সোমবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৪
প্রচ্ছদফিচারচাটগাঁর দুর্গ আন্দরকিল্লা

চাটগাঁর দুর্গ আন্দরকিল্লা

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা আমরা সবাই চিনি।তবে অনেকে জানেন না এর ইতিহাস। আন্দরকিল্লা অর্থ অভ্যন্তরীণ দুর্গ। চট্টগ্রামের এই আন্দরকিল্ল এলাকা সাধারণ মানুষের কাছে এখনও রহস্যময়। কথিত আছে, এই কিল¬ার আশপাশ জুড়ে প্রাচীন আমলে আরাকানীরা অনেক ধনরতœ লুকিয়ে রেখেছিল। মোগলদের আক্রমণের মুখে তারা এগুলো ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।
চট্টগ্রামের লালদিঘীর মাঠ, নন্দনকানন, হাজারী গলি ও রহমতগঞ্জের বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল এই দুর্গ। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট দুর্গটি মাটির তৈরি। এক সময় এর নাম ছিল আলেকজান্ডারের দুর্গ। ঘন জঙ্গলে আবৃত আন্দরকিল্লা ছিল আরাকানীদের সামরিক ঘাঁটি। এ দুর্গে সব সময় মজুদ থাকত কয়েক হাজার সৈন্য, হাত ও গোলাবারুদসহ অস্ত্রশস্ত্র। আরাকানরা ১৫শ’ খ্রিস্টাব্দ ও তার আগে থেকে প্রবল দাপটে এ অঞ্চলে শাসন করে আসছিল। মোলরা অনেকভাবে চেষ্টা করেছে তাদের পরাজিত করতে কিছু পারেনি। তাই আন্দরকিল্লা ঘিরে আধিপত্যের লড়াই চলে বেশ কয়েকবার। মোগলদের বিজয়ের পূর্বে আরাকানরাজের আমলেই এ দুর্গের নাম অনেকাংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। মূলত এই দুর্গ থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হতো বৃহত্তর চট্টগ্রামের রাজত্ব।
১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর যখন দাউদ কররানীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ জয় করে তখনও চট্টগ্রামের পুরো এলাকায় ছিল আরাকানীদের দাপট। তখন থেকে মোগলরা চট্টগ্রামের প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু পুরো চট্টগ্রাম ছিল ঘন বনে আবৃত। বিশাল এলাকা জুড়ে থাকত আরাকানীরা। যে নদী ও সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম আসার রাস্তা, প্রায় সম্পূর্ণ এলাকায় আরাকানী সৈন্যরা পাহারায় থাকত। তখন আন্দরকিল্লা অনেকটা কর্ণফুলীর পাড়ে। পার্শ্ববর্তী মাইলব্যাপী ছিল কয়েকটি বাঁশের কেল্লা। আন্দরকিল্লা এলাকায় ছিল দুটি কৃত্রিম বাঁধ। তবে এ বাঁধ কারা তৈরি করেছে তা নিয়ে মতবিরোধ আছে। ১৬৬৬ সালে আন্দরকিল্লার পতন হয়। তবে কিল্লার পতনের জন্য চেষ্টা চলছিল ১৬৬৪ সাল থেকেই। তৎকালীন মোগল নবাব শায়েস্তা খান ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে পৌঁছে আরাকানীদের পরাজিত করতে শপথ নেয়। আরাকানী দস্যুদের নিয়ে এলাকার মুসলমান ও ফিরিঙ্গীরা বেশ অসুবিধায় পড়েছিল। তখন তাদের দস্যুতার সীমা ছিল না। তাদের লুটতরাজ বন্ধ এবং রাকানীদের শায়েস্তা করার জন্য শায়েস্তা খান নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। তখন পর্যন্ত ফিরিঙ্গীরা ছিল আরাকানীদের সঙ্গে। তিনি বুঝলেন চাটগাঁর দুর্গ দখল করতে হলে যেভাবে হোক ফিরিঙ্গীদের আয়ত্তে আনতে হবে। ফিরিঙ্গীরা যাতে আরাকানরাজের পক্ষ ত্যাগ করে তার জন্য তিনি ভয়ভীতি সহ প্রায় সব রকমের কৌশল প্রয়োগ করেন। এক সময় ফিরিঙ্গীরা তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। ১৬৬৫ সালের ১১ নভেম্বর শায়েস্তা খান সন্দ্বীপ দখল করে সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। সন্দ্বীপে মোগল রাজধানী স্থাপনের খবর পেয়ে আরাকানীরা চাটগাঁর দুর্গে আরও সৈন্যসামন্ত বর্মঅর আরাকান থেকে আনার জন্য চেষ্টা চালায়। এদিকে ১৬৬৫ সালেল ২৪ ডিসেম্বর বুজুর্গ উমেদ খান ৭ হাজার ৫শ’ পদাতিক সৈন্য ২ হাজার ৫শ’ অশ্বারোহী ২৮৮টি রণপোত এবং ৩শ’ নৌ সৈন্য নিয়ে ঢাকা থেকে সন্দ্বীপের উদ্দেশ্য রওনা দেন। কয়েক দিনের মধ্যে উমেদ খান তাঁর সৈন্যসামন্তসহ ২১টি কামাল সজ্জিত বহর নিয়ে সন্দ্বীপে আসেন। ফিরিঙ্গীরাও নিজেদের এক জোট করে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্দে লিপ্ত হয়। চাটগাঁর দুর্গের যাত্রাপথ ছিল দুর্গম। তখন চট্টগ্রামে বাঘের রাজত্ব। বর্তমান শহরের প্রাণকেন্দ্রসহ কর্ণফুলী তীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা জুড়ে বাঘের প্রবল প্রতাপ ছিল। ফলে মোগলরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে জঙ্গল কেটে কেটে সন্দ্বীপ থেকে চাটগাঁর উদ্দেশে রওনা হন। নদী ও সমুদ্রপথে চলায় অভ্যন্ত মোগলদের স্থলপথে যুদ্ধ করতে যাওয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। স্থল পথে সৈন্যদের কুড়াল দিয়ে জঙ্গল কেটে যাত্রা করতে হচ্ছিল। অন্যদিকে উমেদ খান নদীপথে আরাকানে ঢুকে পড়েন। আরাকানে তিনি কিছু এলাকা জয় করে একটি দলকে স্থূলপথে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হবার নির্দেশ দেন।
এদিকে আরাকানীরা মনে করেছিল মোগলরা সংখ্যায় কম। তাই তাদের পরাজিত করতে বেগ পেতে হবে না। মোগল শক্তি সম্পর্কে তাদের মধ্যে ছিল বিভ্রান্তি। তারপরও কর্ণফুলী নদীর বিশাল এলাকা ও স্থলপথে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আরাকানীরা কুমিরা থেকে যুদ্ধ শুরু করে। স্থলপথে আসা সৈন্যরা এক সময় এক জোট হয়ে দুর্গে হামলা চালালে আন্দরকিল¬া থেকে আরাকানীরাও পাল্টা গোলাবর্ষণ শুরু করে। মোগলরা প্রবলভাবে আক্রমণ চালিয়ে একের পর এক আরাকানীকে পরাজিত করে দুর্গের দিকে এগিয়ে যায়। এরই মধ্যে উমেদ খান চট্টগ্রামে প্রবেশ করলে আরাকানী সৈন্যরা সাহস হারিয়ে ফেলে। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে চাটগাঁর দুর্গে প্রবেশ করে। এ সময় অনেক সৈন্য ও হাত নিহত হয়।
তখন কর্ণফুলীর বাঁশের কেল্লা জুড়ে আগুন জ্বলতে থাকে। আরাকানীরা ধনসম্পদ, ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। আর কখনও ফিরে আসেনি। উমেদ খান চাটগাঁর দুর্গের নাম রাখেন আন্দরকিল্লা। তাঁর আমলেও তিনি একে সৈন্য এবং অস্ত্রের দুর্গ বাবান। তিনি দুর্গের সংস্কার করে ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এটিই চট্টগ্রামের সবচেয়ে পুরনো মসজিদ। কিন্তু এক সময় ঐ মসজিদটি পরিত্যক্ত মসজিদে পরিণত হয়। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন চট্টগ্রামের শাসনভার গ্রহণ করে তখন থেকেই চাটগাঁর দুর্গের প্রতি তাদের নজর পড়ে। তারা ঐ পরিত্যক্ত মসজিদকে গোলাবারুদের গুদামে পরিণত করলে স্থানীয় মোগল ও মুসলমানদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। তারা ব্রিটিশ গবর্নরকে বার বার এটি সংস্কারের আবেদন জানায়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ঐ মসজিদের প্রয়োজনয়ি মেরামত করে সেখানে একটি শিলালিপি স্থাপন করা হয়। প্রায় দেড় শ বছরের পুরনো এই মসজিদ বর্তমানে ইতিাহসের সাক্ষী।
কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের লালদিঘী পাড়ে মাটির নিচে একটি দোতলা সিঁড়ি আবিস্কৃত হয়েছে। এতে বোঝা যায়, চাটগাঁর কিল্লা আসলে রহস্যময়। যদিও অবাধে পাহাড় কেটে পুরনো দিনের অনেক স্মৃতিচিহ্নকে মুছে ফেলা হচ্ছে। এককালের আরাকান, মোগল ও ব্রিটিশদের সামরিক ঘাঁটি বর্তমানে লাইব্রেরী পাড়ায় পরিণত হয়েছে। তারপরেও আন্দরকিল্লার ভূগর্ভে নির্মিত অনেক দোকানঘর প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।

  • বিষয়:
  • top
আরও পড়ুন

সর্বশেষ