বুধবার, মে ১৫, ২০২৪
প্রচ্ছদজাতীয়সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করলেন লতিফ সিদ্দিকী

সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করলেন লতিফ সিদ্দিকী

শেষবারের মতো বক্তব্য দিয়ে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করলেন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। সপ্তম অধিবেশনের প্রথম দিনে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিজের বক্তব্য শেষেই স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন তিনি।  ১৫ মিনিটের বক্তব্যে তিনি নিজেকে সাচ্চা মুসলমান, বাঙালি ও আওয়ামী লীগার দাবি করে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন বলে জানান। দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমার কোনো আচরণে দেশবাসী দু:খ পেয়ে থাকলে দেশবাসীর কাছে নতমস্তকে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি আমার আসন থেকে পদত্যাগ করছি। জাতীয় সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, ৭৫ কার্যদিবস পর বক্তৃতা করলেন হজ ও তাবলিগ জামায়াত নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করে বিতর্কের মুখে থাকা লতিফ সিদ্দিকী।

অধিবেশন কক্ষে ছিলেন না সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতসহ বেশ কিছু সিনিয়র মন্ত্রী ও এমপিরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি অধিবেশন থেকে ওয়াক আউট করেন। ফলে লতিফ সিদ্দিকীর বক্তৃতার সময় জাপার কোনো সদস্যও ছিলেন না।

সন্ধ্যা সাতটা ৭ মিনিটে সংসদ অধিবেশনকক্ষে এসে ট্রেজারি বেঞ্চের সামনের সারির ১৪ নম্বর আসনে বসেন। এ আসনটি মন্ত্রী থাকার সময় থেকেই তার জন্য নির্ধারিত। নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে স্পিকারের কাছে পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য দানের সুযোগ চান লতিফ সিদ্দিকী। স্পিকার তাকে ফ্লোর দিলে ৭টা ২৪ মিনিটে বক্তব্য শুরু করে ৭টা ৩৯ মিনিটে শেষ করেন তিনি। পদত্যাগের আগে সংসদ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখা বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম। এ সময় এমপি পদ থেকে তাকে অপসারণে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

বক্তৃতার শুরুতে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমি এই সংসদে সাধারণত মৌখিক বক্তৃতা করেছি। আজ বিশেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বিধায় আমি একটি লিখিত বক্তৃতা নিয়ে এসেছি।   মাননীয় স্পিকার, আপনি অনুমতি দিলে লিখিত বক্তব্য পাঠ করবো।

লতিফ সিদ্দিকী স্পিকারের অনুমতি নিয়ে বলেন, আমি মুসলমান, আমি বাঙালি, আমি আওয়ামী লীগার। এ পরিচয় মুছে দেওয়ার মতো শক্তি পৃথিবীতে আর কারো নেই। এই আমার চেতনা, আমার জীবনবোধ, চলার সুনির্দিষ্ট পথ। যে যাই বলুন, প্রচার করুন, সিদ্ধান্ত নেন, এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে না। আমি মানুষ বলেই আমার ভুল ভ্রান্তি আছে, ত্রুটি আছে, কিন্তু মনুষ্যত্বের স্খলন নেই, মানবতার প্রতি বিশ্বাস হারায় না। যতো বড় আঘাতই আসুক, ধৈর্যহারা হয় না। আমি বিশ্বাস করি, আবার মানেই আলোর হাতছানি, রাষ্ট্র বিভ্রান্ত করলেও আমি ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে মেনে নিয়ে তা মোকাবেলা করলাম। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমি অভিযোগের টুপি মাথায় নিয়ে সংসদে বসিনি, আমি সংসদে বসেছি মানুষের ভালোবাসা ও মানুষের ফুলের মালা নিয়ে।

তিনি বলেন, আমার যতো আপত্তি সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফা উল্লেখ করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে স্পিকারের চিঠির সম্পর্কে। ৬৬ অনুচ্ছেদের ৪ দফার বর্ণিত নির্দেশনা হল, কোনো ব্যক্তির প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা এবং থাকার বিষয়ে এক্ষেত্রে ৬৬ অনুচ্ছেদের দুই দফা। কারণ, সংসদের ৭০ অনুচ্ছেদের নির্দেশনার ব্যাপারটি স্পষ্ট। এ স্পষ্ট বিষয়টি আপনার বরাতে ধুসর হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমি বিবেচনা করি, এ চিঠির কারণে সংসদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়েছে এবং সংবিধানের অপব্যাখ্যা হয়েছে বলে আমি মনে করি। বিনা শুনানিতে কোনো সংসদের আসন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়া যথাযথ কি-না সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আমি আর কথা বাড়াতে চাই না।  আপনি আমাকে সময় দিয়েছেন। বিদায় বেলা শুধু এ কথা বলতে চায়। বহিস্কৃত এই নেতা বলেন, আমি মানুষের জন্য রাজনীতি করেছি, মানুষকে ভালোবেসেছি, বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে মানবকল্যাণে শপথ নিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে আমি অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছি। আজকে আমার সমাপ্তির দিন।

দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে সংসদ সদস্যপদ ছাড়লাম। এ দিনে আমার কারো বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বিদ্বেষ, অভিমান এবং অভিযোগ আনছি না। দেশবাসী যদি আমার আচরণে কোনো দুঃখ পেয়ে থাকেন আমি নতমস্তকে তাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। তিনি বলেন, আমি মানুষের ভালোবাসাকে আমার শ্রেষ্ঠ মূলধন মনে করি।  সেই ওয়াদা করে সবশেষে  আমি বলছি। উপরন্তু অনুমিত হয়েছি, আমার নেতার অভিপ্রায় আমি আর সংসদ সদস্য না থাকি। কর্মী হিসাবে নেতার একান্ত অনুগত ছিলাম। বহিষ্কৃত হওয়ার পর ব্যত্যয় কিংবা ব্যতিক্রম সমুচিত মনে করি না। ইতিপূর্বে আমার প্রতিবাদ ছিল প্রতিকার পাওয়ার। এখন দ্বিধাহীন কণ্ঠে, ঘৃণা বিদ্বেষ উগড়ে না দিয়ে, কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না করে দৃঢ়চিত্তে বাংলাদেশ সংসদের আসন ১৩৩ টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করছি।

টাঙ্গাইল-৪ আসনের এই সংসদ সদস্য বলেন, আমি অভিযোগের টুকরি নিয়ে সংসদে দাঁড়াইনি।  ভালোবাসার মহিমা বিতরণ করতে  সৌহার্দ্য আর প্রীতি-ভালোবাসার  মালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছি।  আমি সব সময়ই অস্পষ্টতা ও ধুসরতা বিরোধী। অস্পষ্টতা, ধুসরতা, কপটতা  স্বার্থপরতা  সুযোগ সুবিধার পথে হাটাকে অপছন্দ করি।  জীবন উৎসর্গ করেছিলাম।   মানুষ সমাজ  রাষ্ট্র মানবতার সেবায়।  নিজের জন্য ভারি ভারি পদ-পদবি   করায়ত্ব করতে নয়।  আর পদ-পদবির জন্য নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য  কালিমালিপ্ত করা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ।

তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িক, ইহজাগতিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারা আমার মনন গঠিত ও বিকশিত এবং প্রতিনিয়ত এর চর্চা ও অনুশীলন করি। অমানুষ নই, ব্রতমান মানুষ।  মনুষ্যত্ব ও মানবতার চর্চা  অনুশীলন করতে গিয়ে   নিজের ভেতরে অনেকগুলো কুঠুরি নির্মাণ করেছি।   মানুষ ও মনুষ্যত্বের অনুশীলনে  বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কুঠুরিতে প্রবেশ করি।  সেই কুঠুরির একটা আমার ধর্ম কুঠুরি। সেখানে আমি সাচ্চা মুসলমান।  ধর্র্মীয় জীবন একান্তই আমার জীবন। এই জীবন ধারণে।  জনবাহবা বা নিন্দা কোনোটাতেই আমি কুণ্ঠিত, বিব্রত ও ভীতসন্ত্রস্ত হই না। নিজের কাছে নিজেই জবাবদিহি করেই সন্তুষ্ট। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমার ধর্ম কুঠুরির ভাবজগৎ নিয়ে সমষ্টিতে আলোড়ন-আন্দোলন দেখা দিয়েছে। সমষ্টি আমাকে ত্যাজ্য করেছে। যেভাবেই ভাবা যাক  রাজনীতির সামষ্টিক কোনোক্রমেই ব্যষ্টিক বা স্বতন্ত্র অবস্থান স্বীকার করে না। কারণ, রাজনীতি মানবকল্যাণের একটি প্রকৃষ্ট উপায়, কোনো বিচ্ছিন্ন উপায় নয়। অন্যদিকে ব্যক্তি জীবন একান্তই ব্যক্তির। এখানে সমষ্টির প্রবেশ নিষিদ্ধ। ব্যক্তি এখানে সবকিছু।

  • বিষয়:
  • top
আরও পড়ুন

সর্বশেষ