মঙ্গলবার, মে ৭, ২০২৪
প্রচ্ছদচট্রগ্রাম প্রতিদিনরেলের কাজ কে পাবেন তা ঠিক করেন সরকারি দলের ৩ নেতা

রেলের কাজ কে পাবেন তা ঠিক করেন সরকারি দলের ৩ নেতা

পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট) কোটি কোটি টাকার কাজ কে পাবে তা যুবলীগ ও ছাত্রলীগের তিন নেতা ঠিক করে দেন। দরপত্র জমা দেয়ার আগে সাধারণ ঠিকাদারদের শরণাপণœ হতে হয় তাদের কাছে।
রেলের প্রকৌশল দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, রেলের বর্তমান টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছে হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। ঐ নেতার অধীনে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের আরো নেতা রয়েছে। টেন্ডার নিলামের সময় মাঝে মাঝে টাকা ভাগ ভাটোয়ারার কারণে এদের মধ্যে সংঘর্ষও বাধে। এই নেতাদের নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আছে। কাজ পাওয়ার জন্য এসব নেতাদেরকে পারসেনটেজ দিতে হয় ঠিকাদারদের।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, আগে রেলের টেন্ডার একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করত মহানগর যুবলীগের কার্যকরী সদস্য মশিউল আলম দিদার, খুলশী থানা যুবলীগের কার্যকরী সদস্য ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম শামীম, এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ নেতা ও নগর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়াসিম উদ্দিন, এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মহসিন ও সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেতারা।
কিন্তু তাদেরকে টপকে বর্তমানে রেলের বেশিরভাগ টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছে বাবর। কোনো কোনো সময় টেন্ডারবাজি নিয়ে এই গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘর্ষও বাধে। তখন পুরো সিআরবি এলাকায় গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রকাশ্যে অস্ত্র মহড়া চলে। এর ফলে রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ ঠিকাদারদেরকে ভয়ে সন্তস্ত্র থাকতে হয়।
অভিযোগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য হেলাল আকবর চৌধুরী বলেন, আমি কোনোদিনও রেলভবনে যাইনি। আমি কেন টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতে যাব ? এছাড়া এই পর্যন্ত কোনো ঠিকাদার আমার কাছে অভিযোগ করেনি যে আমিই টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছি। হ্যাঁ, আমার যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ছেলেরা রেলের ছোটখাটো কাজ করে রুটি রোজগার করছে। এগুলোতো নিয়ন্ত্রণ বলে না এবং অন্যায় কিছু না। তারা তো আর গিয়ে সেখানে মারামারি বা কাউকে বাধা প্রদান করছে না। আপনারা শুধু শুধু আমাকে জড়াচ্ছেন।
তবে এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মহসিন বলেন, রেলের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের সাথে টাইগার পাস এলাকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম, মহানগর যুবলীগ নেতা দিদার ও বর্তমানে কেন্দ্রীয় যুবলীগ সদস্য হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর আলী জড়িত । তারাই রেলের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছে।
নিজের সম্পর্কে মহসিন বলেন, আমি রেলের কোনো টেন্ডার কাজের সাথে জড়িত নই। আমি ছোটোখাটো কয়েকটা বিলবোর্ডের ব্যবসা করি।
রেলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, টেন্ডার কাজ মানে একটা ঝামেলা, সরকারদলীয় নেতাদের তদবির ও কাজ পাইয়ে দিতে তোড়জোড় করা। টেন্ডারবাজরা প্রকাশ্যে অস্ত্র মহড়া দেয়ায় সাধারণ ঠিকাদাররা ভয়ে ভয়ে থাকে। ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রেলের নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন উপস্থিত থাকলেও তাদেরকে অনেকটা কোনঠাসা হয়ে থাকতে হয়।
এই ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী একেএম মাহাবুবুল আলম বলেন, টেন্ডার নিয়ে ঝামেলা বাইরে হয়। আমাদের অফিসের ভেতরে কোন ঝামেলা হয় না। তবে মাঝে মাঝে শুনি অনেকেই অফিসে এসে টেন্ডার নিয়ে ঝামেলা করেছে। তাদের নামগুলো সঠিক বলতে পারছি না।
এদিকে চলতি বছর বেশ কয়েকজন ঠিকাদার রেলের বিভিন্ন কাজের দরপত্র জমা দিতে না পেরে রেল কর্মকর্তাদের নিকট অভিযোগ করেছেন।
গত ২০ মার্চ রেলের ১৬ কোটি টাকার দরপত্র জমা দিতে পারেনি মেসার্স রহুল আমিন ভূঁইয়া ট্রের্ডাস। রেলওয়ে পশ্চিম জোনের ঈশ্বরদী থেকে দর্শনা পর্যন্ত নুড়ি পাথর সরবরাহ কাজের দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিনে সিআরবি কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে।
পরে ঐ প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. হাসান দরপত্র জমাদানে সন্ত্রাসীদের বাধা, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া এবং সিআরবি ভবন এলাকায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকার বিষয়টি রেলওয়ে মহাপরিচালক, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালককে অবহিত করেন।
তার পরের মাস এপ্রিলের ২৯ তারিখ চট্টগ্রামের পুরাতন রেলওয়ে স্টেশনের গাড়ি পার্কিং এর কাজ নিলামের মাধ্যমে ৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় পান আবু বক্কর ছিদ্দিকি নামের এক ব্যক্তি। নিলামের পর জাকির হোসেন হিরু নামের এক ঠিকাদার অভিযোগ করেন সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাধার মুখে নিলামে অংশ নিতে পারেননি তিনি।
ঐ মাসের শেষ দিকে কালুরঘাট রেল সেতুর টোল আদায় নিয়ে পুনঃদরপত্র আহ্বান করে কর্তৃপক্ষ। ফোর স্টার এন্টারপ্রাইজ ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে ঐ কাজ বুঝে নেয়। কিন্তু প্রথম দরপত্রে ঐ কাজের সর্বোচ্চ দর উঠেছিলো ৪ কোটি ৫৮ লাখ ২৭ হাজার ৭৭৫ টাকা। এর ফলে রেল কর্তৃপক্ষকে প্রায় ১ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হারাতে হয়।
পরে এ বিষয়ে আমরীন এন্ড ব্রাদার্স ও তেজারত ট্রেডিং নামের দুইটি প্রতিষ্ঠান রেলমন্ত্রী মুজিবল হক ও রেল পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা এহছানে এলাহীর নিকট অভিযোগ দেন।
অপরদিকে মে মাসের ২৮ তারিখ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রকৌশল বিভাগের অধীনে ২০ লাখ টাকার বিল্ডিং সংস্কার কাজের দরপত্র দাখিল করাকে কেন্দ্র করে যুবলীগ নেতা মশিউর রহমান দিদার ও ফোর স্টার গ্রুপের সদস্য ছোটন বড়–য়া, পিন্টু চৌধুরী, অজিত ও হুমায়ুন কবির রানা ছুরি, হকিস্টিক নিয়ে সিআরবি এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দেয়।
ঐ ঘটনায় দরপত্র জমা দিতে না পারায় রাজু এন্টারপ্রাইজ ও নুর নাহার ট্রেডার্স নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবরে লিখিত অভিযোগও দেন।
দরপত্র নিয়ে একই রকম ঘটনা গত ৫ ফেব্রুয়ারিও ঘটে। পরে ঐ টেন্ডারটি বাতিল করে দেয় রেল কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে রেলের সিআরবি কার্যালয়ের ভূমি শাখার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, টেন্ডারবাজদের কারণে আমাদের ভয়ে থাকতে হয়। টেন্ডারকে কেন্দ্র করে গত সপ্তাহে বড় বড় কিরিচ নিয়ে সিআরবিতে মহড়া দিয়েছে সন্ত্রাসীরা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ