শনিবার, মে ১৮, ২০২৪
প্রচ্ছদচট্রগ্রাম প্রতিদিনজনগণকে সন্তুষ্ট রেখে, পরিবেশের ক্ষতি না করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবে সরকার

জনগণকে সন্তুষ্ট রেখে, পরিবেশের ক্ষতি না করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবে সরকার

বাঁশখালীতে গুলি করে মানুষ মেরে সরকার বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে চায় না বলে মন্তব্য করে জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন বলেছেন, স্থানীয় জনগণকে সন্তুষ্ট রেখে, পরিবেশের ক্ষতি না করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবে। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আগের মতো ধোঁয়া বের হয় না। ১৫ এপ্রিল বিকেলে গণ্ডামারায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নিহত চারজনের পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে মোট ৬০ লাখ টাকা অনুদানের চেক হস্তান্তরকালে তিনি এসব কথা বলেন। চার পরিবারের বাইরে গুরুতর আহত ১১ জনের পরিবারকে দেওয়া হয় ১ লাখ টাকা করে।

বিকেলে জেলা প্রশাসক নিহত দুই ভাই ও এক জামাতার বাড়ি যান। এ সময় জেলা পুলিশ সুপার হাফিজ আকতার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান, এস আলম গ্রুপের পরিচালক (কারিগরি) শহীদুল আলম, হেড অব করপোরেট হুমায়ুন কবির, ব্যবস্থাপক (এস্টেট) মোস্তায়িন বিল্লাহ, সহকারী ম্যানেজার বিমল মিত্র, বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামসুজ্জামান, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স্বপন কুমার মজুমদার, স্থানীয় গণ্ডামারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরিফ উল্লাহ, সরল ইউনিয়নের আমিনুর রশীদ চৌধুরী, বদি আহমদ, এনামুল হক সিকদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। জেলা প্রশাসকসহ উপস্থিত সবাই নিহতদের কবর জেয়ারত করেন। তাদের আত্মার শান্তি ও দেশের সমৃদ্ধি কামনায় মোনাজাত করেন মাওলানা মোহাম্মদ ইয়াকুব।

জেলা প্রশাসক বলেন, যেকোনো বড় উন্নয়নমূলক কাজে টুকটাক ঘটনা-দুর্ঘটনা হয়। কিন্তু আমরা জানমালের ক্ষতি হোক তা চাই না। এ ধরনের ঘটনা আমাদের ধারণারও অতীত। বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। আপনাদের দাবি নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিবেচনা করবে সরকার। কারও যদি ঘর সরাতে হয় তবে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এটা ঠিক সারা দেশের মানুষ বিদ্যুৎ চায়। এখানে যা হয়েছে তা ভুল বোঝাবুঝি।

তিনি বলেন, দেশে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। চীনে হাজার হাজার আছে। ভারতে আছে। আমাদের দেশে খুলনায় হচ্ছে। আধুনিক যুগে আগের মতো পরিবেশ দূষণ করে না কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আমরা জোর করে কিছু করবো না। বাঁশখালীতে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্রম বড় পর্দায় দেখানো হবে। আমরা এখান থেকে যারা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শন করতে চায় তাদের বড় পুকুরিয়া নিয়ে যাবো। চীনে নিয়ে যাবো। স্থানীয় জনগণকে সন্তুষ্ট না করে সরকার কিছু করবে না। আপনারা দাবি জানিয়েছেন বলে চট্টগ্রামের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে আমি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে পুলিশ সুপার এসেছি। যেকোনো দাবি থাকলে আপনারা যে কমিটি করেছেন তার মাধ্যমে আমাদের কাছে নিয়ে আসবেন। যৌক্তিক দাবি মেনে কাজ করবো। জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হবে না।

পুলিশ সুপার বলেন, যারা মারা গেছে তাদের আর ফেরত পাবো না। আপনারা যে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন তা নিয়ে এসেছি। নিহতের ভাই দাবি জানিয়েছেন, প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনার জন্যে। একই সঙ্গে নিরীহ মানুষকে হয়রানি না করার জন্যে। বিষয়টি আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। সামনে ইউপি নির্বাচন। এখানে পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছে তার উন্নতি ঘটাতেই আমরা এসেছি। আপনাদের কোনো ক্ষতি হোক তা চাই না। যা ঘটেছে অনাকাঙ্ক্ষিত। শুধু আপনাদের নয়, আমাদের মনেও দাগ কেটেছে। সুষ্ঠু বিচারের জন্যে আপনাদের সহযোগিতা চাই।

তিনি বলেন, এ চার পরিবারের সন্তানেরা বাপ হারিয়েছে। মেয়ের জামাতা হারিয়েছে। আমরা আপনাদের পাশে আছি। আমাদের অফিসারদের বলে দিচ্ছি, তারা কয়েকমাস পর পর এ চার পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়াসহ সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নেবে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না আমরা। পুলিশ বা জনসাধারণ কোনো পক্ষ থেকেই যেন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে। আশাকরি, গ্রামবাসী, প্রশাসন আগামী দিনে একসাথে পথ চলবে।

চেয়ারম্যান আমিনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, পরশু আমরা দাবি জানিয়েছি। আজ দাবি পূরণ হয়েছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই।  আনুষ্ঠানিকভাবে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার সংঘর্ষে নিহত নূর আহমদের ছেলে জাকের আহমদের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম, মৃত ওমদ আলীর ছেলে জাকের হোসেনের স্ত্রী আকতার বেগম, মৃত আশ্রফ আলীর ছেলে আনোয়ার প্রকাশ আনকুরের স্ত্রী কোহিনূর আকতার, মৃত আশ্রফ আলীর অপর ছেলে মরতুজা আলীর দুই স্ত্রী নূর নাহার ও রুজী আকতারের হাতে ১৫ লাখ টাকার করে চেক তুলে দেন। এ সময় তাদের সন্তানেরাও উপস্থিত ছিলেন। জেলা প্রশাসক বলেন, ১ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা গেলেও ইসলামি ফরায়েজ অনুযায়ী নির্ধারণ করে দেওয়া সন্তানদের টাকাগুলো ব্যাংকে এফডিআর করে রাখতে হবে।

নিহতের ভাই বশির আহমদ বলেন, ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে সে জন্যে শহীদের পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি আনন্দিত। কিন্তু আমার একটি দাবি মামলার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক প্রকৃত দোষীদের যেন শাস্তি দেওয়া হয়।

চেয়ারম্যান আরিফ উল্লাহ বলেন, নিহত চার পরিবারের মাসুম বাচ্চাদের পড়াশোনা, বিবাহযোগ্য কন্যাদের বিয়েশাদি, পরিবারগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এ জন্য প্রশাসন ও এস আলম গ্রুপের এককালীন অনুদানের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সহযোগিতা চাই। একই সঙ্গে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দাবি করছি।

গুরুতর আহত হিসেবে ১ লাখ টাকার করে চেক পেয়েছেন চরপাড়ার বদি আহমদের ছেলে আব্দুল খালেক, মৃত কবির আহমদের ছেলে মো. ইদ্রিস, হাদির পাড়ার নুরুল আমিন পেটনের ছেলে মুজিবুর রহমান, হোসেন আলীর ছেলে আবু খাঁন, মাতব্বর পাড়ার সৈয়দ আহমদের ছেলে আনছার উল্লাহ, হাদিও পাড়ার শেয়ার আলীর ছেলে নুরুল ইসলাম, পূর্ব গণ্ডামারার আবুল খায়েরের ছেলে জহিরুল ইসলাম, মোস্তাগ আলীর ছেলে মনি আহমদ, শফি আলমের মেয়ে কুলছুমা বেগম, মো. বাদশা মিয়ার মেয়ে মরিয়ম বেগম ও পশ্চিম পাড়ার ওমর মিয়ার ছেলে মো. আদুল্লাহ। চরপাড়ার উত্তর পশ্চিম গণ্ডামারার আছ ছালেহী জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব চেক হস্তান্তর করেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার।

বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে নিহতদের পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণসহ ৯ দফা দাবি দেয় গণ্ডামারা ইউনিয়ন বাঁচাও আন্দোলন। বুধবার বিকেলে গণ্ডামারা হাদির পাড়া সাইক্লোন সেন্টার মাঠে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ ঘোষণা দেন বাঁশখালীর সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। এসব দাবি পূরণের পর বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে জনগণ যদি মনে করে এর মাধ্যমে এলাকার উন্নয়ন হবে তবে এটি নির্মাণে বাধা দেওয়া হবে না বলেও ঘোষণা দেন তিনি।

এদিকে, চট্টগ্রাম জেলায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন বিষয়ে ১৬ এপ্রিল বিকেল তিনটায় জেলা প্রশাসক চট্টগ্রামের সম্মেলন কক্ষে এবং ১৭ এপ্রিল সকাল ১১টায় বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) ড. আহমেদ কায়কাউস এবং মহাপরিচালক পাওয়ার সেল মোহাম্মদ হোসাইন সভা দুটিতে অংশ নেবেন। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারাও সভায় উপস্থিত থাকবেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ