ষ্টাফরিপোর্টার (বিডিসময়২৪ডটকম)
সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে বিদেশি বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান-এমন আশঙ্কা ছিল সর্বত্র। সারাবিশ্বে এ নিয়ে বেশ গুঞ্জনও তৈরি হয়। আমেরিকার বাজারে জিএসপি সুবিধা হারানোর অন্যতম কারণও ওই ঘটনা। বাংলাদেশি পোশাক ক্রেতাদের ধরতে নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশ। কিন্তু সব আশঙ্কা দূর করে বাংলাদেশের বাজারের ওপরই আস্থা রাখছেন বিদেশি ক্রেতারা। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এমনটা বলা হয়েছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের কোথাও বাংলাদেশের চেয়ে সস্তায় তৈরি পোশাক পাওয়া যায় না। সবার আগ্রহের কারণ এই একটাই। এখানে সবচেয়ে সস্তায় পোশাক পাওয়া যায় বলে এ মুহূর্তে ক্রেতাদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আশঙ্কা নেই। শ্রমিকদের পারিশ্রমিক ও আনুষঙ্গিক খরচ কম বলে বাংলাদেশে কম খরচে পোশাক উত্পাদন করা সম্ভব।
চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩২ জন শ্রমিক মারা যান। গত বছরের নভেম্বরে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে মারা যান ১১২ শ্রমিক। এসব ঘটনায় বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসে। আশঙ্কা করা হচ্ছিল, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে বিশ্বের নামিদামি অনেক ব্র্যান্ড। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। চীন ছাড়া এশিয়ার শীর্ষ পোশাক উত্পাদনকারী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স। ওই সব প্রতিষ্ঠান জানায়, বিদেশি ক্রেতারা এখনও তাদের কাছে খুব একটা যায় না। সুতরাং দাম বিবেচনায় পোশাক খাতে বাংলাদেশই এখনও ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে। ভারতভিত্তিক একটি তৈরি পোশাক আমদানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান অরবিন্দ সিংঘাল বলেন, তৈরি পোশাকে বাংলাদেশের কপর্দকহীন থেকে কোটিপতি হওয়ার কারণ, এখানকার চেয়ে বিশ্বের কোথাও এত কম পারিশ্রমিকে শ্রম পাওয়া যায় না। অন্যান্য খরচও বাংলাদেশে কম। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ভবিষ্যত্ সম্পর্কে অরবিন্দ সিংঘাল বলেন, কোনো ক্রেতারই বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে গরজ নেই। এই মুহূর্তে তৈরি পোশাকে বাংলাদেশের বিকল্পও কেউ নেই। শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করালেও দাম কম হওয়ায় পশ্চিমা ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের কদর সবচেয়ে বেশি। ভিয়েতনামের একটি পোশাক উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উপপরিচালক নুয়েন হু তুয়ান বলেন, বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে খুব কম খরচে পোশাক উত্পাদন করা সম্ভব। ভিয়েতনামের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ কম খরচ হয় বাংলাদেশে।
তিরুপুরভিত্তিক পোশাক কারখানা ইসটির মালিক এন থিরুক্কুমারান। গত বছর ৮৩ লাখ ডলার সমপরিমাণ পোশাক বিক্রি করেছিলেন থিরুক্কুমারান। তিনি জানান, বাংলাদেশ ছেড়ে দিয়ে পোশাক তৈরির অর্ডারের বিষয়ে আলোচনা করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি। ক্রেতাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে, তবে তারা এখনও দাম নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। তিনি জানান, বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের গড়ে ন্যূনতম মাসিক বেতন মাত্র ৩৮ মার্কিন ডলার, যেখানে ভারতে তা গড়ে ১০০ মার্কিন ডলার।
ইন্দোনেশিয়ার সি রাজেকি ইসমান পিটি (সি টেক্স) জারা ও এইচঅ্যান্ডএমসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করে। বাংলাদেশে উত্পাদন কমিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় উত্পাদন নিয়ে এইচঅ্যান্ডএমের সঙ্গে আলোচনা করে সি টেক্স। তবে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি এইচঅ্যান্ডএম। এশীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশের কারখানা মালিকদের উপলব্ধি, বিদেশিরা বাংলাদেশে যত সহজে পোশাক তৈরির অর্ডার দেয় এশিয়ার অন্য দেশে তত সহজে তা করতে পারে না। বাংলাদেশের তুলনায় অন্যান্য দেশে অনুবাদকদেরও দিতে হয় প্রচুর অর্থ। ভিয়েতনামের সাইগন দুই গার্মেন্ট জেএসসির ডেপুটি ডিরেক্টর এনগুয়েন হু তোন জানান, বাংলাদেশে পোশাক তৈরির ব্যয় খুবই প্রতিযোগিতামূলক, ভিয়েতনামের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ কম।
ওয়াল-মার্ট স্টোর ইনকরপোরেশন বাংলাদেশে তার উত্পাদন অব্যাহত রেখেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিকে গুরুত্বপূর্ণ উেসর বাজার হিসেবে আখ্যায়িত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ওয়াল-মার্ট। বাংলাদেশের বিকল্প খুঁজে পায়নি সুইডিশ এইচঅ্যান্ডএম। এইচঅ্যান্ডএমের মুখপাত্র এলিন হ্যালেরবাই বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আমরা ক্রয় কমিয়ে দিচ্ছি না। আমাদের সরবরাহকারীদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক রাখতে চাই আমরা।’
বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনে যুক্তরাজ্যের প্রাইমার্ক, মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার, মাদারকেয়ার, টেসকো, নেদারল্যান্ডসের জি-স্টার, ইতালির বেনেটন, জার্মানির সিঅ্যান্ডএ, কিক, সুইডেনের এইচঅ্যান্ডএম, স্পেনের ইন্ডিটেক্স, ম্যাংগো, কানাডার লোবল, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল-মার্ট, গ্যাপ, কেলভিন ক্লেইন, অস্ট্রেলিয়ার রিভারস, কোলস ও কেমার্টসহ বিভিন্ন নামিদামি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের জুনে পোশাক রফতানি বেড়েছে ২২০ কোটি ডলার সমপরিমাণ।