শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
প্রচ্ছদদেশজুড়েচট্টগ্রাম বিভাগএনজিও ব্যবসা চালু রাখার জন্য তারা চাইছে রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হউক

এনজিও ব্যবসা চালু রাখার জন্য তারা চাইছে রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হউক

রোহিঙ্গারা শিক্ষা এবং সচেতনতার দিক থেকে একেবারে পিছিয়ে পড়া একটি জাতি। তাদেরকে ব্রেইন ওয়াশ করা অতটা কঠিন নয়। সেই সুযোগটাই নিচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করা এনজিও সংস্থাগুলো। নিজেদের সেবার নামে ব্যবসা ‘জিইয়ে’ রাখতে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে (মিয়ানমারে) ফেরত না যেতে উৎসাহিত করছে। এমন অভিযোগ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি ও স্থানীয় সচেতন মানুষের। এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশকে ‘রোহিঙ্গা’ অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে দেশি-বিদেশি ১৫০টিরও বেশি এনজিও সংস্থা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তারমধ্যে  বেশ কিছু এনজিও সংস্থার অপতৎপরতা খুবই আপত্তিকর। এসব চিহ্নিত এনজিও’র কর্মকর্তারা বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে আসার ইন্ধন দিয়েছে এবং এখন ফেরত না যেতে উৎসাহিত করছে এমন অভিযোগও আছে। জাতিসংঘের দাতা সংস্থা থেকে শুরু করে এমন কোন এনজিও নেই যারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চায়। তারা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত না যেতে উৎসাহিত করছে। এরমধ্যে কিছু এনজিও’র কার্যক্রম সরাসরি দেশবিরোধী।

হ্যান্ডিক্যাপ নামে এনজিওতে কর্মরত এক ব্যক্তি (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানান, এনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের না যাওয়ার বিষয়ে বেশি উৎসাহিত করে। তাদেরকে (রোহিঙ্গা) কখনোই বুঝায় না যে, এক সময় তাদেরকে স্বদেশে ফেরত যেতে হবে। স্ব-স্ব এনজিও’র উচ্চ পর্যায়ের নিদের্শনা মানতে গিয়ে স্থানীয় যারা চাকরিতে আছে, তারাও এ অপতৎপরতায় লিপ্ত হতে বাধ্য হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, আইনত রোহিঙ্গারা কাজ করার অধিকার না রাখলেও ভলান্টিয়ার বানিয়ে তাদেরকে এনজিও’র চাকরিতে নিচ্ছে। এরফলে রোহিঙ্গারা আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হয়ে যাচ্ছে। তারা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে সক্ষম হচ্ছে। ফলে স্বদেশে ফেরত যাওয়ার মানসিকতা লোপ পাচ্ছে। এটি আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, দেশি-বিদেশি এনজিওদের অপতৎপরতা ও পর্দার আড়ালে যে সব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে তা খুবই উদ্বেগজনক। তাদের কর্মকাণ্ড নজরদারিসহ মনিটরিং করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, সরকার যতই চেষ্টা করুক না কেন, এনজিও সংস্থাগুলো চাচ্ছে না তারা স্বদেশে ফেরত যাক। এমনকি ইউএনএইচসিআরের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ অহরহ রয়েছে। কারণ রোহিঙ্গারা চলে গেলে তাদের (এনজিও) ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যবসা চালু রাখার জন্য তারা চাইছে এই সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি হউক।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট গণহত্যা তথা রোহিঙ্গা নিপীড়ন শুরু করে সেদেশের সেনাবাহিনী ও উগ্র রাখাইনরা। তাই ২৫ আগস্টকে ‘গণহত্যা’ দিবস অ্যাখ্যায়িত করে শনিবার উখিয়া ও টেকনাফের প্রতিটি শিবিরে রোহিঙ্গারা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।

উখিয়ার স্থানীয় কয়েকজন সচেতন মানুষ সিভয়েসকে জানান, বিক্ষোভের সময় ইংরেজিতে লেখা ব্যানার ও রোহিঙ্গাদের গায়ে প্রতিবাদী ভাষায় লেখা টি-শার্ট ছিল। বেশ কয়েকটি জায়গায় টি-শার্ট ও ব্যানার একই ধরনের। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কারা রোহিঙ্গাদের এই টি-শার্ট ও ব্যানার সরবরাহ করেছে। অঘোষিতভাবে হঠাৎ করেই রোহিঙ্গারা কিভাবে এত সংগঠিত হলো ? এসব বিষয়ে আরও মনিটরিং দরকার।

বেশিরভাগ বিক্ষোভকারীর মুখে স্লোগান ছিল, মিয়ানমারে তাদের ফেরার মত নিরাপদ পরিবেশ নেই। এরজন্য শর্তজুড়ে দিয়েও স্লোগান দেয়। তারা বলেন, আগে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারে নিরাপদ বলয় তৈরি করতে হবে। তারপর তারা ফেরত যাবেন।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান বলেন, এনজিও সংস্থাগুলোর উচিত তাদেরকে (রোহিঙ্গা) মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার বিষয়ে এখন থেকে সচেতন করা। কারণ প্রত্যাবাসন যখন শুরু হবে, তখন যেন কোন সমস্যার মধ্যে পড়তে না হয়। কিন্তু শোনা যায়, এনজিও সংস্থাগুলো সচেতন করার বিপরীতে না যেতে উৎসাহিত করছে বেশি। এটা এনজিও সংস্থার কাছ থেকে মোটেও কাম্য নয়। কারণ এই সমস্যা আমরা দীর্ঘমেয়াদী বহন করতে পারবো না।

খোঁজ নিয়ে গেছে, রোহিঙ্গারা আসার পর থেকে পেছনের সারিতে থাকা স্থানীয় এনজিওগুলোও এখন আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে গেছে। এসব এনজিও বিদেশি ডোনার এজেন্সির পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। তারাও বিদেশি এনজিওগুলোর মত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত না যাওয়ার বিষয়ে প্রলুব্ধ করছে।

আবার রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে এমনও এনজিও সংস্থার আবির্ভাব হয়েছে, যেগুলোর আগে নাম পর্যন্ত শোনেনি কেউই। এসব ভূঁইফোড় এনজিওগুলোর কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি আপত্তিজনক। অভিযোগ আছে, হঠাৎ আবির্ভাব হওয়া এসব এনজিও রোহিঙ্গাদের মধ্যে উগ্রতা ছড়াতেও কাজ করছে। সম্প্রতি শূরা নামে একটি অদৃশ্য সংস্থার কর্মকাণ্ড দেখা গেছে রোহিঙ্গা শিবিরে। তারা সরাসরি রোহিঙ্গা শিবিরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নগদ টাকা বিতরণ করে। এবং বিভিন্ন উগ্রবাদ মূলক পরামর্শ দেয়।

ক্যাম্প-৬ এর কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা জানান, কোরবানের ঈদের আগের সপ্তাহে হঠাৎ একটি মাইক্রো নিয়ে ক্যাম্পে প্রবেশ করে ৬ জন মৌলভী। তারা গাড়ি থেকে নেমেই ৬জন ৬দিকে চলে যায়। এরপর প্রতিটি বাড়িতে নগদ টাকা বিতরণ করে। টাকা দেওয়া শেষে কয়েকজন রোহিঙ্গাকে জড়ো করে বিভিন্ন কথা বলেন। এ সময় তারা নিজেদেরকে ‘শূরা’ নামে একটি এনজিও সংস্থার কর্মকর্তা বলে দাবী করেন।

জানা গেছে, বিভিন্ন ‘অবস্থা সম্পন্ন’ এনজিও সংস্থার স্টিকার ব্যবহার করে গাড়ি নিয়ে শূরার কর্মীরা রোহিঙ্গা শিবিরে প্রবেশ করে। এরপর শিবিরে ঢুকে নগদ টাকা বিতরণ করে। ক্যাম্পে যাওয়ার সময় চেকপোষ্টের ব্যবস্থা না থাকার সুযোগে এই অপতৎপরতা চালাতে সুযোগ পাচ্ছে তারা।  শূরার মত অপতৎপরতা চালাচ্ছে ইকরা, আসিয়াব, ইসলামীক রিলিফ, মুসলিম এইড ও মারসি মালয়েশিয়া, এসকেবি, আল্লামা ফয়েজুল্লাহ ফাউন্ডেশন, পালস বাংলাদেশসহ আরও কয়েকটি এনজিও সংস্থা।

রোহিঙ্গা শিবিরে সবচেয়ে বেশি অপতৎপরতা চালাচ্ছে এসকেবি (স্মল কাইন্ডনেস অব বাংলাদেশ) নামে একটি এনজিও সংস্থা। এই সংস্থার প্রত্যেকেই শিবিরের সাবেক এবং বর্তমান দায়িত্বশীল। বর্তমানে এই সংস্থার নেতৃত্ব দেয় চট্টগ্রামের সাবেক এক শিবির নেতা।  এসকেবি’র অর্থের জোগান হয় বেশির ভাগই হুন্ডির মাধ্যমে। এছাড়াও তুর্কির বিভিন্ন এনজিও থেকেও সংস্থার অর্থের জোগান আসে। এটি সম্প্রতি এনজিও ব্যুরো থেকে বাতিল হওয়া ৪১টি সংস্থার মধ্যে একটি। কিন্তু তারপরও তাদের অপতৎপরতা থেমে নেই। সম্প্রতি প্রশাসনের অগোচরে রোহিঙ্গা শিবিরে এক হাজার গরু বিতরণ করেছে সংস্থাটি।

সম্প্রতি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ৪১টি এনজিওর কার্যক্রমে আপত্তি দিয়ে এনজিও ব্যুরোতে চিঠি পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে ৪১ এনজিওকে রোহিঙ্গা শিবিরে কার্যক্রম চালানোর ওপর নিষিদ্ধ করে এনজিও ব্যুরো।

নিষিদ্ধ ঘোষিত এনজিওগুলোর মধ্যে রয়েছে- ফ্রেন্ডশিপ, এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ, আল মারকাজুল ইসলাম, স্মল কাইন্ডনেস বাংলাদেশ, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, গ্রামীণ কল্যাণ, অগ্রযাত্রা, নেটওয়ার্ক ফর ইউনিভার্সাল সার্ভিসেস অ্যান্ড রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট, আল্লামা আবুল খায়ের ফাউন্ডেশন, ঘরনী, ইউনাইটেড সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট, পালস বাংলাদেশ, মুক্তি, বুরো-বাংলাদেশ, এসএআর, আসিয়াব, এসিএলএবি, এসডব্লিউএবি, ন্যাকম, এফডিএসআর, জমজম বাংলাদেশ, আমান, ওব্যাট হেলপার্স, হেল্প কক্সবাজার, শাহবাগ জামেয়া মাদানিয়া কাসিমুল উলুম অরফানেজ, ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান অ্যাফেয়ার্স, লিডার্স, লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন, অ্যাসোসিয়েশন অব জোনাল অ্যাপ্রোচ ডেভেলপমেন্ট, হিউম্যান এইড অ্যান্ড রিলিফ অর্গানাইজেশন, বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিশ, হোপ ফাউন্ডেশন, ক্যাপ আনামুর, টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স ইনকরপোরেশন, গরীব, এতিম ট্রাস্ট ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি এনজিও।

একটি সূত্রে জানা গেছে, এসব এনজিও বাতিলের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ রোহিঙ্গা শিবিরে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালানোর পরিবর্তে অপতৎপরতা চালানোর অভিযোগ।  জানা গেছে, এনজিওতে যেসব বিদেশিরা কাজ করে, তাদের বেশির ভাগেরই জব ভিসা নেই। তারা ভ্রমণ ভিসায় এসে চাকরি করছে। এক্ষেত্রে আইনি জটিলতা এড়ানোর জন্য প্রতি ৪৫ দিন পর আশপাশের বিভিন্ন দেশ থেকে ঘুরে আসে তারা। যেমন- মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, নেপাল ইত্যাদি। এরফলে তারা সহজেই সরকারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখে ধুলো দিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ