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৬ কোটি ৭৯ লাখ ডলার এসেছে বিদ্যুৎ খাতে। এছাড়া গ্যাস ও জ্বালানি খাতে ১৬ কোটি ৬৩ লাখ, ব্যাংকিং খাতে ১৬ কোটি ৬০ লাখ, ট্রেডিং খাতে ৮ কোটি ৮৩ লাখ, খাদ্য খাতে ৮ কোটি ৬৫ লাখ, সিমেন্ট খাতে ৪ কোটি ৩৯ লাখ, কেমিক্যাল ও ওষুধ খাতে ৪ কোটি ৩৭ লাখ, কৃষি ও মৎস্য খাতে ৪ কোটি ৩১ লাখ, বীমা খাতে ২ কোটি ৬২ লাখ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে ২ কোটি ৫২ লাখ, তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে কোটি ২০ লাখ, নির্মাণ খাতে ৫৫ লাখ, সার খাতে ৫৩ লাখ এবং অন্যান্য খাতে ৪০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বিদেশি লগ্নি এসেছে।

সর্বোচ্চ বিনিয়োগ এসেছে সিঙ্গাপুর থেকে। এর পরিমাণ ৬৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৩ কোটি ডলার এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ ২১ কোটি ৭৭ লাখ ডলার এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এছাড়া নরওয়ে থেকে ১৬ কোটি, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৫ কোটি ১৩ লাখ, হংকং থেকে ৯ কোটি ৮৪ লাখ, নেদারল্যান্ডস থেকে ৮ কোটি ৮৮ লাখ, ভারত থেকে ৭ কোটি ৯২ লাখ, চীন থেকে ৬ কোটি ১৪ লাখ, জাপান থেকে ৪ কোটি ৮২ লাখ, তাইওয়ান থেকে ৪ কোটি ৫৮ লাখ, মালটা থেকে ৪ কোটি ৪৭ লাখ, ব্রিটিশ ভার্জিন দীপপুঞ্জ থেকে ৪ কোটি ১৯ লাখ, মালয়েশিয়া থেকে ৩ কোটি ৮৬ লাখ, থাইল্যান্ড থেকে ৩ কোটি ৫১ লাখ, মরিশাস থেকে ৩ কোটি ২৩ লাখ, সুইজারল্যান্ড থেকে ২ কোটি ৬৩ লাখ, জার্মানি থেকে ২ কোটি ১৮ লাখ, সৌদি আরব থেকে ১ কোটি ৮২ লাখ, ফ্রান্স থেকে ১ কোটি ৩৭ লাখ এবং অন্যান্য দেশ থেকে ১০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের লগ্নি এসেছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ