শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪
প্রচ্ছদফিচারধর্ষিতা নই, আমি সুজেট জর্ডান

ধর্ষিতা নই, আমি সুজেট জর্ডান

suzette‘আমার নাম সুজেট জর্ডান। আমি আর কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণের শিকার নারী বলে পরিচিত হতে চাই না।’
টেলিফোনে বিবিসির দিল্লি প্রতিনিধির কাছে এভাবেই নিজের ইচ্ছার কথা জানান দুই কন্যাসন্তানের মা ৩৮ বছর বয়সী সুজেট জর্ডান। কারণ পরিচয় গোপনে রাখঢাক করার চেষ্টা চালাতে চালাতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। মিথ্যুক বলে পাল্টা অপবাদ আর হুমকি পেয়েছেন। এবার তিনি নিজেই বেরিয়ে এসেছেন প্রকাশ্যে। না, ধর্ষিতার পরিচয় নিয়ে আর অবরুদ্ধ জীবন কাটাতে ইচ্ছুক নন। বাঁচতে চান নিজের সুজেট জর্ডান পরিচয়েই। একা নন, ধর্ষণের ঘটনায় কোণঠাসা হওয়া অন্য সব নারীকে নিয়ে মাথা উঁচু করেই বাঁচতে চান তিনি। এ লক্ষ্যে ধর্ষিতদের সহায়তায় ‘সারভাইভারস ফর ভিকটিমস অব সোশ্যাল ইনজাস্টিস’ হেল্পলাইনে কাজ করছেন তিনি।
সেটা ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির ঘটনা। সেদিন কলকাতার বহুল পরিচিত এক নাইটক্লাব থেকে ফিরছিলেন তিনি। সঙ্গে বন্ধু বনে যাওয়া এক লোক। সুজেটকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে একটি গাড়িতে তোলে লোকটি। সেখানে অপেক্ষা করছিল আরও তিনজন লোক। গাড়িটি চলতে শুরু করতেই এই চারজন ধর্ষণ করে সুজেটকে। পথে পঞ্চম ব্যক্তি উঠে একই অপকর্মে যোগ দেয়। পরদিন সকালে গাড়ি থেকে তাঁকে ফেলে দেয় তারা।
তবে অনেকের মতো নীরব থাকেননি সুজেট জর্ডান। পুলিশ ও সংবাদমাধ্যম উভয়ের কাছেই মুখ খুলেছেন। টিভি ক্যামেরার দিকে পিঠ ফিরিয়ে কথা বলেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। এতে ব্যাপক হইচই পড়ে যায়। তবে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকেই আসে নিন্দার চাবুক। তিনি ‘মিথ্যুক’ বলে অভিহিত করেন সুজেটকে। বলেন, সুজেট জর্ডান এ কথা বলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
কলকাতাবাসী, এমনকি গণমাধ্যমও ক্ষুব্ধ হয় এ ঘটনায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া মন্তব্যের পর পরিচয় গোপন করার চেষ্টা চালিয়েও পার পাননি সুজেট। ক্ষুব্ধ জনতা তাঁর বাসভবনের বাইরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে। টেলিফোনে অনেকে মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দেয় সুজেটকে।
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা থেকে সুজেট সাড়া যে একেবারে পাননি, তা নয়। অভিযোগ ওঠা পাঁচজনের মধ্যে তিনজনকে গত বছরের মার্চে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বাকি দুজনকে গ্রেপ্তারে চলছে অভিযান। এর মধ্যে একজন মূল আসামি। গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বর্তমানে দ্রুত বিচার আদালতে চলছে তাদের বিচার।
এদিকে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকে একের পর এক দুর্ভোগের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন সুজেট। তাঁর ভাষ্য, ওই ঘটনার পর তাঁকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন বাড়িওয়ালা। দুই মেয়েকে নিয়ে নতুন বাসায় ওঠেন। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টায়নি। সেখানেও উত্সুক প্রতিবেশীদের কানাঘুষা। সমবেদনার বদলে কটুকাটব্য; যেন সুজেটেরই সব দোষ। বন্ধুর সঙ্গে নাইটক্লাবে যাওয়া, তাকে বিশ্বাস করাটা অপরাধ।
একপর্যায়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন সুজেট। তিনি বলেন, ‘যদি আমার দুই সন্তান না থাকত, তাহলে আমি হয়তো আত্মহত্যা করতাম।’ তাঁর দুই সন্তানের বয়স এখন ১৭ ও ১৪ বছর।
টেলিফোনে বিবিসি অনলাইনকে সুজেট বলেন, ‘সত্যিকারের পরিচয় লুকাতে লুকাতে আমি হয়রান। এই সমাজের নিয়মনীতি ও আইনকানুন নিয়েও আমি ক্লান্ত। বারবার লজ্জা পাওয়া নিয়েও হাঁফ ধরে গেছে। আমি ধর্ষিত হয়েছি, এই বোধ থেকে ভয় পাওয়া নিয়েও আমি নাকাল। এসব অনেক হয়েছে!’
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১২ সালে কলকাতায় যে ৬৮ জন নারী (পরিচয় গোপন রাখা) ধর্ষণের শিকার হন, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সুজেট জর্ডান তাঁদের একজন।
চলতি বছরের মে মাস থেকে যৌন নিপীড়ন ও গৃহে নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক ‘সারভাইভারস ফর ভিকটিমস অব সোশ্যাল ইনজাস্টিস’ হেল্পলাইনে কাজ শুরু করেন সুজেট। সেখানে কাজ করতে করতেই সাহস পেতে থাকেন সুজেট। এখানে কাজ করার অনুভূতি জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘অন্যের ব্যথা অনুভব করে মনে হতে থাকে, আমি যেন সেরে উঠছি।’
হেল্পলাইনে আরও অনেক নারীর ধর্ষণের ঘটনা শুনতে থাকেন সুজেট। এসব ঘটনার শিকার নারী, তাঁদের পরিবার ও সমাজের নীরবতা দেখে দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে তাঁর।
সম্প্রতি তিনি কলকাতায় ধর্ষণের শিকার আরেক নারীর পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন। এতে এই ভাবনা তাঁকে নাড়া দেয়, ধর্ষণের লজ্জা নিয়ে আর কত দিন কাটাবেন তাঁরা?
ধর্ষণের শিকার হলেই কি জীবন থেমে যাবে সুজেট জর্ডান বা তাঁর মতো নারীদের? তাই নতুন করে বাঁচার চেষ্টা শুরু। ধর্ষিত হিসেবে নয়, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চান সুজেট। তাই পরিচয় লুকিয়ে নয়, আর দশটা মানুষের মতো নিজের পরিচয়েই বাঁচতে চান তিনি। বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে

আরও পড়ুন

সর্বশেষ