সোমবার, মে ৬, ২০২৪
প্রচ্ছদলাইফস্টাইলবয়ঃসন্ধিকাল, আচরণীয় সমস্যা

বয়ঃসন্ধিকাল, আচরণীয় সমস্যা

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (WHO) ১০ থেকে ১৯ বছরের সময়টাকে বয়ঃসন্ধিকাল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বি.এড এর মডিউলে ১২ থেকে ১৯ বৎসর পর্যন্ত সময়কে বয়ঃসন্ধিকাল হিসেবে উল্লেখ করা আছে। তবে মোটামুটিভাবে বয়ঃসন্ধিকাল এর সীমারেখা ১৯ বছর পর্যন্ত। এর মধ্যে আবার দুটো পর্যায়ের ভাগও রয়েছে। বি.এড প্রশিক্ষণের মডিউল অনুযায়ী ১২-১৪ বৎসরকে প্রারম্ভিক বয়ঃসন্ধিকাল এবং ১৫-১৯ বৎসর পর্যন্ত প্রান্তিক বয়ঃসন্ধিকাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উইকিপিডিয়াতে যৌন পরিণতির(puberty) স্তরকেই বয়ঃসন্ধিকাল বা কৈশোরকাল বলা হয়েছে। তবে স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে বাল্যকাল এর শেষ পর্যায় ও কৈশোরের আগমনের সন্ধিক্ষণকে বয়ঃসন্ধিকাল বলে। Stanly Hall এর মতে, “বয়ঃসন্ধিকালের শিক্ষার্থীরা হলো ফ্লেপার অর্থাৎ যে পাখির এখনও পরিপূর্ণ পাখনা গজায়নি অথচ বাসাতেই উড়বার অব্যাহত চেষ্টা করছে”।

বয়ঃসন্ধিকালে ফিজিক্যাল এবং সেক্সচুয়াল দুই ধরণের ম্যাচুরিটিই হতে দেখি আমরা। এই সময়ে শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি ঘটে, পেশীর শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং যৌনাঙ্গেরও বৃদ্ধি ঘটে। এছাড়া মানসিকভাবে এদের মধ্যে বুদ্ধির পরিণমনতা আসতে থাকে। আত্মপরিচিতি অনুসন্ধানের একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। বিমূর্ত চিন্তা করার ক্ষমতা স্ফুটিত হবার ফলে যুক্তি তর্ক দিয়ে যে কোন কথা মেনে নেবার একটা আচরণ দেখতে পাওয়া যায়। আসলে এ বয়সটা এমন যে আবেগ অনুভূতি প্রকাশের জায়গাটা থাকে খুব তীক্ষ্ণ। অল্পতে মন খারাপ হয়, সমবেদনা পাবার একটা কামনা থাকে। বয়ঃসন্ধিকালের অন্তর্মুখী আচরণের জন্য একটা একাকী জগত তৈরি হয়। এসময়টা এত বেশি সংবেদনশীল যে যদি ছেলেমেয়েদের দিকে এই সময়টাতে বিশেষ দৃষ্টি না রাখা হয় তাহলে আমি বলব একটা বিপদের আশংকা থাকে। উদাহরণ দেবার মত প্রচুর ঘটনা আমাদের আশেপাশেই আছে। আমার নিজের এক আত্মীয় ১৫ বছর বয়সেতো আত্মহত্যাই করল। বহু আগে এক পত্রিকায় দেখেছিলাম এক ছেলে ঘুমন্ত অবস্থায় তার মা বোনদের উপর কেঁচি নিয়ে হামলা করেছে। মানসিক অবস্থার এই দুর্গতির ঘটনা আমাদের সমাজে প্রচুর ঘটছে। ছেলেমেয়েরা ড্রাগ নিচ্ছে, ইয়াবা সেবন করছে। এই ঘটনাগুলো কিন্তু এক প্রকার হতাশা থেকেই তৈরি হয়। তবে সব ক্ষেত্রে তা না বলা গেলেও বলা যায় অনেকগুলো ক্ষেত্রেই একথা সত্যি যে বয়ঃসন্ধিকালের হতাশা থেকে ছেলেমেয়েদের মধ্যে আচরণিক সমস্যা দেখা যায়। একটা ঘটনা মনে পড়ছে যখন মাস্টারমাইন্ডে চাকরিরত ছিলাম সে সময়কার কথা। আমার ক্লাসের একটা সেকশনে একটা ছেলেকে দেখি ভীষণ চুপচাপ। একেবারে নিথর পাথর মতন ছিল। কত বকেছি পড়া তৈরি করে না নিয়ে আসবার জন্য। কিন্তু প্রত্যুত্তরে কখনও কিছু বলতো না। একটা সময় পত্রিকায় খবর আসে যে সেই ছেলের মা তার দুই সন্তানকে নিয়ে আত্মহত্যা করেছে। মূলত পারিবারিক অশান্তি থেকেই ঘটনাটি ঘটেছিল। আমাদের দেশে পারিবারিক অশান্তির ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। এটা সামনে বাড়বে বৈ কমবে না। আর বয়ঃসন্ধিকালের নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়াও নতুন কোনো ঘটনা নয়। তাহলে এমতাবস্থায় করণীয় কী হতে পারে? হাতে হাত গুটিয়ে তো বসে কেবল চেয়ে দেখা যায় না। কিছু একটা করতেই হয়। আমার দৃষ্টিতে প্রথম যে কাজটা করা চাই সেটা হল পারিবারিকভাবে ছেলেমেয়েদের বেড়ে উঠবার এই সময়টা তদারকি করা এবং প্রত্যেকটা স্কুলে কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করা। আপাতদৃষ্টিতে প্রতিটি স্কুলে কাউন্সেলর এর ব্যবস্থা করা অসম্ভব বলে মনে হলেও এর একটা সহজ সমাধান আছে। প্রতিটি ক্লাসে একজন ক্লাস টিচার থাকেন। ক্লাস টিচারকে নির্দিষ্ট শ্রেণীর দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তিনি নিজে ক্লাসের প্রতিটি ছেলেমেয়ের আচরণ পর্যবেক্ষণ করবেন এবং প্রয়োজনে অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের সাথে পরামর্শও করে নিতে পারেন। প্রতি মাসে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাসহ অন্যান্য সার্বিক আচরণীয় পরিবর্তনের দিকগুলো বিবেচনা করে অভিভাবকদের সাথে একটা আলোচনার আয়োজন করতে পারেন। প্রতি মাসে যদি পারা সম্ভব না হয় তাহলে প্রতি টার্মে অভিভাবকদের সাথে কথা বলা যেতে পারে। তবে ক্লাসরুমে কোন শিক্ষার্থীর আচরণীয় সমস্যা চোখে পড়া মাত্রই তার সাথে কথা বলতে হবে। প্রয়োজনে পরিবারকে ডাকতে হবে। প্রতিটি স্কুলে যদি এভাবে একটা কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করা যায় তাহলে সমস্যা নিরসনের পক্ষে কিছুটা হলেও কাজ এগিয়ে যাবে বলে মনে করি। আর ক্লাস টিচার নিজেই যদি কাউন্সেলিং এর দায়িত্ব নেন তাহলে বাড়তি পয়সা খরচ করে আর কাউন্সেলর রাখার প্রয়োজন পড়বে না। তবে এক্ষেত্রে একটা রিস্ক থেকে যায় যে ক্লাস টিচার দায়িত্ব নিতে পারবেন কিনা। সেক্ষেত্রে বিবেচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং একজন দায়িত্ববান শিক্ষককেই এই দায়িত্ব হবে। আর পারিবারিক সচতনতার হিসেবটা তো আসবে সর্বাগ্রে। এটা না হলে যে ঠিক সমাধানটাকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে না! স্কুল তো আসলে আমাদেরকে পরবর্তী জীবনে সাফল্যের সাথে সমাজে টিকে থাকতে শেখায়। স্কুলের পরিবেশ হল বৃহৎ সমাজের একটা ক্ষুদ্রাংশ। তাই স্কুলের দায়িত্ব তো আছেই আমি বলব, তবে প্রধান দায়িত্ব কিন্তু ঠিকই অভিভাবকদের উপরে বর্তায়। তাই পারিবারিক একটা সুস্থ হাওয়া যদি ছেলেমেয়েদের ওপরে না পড়ে তাহলে স্কুলের ঐ গন্ডির অনেক চেষ্টাই কাজে লাগবে না। কারণ পরিবার যত সুক্ষ্মভাবে তার সন্তানকে বুঝবে শিক্ষক হয়ত ততখানি পারবেন না। এখন এখানে কথা হল পারিবারিক সুস্থ একটি পরিবেশ কীভাবে বজায় রাখা সম্ভব? কারণ এখন পরিবারে বাবা-মা উভয়ই চাকরি করেন। সামাজিক দায় সেরে নিয়ে ছেলেমেয়েদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়া আসলেই কঠিন। কিন্তু তারপরও ছেলেমেয়ের সাথে কিছু কোয়ালিটি সময় কাটাতে হবে। পুরো সপ্তাহে সম্ভব না হলেও সপ্তাহান্তে একটা সময় কাটানো চাই। আর প্রতিদিনকার রাতের খাবারের টেবিলেও কথা হতে পারে। বাবা-মায়েরা ক্লাস টিচারের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন। সপ্তাহে একটা সময় নিয়ে স্কুলে গিয়ে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খোঁজ করতে পারেন।

আসলে পারিবারিক দিক থেকে দায়-দায়িত্বের এই সমাধান অনেকখানিই শহর কেন্দ্রিক। গ্রামে যে সকল বাবা-মায়েরা লেখাপড়া জানেন না তাদেরকে গ্রুমিং করাটা বেশ কঠিন। সেক্ষেত্রে স্কুলকেই অধিকাংশ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। আর সরকারের তরফ থেকে যদি একটা সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেয়া হয় তাহলে ফলাফল কিছুটা হলেও ইতিবাচক হবে। এই কর্মসূচিগুলো অভিভাবক এবং শিক্ষক উভয়কে নিয়েই হলে ভালো হয়। নিয়মিত এলাকা ভিত্তিক বা গ্রাম ভিত্তিক কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে। টেলিভিশনে দূরপাঠের মাধ্যমেও বাবা-মায়েদের সন্তানদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকালের নানা সমস্যাকে কেন্দ্র করে সমাধান এর উপর আলোকপাত করা যেতে পারে। টিভিতে বিজ্ঞাপন দেয়ার মাধ্যমেও সেটা করা সম্ভব। প্রচার মাধ্যমগুলো একটু সামাজিক সচেতনতা মূলক কাজের উপরে জোর দিলে সেটাও আচরণীয় সমস্যা নিরসনের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে বলেই মনে করছি।

আসলে বয়ঃসন্ধিকালের সময়টা বড় অদ্ভুত। শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে আচরণের যে কি অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে! যা কিনা ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় অর্থেই ঘটে থাকে। আসলে এই পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। তবে একে অন্যান্য ঘটমান কোনো ঘটনার মত স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে গুরুত্বহীন করে তুললে চলবে না। গুরুত্বের জায়গাটা হল এই যে এই সময়টা সম্পর্কে জানতে হবে। বাড়তি পরিচর্যা করতে হবে। সতর্ক হতে হবে। দায়িত্ব শিক্ষক এবং অভিভাবক উভয়েরই। সরকারের যদিও কিছুটা দায় আছে। তবুও প্রকৃত দায় আমাদেরই কারণ আমরাই অভিভাবক এবং আমরাই শিক্ষক। বয়ঃসন্ধিকালের সময়টাকে যদিও এক কথায় বা অল্প কিছু কথায় বোঝানো সম্ভব না তবুও সকলের অন্তত এটা বোঝানো জরুরি যে সমাজের আদলে পরিবর্তন আসছে। সামনের জেনারেশনের জন্য পরিবর্তনটা হয়ত আরও স্পষ্ট হবে। সেক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের অভিভাবকহীন বাড়িতে একাকীত্বের সময়টা যে কেমন কাটবে সে আমরা অনুধাবন করতেই পারছি। কাজেই চাকরি করতেই হবে। আমরা ব্যস্ত থাকবই। তবে শত ব্যস্ততার মধ্যেও যে আমাদেরকেই আমাদের সন্তানদের দায় বহন করতে হবে! সেটা যেভাবেই হোক। জানবেন সমস্যা যখন আছে তখন সমাধান পাওয়া যাবেই। সচেতন নাগরিক হিসেবে তাই নিজ নিজ সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালের বেড়ে ওঠার সময়টাতে একটু বিশেষ যত্ন নিন। জানবেন আপনি কেবল আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ছেন না, সাজিয়ে নিচ্ছেন নিজের আগামি দিনগুলোকেও।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ