শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
প্রচ্ছদটপকরোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি ও বাংলাদেশে এর প্রভাব : নিজাম চৌধুরী

করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি ও বাংলাদেশে এর প্রভাব : নিজাম চৌধুরী

করোনাভাইরাস মহামারী-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে বিশ্বের সেরা অর্থনীতিবিদরাও বেশ চিন্তিত। ২০২০ সালের আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাজেট ৭২১.৫ বিলিয়ন ডলার পর্যায়ক্রমে ভারত, চীন, রাশিয়া, ইউরোপিয়ান দেশগুলো, ইরান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, অস্ট্রেলিয়া ও পৃথিবীর অন্য দেশগুলো মিলে যে পরিমাণ অর্থ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করা হবে তার অর্ধেকও যদি ব্যয় হ্রাসের একটি পরিকল্পনা সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেওয়া যায়, তাহলে পরবর্তী এক দশকে পৃথিবীকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা থেকে রক্ষা করা যাবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। যদি জাতিসংঘের উদ্যোগে সদস্য দেশগুলো মিলে একটি ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স করা যায় তা হবে সব দেশের জন্য একটি Eye opening initiative। মূল এজেন্ডা হবে সামরিক খাতে ৫০% ব্যয় হ্রাস।Nizam chy
 আর এ এজেন্ডায় যদি সব সদস্য রাষ্ট্র একমত হতে পারে তাহলে হয়তো বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকট থেকে পৃথিবীর সাড়ে ৭ বিলিয়ন মানুষকে রক্ষা করা যেতে পারে।

 

 অনেকে হয়তো আমার এ চিন্তাকে wishful thinking বলতে পারেন। কিন্তু আমার দৃঢ়বিশ্বাস, এটা করা সম্ভব। অন্যথায় পৃথিবী আগামী এক দশকে যে সংকটের সম্মুখীন হবে তা থেকে উত্তরণের বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। উন্নত দেশগুলো অনেক বেশি সমস্যার সম্মুখীন হবে তার কারণ তাদের লাইফস্টাইল ঠিক রাখতে হবে, অন্যথায় সামাজিক অস্থিরতা দেশগুলোকে গ্রাস করে ফেলতে পারে। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে আমেরিকাসহ বিশ্বব্যাপী যে মাত্রার প্রতিবাদের ঝড় পরিলক্ষিত হয়েছে তা কিন্তু শুধু পুলিশি নির্দয়তার বিরুদ্ধে মনে করলে ভুল হবে। তা ছিল মানুষের মনে দীর্ঘদিনের জমাট বেঁধে থাকা সব অনিয়মের বিরুদ্ধে চরম হতাশার হিংস্র বহিঃপ্রকাশ।

 লুটতরাজ, জ্বালাও-পোড়াও আর অগ্নিসংযোগের যে হিংসাত্মক থাবার আঘাত সারা পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, তা যেন পৃথিবীর মানুষ এক নতুন রূপের আমেরিকাকে আবিষ্কার করেছে।আয়ের বৈষম্য তথা সমন্বয়হীনতা : মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল বিষয় হলো Survival of the fittest। আমি অলস ঘরে বসে থেকে, পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করব তা তো কাম্য নয়। এ ছাড়া আজকের বিশ্বে সবাইকে বিশ্ব নাগরিক বলা হয়। যে কোনো বিষয়ে জানা, জ্ঞান আহরণ এখন শুধু clic of a mouse-এর ব্যাপার। ক্লাসরুম থেকেও ঘরে বসে অনেক বেশি জ্ঞান আহরণ করা এখন শুধু ব্যক্তির সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। একজন কীভাবে তার জীবনকে গড়ে তুলতে চায়, নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চায় কার জন্য Rocket Scientist হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

ছোটখাটো ব্যবসায়িক প্ল্যান নিয়ে শুরু করাটাই হলো সবচেয়ে কঠিন কাজ। আর সাহস নিয়ে শুরু করতে পারলেই দেখা যায় সফলতার হার শতকরা ৯৫ ভাগ। তাই আমি বিশ্বাস করি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে Income Inequality কে মনে করা হলেও তা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা সম্ভব সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে

যে কোনো দেশের ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের সরকারি পরিকল্পনার আওতায় পুঁজি ও কারিগরি সহায়তার সুযোগ সৃষ্টি করলেই এ সমস্যার অনেকটাই সমাধান হতে পারে। বাংলাদেশে এ সুযোগকে আরও অনেক বেশি সম্প্রসারণ করা এখন সময়ের দাবি। চীনারা এখন সারা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নে সবচেয়ে বড় অংশীদার। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুসহ বাংলাদেশের অনেক মেগা প্রজেক্টে কাজ করছে তারা। আফ্রিকা মহাদেশের বেশির ভাগ দেশে তাদের অবস্থান সুদৃঢ়। একসময় তারা কিন্তু এ পর্যায়ে ছিল না। অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে তারা আজ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একটি দক্ষ পরিশ্রমী জাতি ও সম্পদে পরিণত করেছে। চীন বিশ্বের বুকে আজ এক অন্যতম ইকোনমিক সুপার পাওয়ার। শুধু তাই নয়, চীনের সহযোগিতায় আগামী ১০০ বছরে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছবে- এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাব : বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দার কবল থেকে বেঁচে থাকতে হলে বাংলাদেশকেও অনেক পদক্ষেপ এখন থেকেই নিতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এর মধ্যে সর্বপ্রথম হলো সামরিক খাতে ব্যয় হ্রাস। বিলাসবহুল গাড়ি, বিলাসসামগ্রী, যেসব জিনিস মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকার জন্য অপরিহার্য নয় সেগুলো আমদানি বন্ধ করতে হবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য। দেশের অভ্যন্তরে প্রাইভেট কারের ব্যবহার কমিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন বাড়িয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে প্রো-অ্যাকটিভ সিটিউশনে আছে। ২০২১ সাল নাগাদ মেট্রোরেল পরিচালনা শুরু হলে এর একটি তৎক্ষণাৎ সুফল অর্থনীতিতে যুক্ত হবে। এ ছাড়া রেলসংযোগ আগের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত ও অনেক বেশি প্রসারণ ঘটেছে, যার ধারাবাহিকতা চলমান থাকবে। তাও অর্থনীতিতে পজিটিভ অবদান রাখবে। নাগরিকদের আগামী পাঁচ বছরের জন্য সকল প্রকার বিলাসিতা পরিত্যাগ করে শুধু ব্যাসিক জীবনযাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। মোবাইল ফোনের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে চিকিৎসা নিতে হবে, যাতে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়। করোনা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে, যে কারণে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শুধু আমাদের দেশে নয়, করোনার মতো মহামারী মোকাবিলার সক্ষমতা উন্নত দেশগুলোর যে ছিল না তা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। আমরা জাতি হিসেবে এমনিতে গঠনমূলক সমালোচনার চেয়ে অনেক বেশি নেগেটিভ বিষয়ে সমালোচনা করি, এমনকি ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ না করে বরং নিজেরা সবসময় নিজেদের সবকিছুর সমালোচনায় ব্যস্ত থাকি। কিন্তু এর থেকে উত্তরণ অথবা পরিত্রাণ কীভাবে পেতে পারি তা নিয়ে একেবারেই উদাসীন। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।

চীন-ভারত যুদ্ধের দামামা শুধু আঞ্চলিক শান্তিই বিনষ্ট করবে না, এ অঞ্চলের অর্থনীতিও পঙ্গু করে দেবে।

যে মুহূর্তে বিশ্ববাসী করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় নিজেদের তৈরি করছে, ঠিক তখন চীন-ভারতের লাদাখ সীমান্তে বিরাজমান উত্তেজনা এ অঞ্চলের দেশগুলোকে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। বাংলাদেশ যে বৈদেশিক নীতিতে  বিশ্বাসী – সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয় – জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ অমোঘ বাণীই হচ্ছে আমাদের বৈদেশিক নীতির চালিকাশক্তি। আমরা যেমনিভাবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে অত্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর তেমনিভাবে অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে চীনও আমাদের পরম বন্ধু। ভারত আমাদের মহান মুক্তিসংগ্রামের সময় ১ কোটি নিরীহ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। এ ছাড়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়লাভে ভারতের সহযোগিতার কথা যেভাবে আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সারা জীবন স্বীকার করছি, তেমনিভাবে অতীতের সবসময়ের চেয়ে বর্তমানে চীনের সঙ্গে আমাদের সব ধরনের সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব অত্যন্ত সুদৃঢ়। আমাদের দেশের অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সেক্টরে অংশীদারিত্ব এবং অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য চীনের প্রতিও আমরা অসম্ভব কৃতজ্ঞ। তাই আঞ্চলিক শান্তিরক্ষা ও করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলার চ্যালেঞ্জের ধকল কাটিয়ে উঠতে দুটো দেশকেই আমাদের পাশে বিশেষভাবে প্রয়োজন। এ ব্যাপারে পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের ভিন্ন ধরনের হিসাব-নিকাশ থাকলে থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের অবস্থান খুবই স্বচ্ছ। আমরা যে কোনো পরিস্থিতিতে চাইব না চীন বা ভারতের যুদ্ধংদেহী মনোভাব উসকে দিতে। আমরা আঞ্চলিক শান্তি ও অখ-তায় চরমভাবে বিশ্বাসী। অচিরেই চীন-ভারতের মধ্যকার সমস্যার আশু কূটনৈতিক সমাধান চাই। যুদ্ধ কখনো সমস্যার সমাধান দেয় না বরং নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে।

করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় বাংলাদেশের কৌশল : ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, আমাদের মূল কাজ হলো ১৮ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে পৃথিবীর চতুর্থ স্থানে। এসব সাফল্য ইতিমধ্যে আমরা অর্জন করেছি। শাক-সবজি উৎপাদনেও আমাদের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ ছাড়া দেশীয় ফল আম, কাঁঠাল, লিচু, কলা ছাড়াও আমাদের কৃষক বর্তমানে মাল্টা, কমলা, স্ট্রবেরি, ড্রাগনসহ নানা জাতের ফল উৎপাদন করছেন যা দেশীয় ভোক্তাদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বঙ্গোপসাগর-তীরবর্তী বাংলাদেশের সমুদ্র থেকে প্রচুর সামুদ্রিক মাছ আমাদের জেলেরা আহরণ করছেন। আমরা সামুদ্রিক মাছ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি। বর্তমান সরকার সমুদ্রকে ব্যবহার করে সমুদ্র অর্থনীতির দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। আমাদের দেশের উৎপাদিত চিংড়ি হোয়াইট গোল্ড হিসেবে এখন পৃথিবীর অনেক দেশে সুনামের সঙ্গে রপ্তানি হচ্ছে। পদ্মার অত্যন্ত সুস্বাদু ইলিশ মাছ যেন বিধাতার স্পেশাল উপহার বাংলাদেশের জন্য। প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে সামুদ্রিক ও হাইব্রিড পদ্ধতিতে উৎপাদিত মাছের সঙ্গে সঙ্গে মাংস উৎপাদনেও বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। উন্নত জাতের গরু উৎপাদনে আমাদের কৃষক অনেক এগিয়েছেন। বাংলাদেশের উন্নত জাতের ছাগল ব্ল্যাক বেঙ্গল টাইগার পৃথিবী বিখ্যাত। মুরগি ও হাঁস উৎপাদনে খামার পদ্ধতি চালু হওয়ায় দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির সক্ষমতা ইতিমধ্যে অর্জিত হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা যদি আগামী কয়েক বছর জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্য সামনে রেখে প্রতি ইঞ্চি জমি চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসতে পারি তাহলেই আমরা এ মন্দা থেকে মুক্তি পেতে পারি। তাই জননেত্রী শেখ হাসিনা সর্বপ্রথম ঘোষণা করেছেন, প্যানডেমিক-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না। তার দূরদর্শী পদক্ষেপের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অত্যন্ত কম প্রাণহানির মাধ্যমে যেভাবে করোনা মহামারী মোকাবিলা করছেন, তেমনিভাবে মহামারী-পরবর্তী মন্দা মোকাবিলায়ও তার প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকার কারণে আমরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক সফলতার সঙ্গে আসন্ন মন্দা মোকাবিলায় সক্ষম হব বলে আমার বিশ্বাস। এ ছাড়া দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমুদ্রসীমায় নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় হওয়ার পর তিনি সমুদ্রের অনাহরিত সম্পদ আহরণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের উন্নয়নে আমাদের সমুদ্রসম্পদ এক যুগান্তকরী ভূমিকা রাখবে তা একরকম নিশ্চিত বলা যেতে পারে। একজন ভিশনারি রাষ্ট্রনায়কের দেশপ্রেমিকতা কীভাবে একটা জাতিকে সকল প্রকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলতে পারে জননেত্রী শেখ হাসিনাই হচ্ছেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশের চলমান গ্রোথ রেট : বাংলাদেশের বর্তমান নমিনাল জিডিপির আকার ৩৭৩.৪৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার, ২০২০ সালের হালনাগাদ। জিডিপির (পিপিপি) আকার ৮৬০.৯১৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার। ২০২০-এর নমিনাল জিডিপি সূচকে ৩৯তম অবস্থানে। ২০১৯ সালে এবং জিডিপি পিপির সূচকে ৩০তম। আর আমরা যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিকে তাকাই তাহলে লক্ষ্য করব ২০১৮ সালের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৮ শতাংশ। ২০১৯ সালের প্রবৃদ্ধি ৭.৯ শতাংশ, আর ২০২০ সালের মহামারীর মধ্যেও ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে। যা একরকম অবিশ্বাস্য ব্যাপার। অর্থনীতি একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিধায় তা সম্ভব হবে। আবার ২০২১ সালের জিডিপির প্রবৃদ্ধি গিয়ে দাঁড়াবে ৯.৫ শতাংশে। এ তথ্যগুলোর ক্রম বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা উপলব্ধি করতে পারি করোনাবিহীন জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮.০১ শতাংশ হতে পারত। যা এবার ৬ শতাংশে নেমে যাবে। অন্যদিকে ২০২০ সালে মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ২ হাজার ১৭৩ ইউএস ডলার (নমিনাল) আর ৫ হাজার ৪৫৩ ইউএস ডলার হচ্ছে পিপিপি ২০২০ হালনাগাদ। উপযুক্ত পরিসংখ্যানটি পর্যালোচনা করলে সহজে অনুমান করা যায় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা ভালো ও উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে অবস্থান করছে। এবারের ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট ঘোষণার মাধ্যমে সরকারের আত্মবিশ্বাস অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পরিলক্ষিত হয়েছে।

রপ্তানি বাড়িয়ে আমদানি কমাতে হবে : ব্যাপক শিল্পায়নের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজের আমদানি শেষ নাগাদ রপ্তানি খাতের আউটপুট বাড়াতে ভূমিকা রাখে। এ আমদানিকে আমি পজিটিভ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি। আমদানি যদি রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি হয় তাহলে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি সৃষ্টি হয়, এ ছাড়া পরবর্তী বছরগুলোয় প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স অনেকাংশেই হ্রাস পেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নতুন নীতিমালার কারণে বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেবে। ফলে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর আয়ের যে ভূমিধস পতন ইতিমধ্যে হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানির অবিশ্বাস্য দরপতন, তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে ভয়ানক ঝুঁঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে দেশে ফিরে আসতে পারে। আমাদের অর্থনীতিতে এরও একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে সেজন্য আমাদের নতুন করে সৃজনশীল পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে- কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ঘাটতি পূরণ করা যায়। রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বহুমুখীকরণ হলো এ সংকট থেকে উত্তরণের অন্যতম উপায়। আমরা ইতিমধ্যেই ওষুধ, চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যাদি, পাটের তৈরি চট, বস্তা, চা, হিমায়িত মাছ, প্রক্রিয়াজাত শাক-সবজি, মাংস ও বিভিন্ন ধরনের অপ্রচলিত দ্রব্য রপ্তানির মাধ্যমে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করতে পারি। শ্রমশক্তি রপ্তানির ঘাটতি পূরণের জন্য আমরা দক্ষ প্রশিক্ষিত শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে পারি। এজন্য কোনো প্রাইভেট সেক্টরের ওপর এ দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া যায়। অবশ্য খুব কঠিনভাবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এ খাতকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হবে। স্কিল্ড লেবার ফোর্স যেমনিভাবে অনেক বেশি রেভিনিউ আয় করতে পারবে তেমনিভাবে দেশের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল হবে। আমরা যখন বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় যাই সেখানে বাঙালি শ্রমিকের অধিকাংশকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে দেখতে পাই। এটা সব সময় আমার কাছে বেশ পীড়াদায়ক মনে হয়। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা নিজের দেশে বিভিন্ন সামাজিক হীনমন্যতার কারণে যে কোনো কাজ করতে আগ্রহী হয় না। কিন্তু যখনই তারা আবার অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে বিদেশে যায় তখন যে কোনো কাজ করতে প্রস্তুত থাকে। অনেক সময় দেখা যায়, যেসব চাকরিকে সাধারণত অড জব বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরাও সেগুলো করতে সংকোচবোধ করে না। আমি এখানে বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করলাম।

বর্তমানে বাংলাদেশ আইটি সেক্টরের বিশ্ব Ranking-এ ২১তম স্থানে অবস্থান করছে। আমাদের দেশ বর্তমানে ফ্রিল্যান্সার আইটি Expertises-এর দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আছে। ৪০-৪৫ হাজার ফ্রিল্যান্সার আইটি বিশেষজ্ঞ ৫০০-৬০০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন প্রতি বছর। সরকারের টার্গেট হচ্ছে ২০২৪ সাল নাগাদ এ সেক্টরের রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীতকরণ। প্যানডেমিক-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির আইটিনির্ভরতা বর্তমান সময়ের চেয়েও ৬০-৭০ গুণ বেড়ে যাবে। আমাদের জন্য তা হবে একটা বিশাল সুযোগ এবং এর শতভাগ সুবিধা নেওয়ার টার্গেট নিয়েই সেক্টর-সংশ্লিষ্টরা এগিয়ে যাচ্ছেন।

করোনা মহামারী-পরবর্তী বাস্তবতা : বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করোনাভাইরাস প্যানডেমিকের কোনো সুনির্দিষ্ট ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। ভাইরাসটি কবে নাগাদ বিশ্ব থেকে পুরোপুরি চলে যাবে বা এর ইনফেক্টিং ক্যাপাসিটি হারাবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত কোনো দেশের বিশেষজ্ঞরা বলতে পারছেন না। হয়তো বা এ ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের দীর্ঘদিন বসবাস করতে হবে। তবে অচিরেই এ ভাইরাসটি বিশ্বমানবতাকে স্বস্তির সুসংবাদ দিয়ে চিরবিদায় নেবে- এ প্রত্যাশা আমরা করতে পারি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের জীবনযাত্রা প্রি-প্যানডেমিক যুগের চেয়ে অনেক সংকুচিত হয়ে যাবে যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সঙ্গে কোনোভাবেই মিল থাকবে না। তাই আমাদের সবাইকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের জন্য। অর্থনীতিতে এরও একটি ব্যাপক প্রভাব পড়বে, ছোট ছোট লেনদেনগুলো কমে যাবে, আর সেটাই হচ্ছে অর্থনীতির জীবনীশক্তি। আজকের বিষয়বস্তুটি নিয়ে লেখাটি আরও অনেক দীর্ঘায়িত করার সুযোগ থাকলেও আজ আর লম্বা করতে চাই না। তবে একটি বিষয় আমাদের সবাইকে অনেক বেশি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে, তা হলো দীর্ঘদিনের গতানুগতিক অভ্যাস থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে একটি বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ও আত্মোপলব্ধি করতে হবে। আর্থিকভাবে যাদের অবস্থা বেশির ভাগ জনগণের তুলনায় ভালো ও সন্তোষজনক তাদের ভাবতে হবে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে এ সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যায়। আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের মুক্তি দেবে না, বরং বিধাতার দেওয়া সুযোগ কাজে না লাগিয়ে আমাদের এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। শুধু সরকারের দিকে সব বিষয় নিয়ে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। সরকার থেকে পাওয়া সুযোগ-সুবিধা থেকে আজ যারা শত, হাজার ও লাখো কোটি টাকার মালিক তাদের এগিয়ে আসতে হবে অনেক বেশি প্রশস্ত হাত নিয়ে, নতুবা এ সমাজ টিকে থাকবে না। আর সমাজ ধ্বংস হয়ে গেলে আপনাদের এসব সম্পদ মূল্যহীন হয়ে পড়বে। এখানে একটি বিষয় নিয়ে আগেভাগেই বলে রাখতে চাই, অনেকে হয়তো বলতে পারেন আমি কে পুরো জাতিকে জ্ঞান দেওয়ার?অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই- কাউকে জ্ঞান দেওয়া, ছোট অথবা বড় করা আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, শুধু আমার নিজের অনুভূতিই শেয়ার করছি। লেখাটি যদি একজনকেও মোটিভেট করতে পারে তাতেই মনে করব আমি সার্থক। আসুন সবাই একসঙ্গে ভালো থাকি, সুস্থ থাকি।

  লেখক : রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ