বুধবার, মে ১৫, ২০২৪
প্রচ্ছদইসলাম ও জীবনশহরের শেষ প্রান্তে গড়ে উঠছে আরেক মতিঝর্ণা

শহরের শেষ প্রান্তে গড়ে উঠছে আরেক মতিঝর্ণা

শহরের শেষ প্রান্তে গড়ে উঠছে আরেক মতিঝর্ণা। রেলওয়ে, গণপূর্ত ও চট্টগ্রাম ওয়াসার মালিকানাধীন পাহাড় দখল করে নগরীর সবচেয়ে ঝুঁর্কিপূণ বস্তি মতিঝর্ণা গড়ে উঠলেও নগরীর প্রান্তীয় এলাকায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে মতিঝর্ণার মতো আরেক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। মতিঝর্ণায় যাতায়াতের জন্য সড়ক ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদলে পাহাড়ের ঢালে ঢালে রাস্তা ও বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে জনবসতি ও মৃত্যুঝুঁকি। আর নতুন এ জায়গাটি হচ্ছে কৈবল্যধাম বিশ্বব্যাংক কলোনি ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বাস্তবায়নাধীন লেকসিটি হাউজিং প্রকল্পের পূর্বপাশের কনকর্ডের পাহাড়।

প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা এ বস্তিটি শহর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। কৈবল্যধাম বিশ্বব্যাংক কলোনির পূর্ব পাশে বাস্তবায়ন হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের লেকসিটি হাউজিং প্রকল্প এবং তার দক্ষিণ দিকেই রয়েছে কনকর্ড এমিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ডের প্রবেশ পথ। আর সেখান থেকেই দেখা যাবে পূর্ব পাশের বিশাল বিশাল উঁচু পাহাড়গুলোতে মানুষের ঘর-বসতি। পাহাড় বেয়ে উঠা এ বসতিতে প্রবেশের নির্ধারিত কয়েকটি পথ রয়েছে। পাহাড়ি উপত্যকা দিয়ে গড়ে তোলা এসব পথ দিয়েই এখানকার প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করছে।

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, পাহাড় কেটে পাহাড়ের ঢালে ও পাহাড়ের পাদদেশে ঘর তৈরি করে মানুষ বসবাস করছে। মতিঝর্ণা এলাকায় স্থায়ী বসতিদের পরিবর্তে ভাড়াটিয়া বেশি হলে জিয়া নগর নামের এই পাহাড়ি এলাকাটিতে স্থায়ী বসতির সংখ্যাই বেশি। দখলদারদের কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় একটি ঘর তোলার জায়গা কিনে নিজের টাকায় ঘর তৈরি করে বসবাস করছে তারা। সন্দ্বীপের নদী ভাঙন এলাকার চেমন আরা বলেন, ‘জায়গা কেনা ও ঘর তৈরিতে আমার প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন শুধু বিদ্যুৎ ও পানির বিল দিতে হয়।’

বস্তিবাসীদের কাছে জানতে চাওয়া হয় জায়গা কেনার টাকা কে নেয়? এ বিষয়ে শিল্পী আকতার নামের এক বসবাসকীরা জানান, পাহাড়ে আগে এসে যে জায়গা দখল করেছিল তার কাছ থেকেই ঘর তোলার জন্য জায়গা কিনে নিতে হয়। আর একেকটি প্লট (তিন থেকে চার কক্ষের একটি ঘর) ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়ে থাকে।

২০০৮ সাল থেকে বসবাসকারী শাম্মী আকবার জানান, আমরা আগে ফয়’স লেকের তিন নম্বর ঝিলে বসবাস করতাম। কনকর্ডের পক্ষ থেকে আমাদের উচ্ছেদ করে এখানে (পাহাড়ে) পুনর্বাসন করা হয়। আর তিন নম্বর ঝিলে এখন কনকর্ড সি ওয়ার্ল্ড গড়ে তোলা হয়েছে। পুরো এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কোথাও পাহাড়ের ওপরে, কোথাও পাহাড়ের ঢালে আবার কোথাও পাহাড়ের পাদদেশের নিচে ঘর তৈরি করে বসবাস করছে মানুষ। প্রায়  এক বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠা এই বস্তিতে ৭০০ ঘর রয়েছে এবং এসব ঘরে প্রায় ৫ হাজার মানুষ বসবাস করে বলে স্থানীয়রা জানায়। আর বসবাসকারীদের জন্য রয়েছে বিদ্যুৎ লাইন, ডিশ ক্যাবল লাইন ও পানির লাইন। কনকর্ড সি ওয়ার্ল্ডের গেইটের সামনে স্থাপন করা পাম্প দিয়ে পানি পাহাড়ের ওপরে স্থাপিত পানির টাংকিতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে পানি প্রত্যেক ঘরে ঘরে পৌছে দেয়া হচ্ছে। আবার পাহাড়ের উপরে প্রত্যেক ঘরে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার প্রযুক্তিও রয়েছে।

পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করতে ভয় লাগে কি-না এ প্রশ্নের জবাবে মোবারক হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘সামান্য কিছু টাকা দিয়ে ঘর তৈরি করে থাকা যাচ্ছে বলে মাসে মাসে ভাড়া লাগছে না। নিজের বাড়ির মতো থাকা যাচ্ছে। আমাদের যেহেতু ঘরবাড়ি নেই এটাই আমাদের ঘর-বাড়ি। এখানে থাকতে না পারলে কোথায় থাকবো। তবে পাহাড়ধসের ভয়তো থাকছেই।’

এদিকে পাহাড়ের প্রকৃত মালিক রেলওয়ে হলেও ২০০৪ সালে ৩০ বছরের দীর্ঘ চুক্তিতে রেলওয়ের কাছ থেকে ফয়’স লেক এলাকার ৩৩৬ দশমিক ৬ একর জায়গা বুঝে নেয় কনকর্ড। অভিযোগ রয়েছে, কনকর্ড সি ওয়ার্ল্ড তৈরির সময় ফিরোজশাহ কলোনির দুই ও তিন নম্বর ঝিলের বসতিদের এই পাহাড়ে পুনর্বাসন করেছিলেন। এ জন্য কনকর্ডের পক্ষ থেকে বস্তি এলাকায় পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় এখনো এই এলাকায় কনকর্ডের পাম্প দিয়ে পানি ও বিদ্যুৎ বস্তি এলাকাগুলোতে সংযোগ রয়েছে।

ঝুঁকিপূর্ণ এই বসতি তৈরিতে কনকর্ড সহায়তা করেছে কি-না প্রশ্নের জবাবে কনকর্ডের সহকারী ব্যবস্থাপক (অপারেশন সি-ওর্য়াল্ড) মাজহারুল ইসলাম গতকাল রাতে সুপ্রভাত বাংলাদেশকে বলেন, ‘অবশ্যই তারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে এবং পাহাড়ধসে যেকোনো বিপর্যয় হতে পারে। তবে আমরা বসবাসকারীদের নোটিশ ও মাইকিং করেছি।’

একদিকে পানি-বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং অপরদিকে উচ্ছেদের কথা বলা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য হচ্ছে জানালে মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘রেলওয়ে বস্তি উচ্ছেদ করে আমাদেরকে জায়গার দখল দেয়ার কথা, তারা না করে দিলে আমরা কিভাবে উচ্ছেদ করবো। এ জন্য রেলওয়ের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে।’

তবে রেলওয়ের পক্ষ বলা হচ্ছে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটলেও এর দায়ভার রেলওয়ে নেবে না। এবিষয়ে রেলওয়ের বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা আবদুল বারী বলেন, আমরা কনকর্ডকে জায়গা দিয়েছে এবং তারা এখন এই জায়গার মালিক। তবে পাহাড়ের অবৈধ বসতি উচ্ছেদের জন্য আমরা কনকর্ডের সাথে শিগগিরই মাঠ পর্যায়ে অভিযানে নামবো।

উল্লেখ্য, নগরীর মতিঝর্ণায় প্রতিবছর পাহাড় ও দেয়াল ধসে মানুষ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ জন্য মতিঝর্ণার পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করছে জেলা প্রশাসন। মতিঝর্ণায় প্রায় দেড় লাখ লোকের বাস। এখন যে হারে কনকর্ডের পাহাড়ে বসতি গড়ছে সেখানেও এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ