সোমবার, মে ৬, ২০২৪
প্রচ্ছদদেশজুড়েচট্টগ্রাম বিভাগঅন্য জেলা থেকে চট্টগ্রাম নগরীতে এসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অপরাধীরা

অন্য জেলা থেকে চট্টগ্রাম নগরীতে এসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অপরাধীরা

স্থানীয় অপরাধীর সংখ্যা হাতে গোণা। চট্টগ্রাম নগরী দাপিয়ে বেড়ানো অপরাধীদের অধিকাংশই অন্য জেলার বাসিন্দা। কেউ এখানে স্থায়ী আবাস গেড়ে অপরাধ করে বেড়াচ্ছে, কেউ আবার বাইরে থেকে বেড়াতে আসার ফলে সপ্তাহ দশদিন থেকে অপরাধ করে উধাও হয়ে যাচ্ছে। পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাগণও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গে সিএমপির মিডিয়া উইং ও নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো: বাবুল আকতার  বলেন, নগরীতে যাবতীয় অপরাধ সংঘটনের নেপথ্যে অন্য জেলার অপরাধীরাই মূলত দায়ী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এদের কেউ বহু বছর আগে চট্টগ্রামে চলে এসে এখানেই বসত গেড়েছে; আবার কিছু আছে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতেই বাড়ি ছেড়ে এখানেই রয়ে যাচ্ছে আর অপরাধ করছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে তার বাড়ির ঠিকানায় তা যাবে। পাশাপাশি এখানে দিব্যি ভালো মানুষ সেজে থাকলে পুলিশ তাকে খুঁজে পাবে না।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নগরীতে প্রায় সবরকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেই দাপট দেখিয়ে চলেছে দেশের অন্য জেলার অপরাধীরা। খুন গুম থেকে শুরু করে ছিনতাই, অজ্ঞান কিংবা মলম পার্টির দৌরাত্ম্য, মোটর সাইকেল চুরি থেকে ঘরে ডাকাতিসকল অপরাধে জড়িতদের বেশিরভাগ নোয়াখালী, বরিশোল, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ঢাকা, বরগুনা অঞ্চলের বাসিন্দা। চলতি মাসে নগরীতে এ ধরনের অন্তত ত্রিশ অপরাধী ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।

সিএমপির সূত্র মতে নগরীতে ছিনতাই কাজে জড়িতদের প্রায় সকলেই চট্টগ্রামের স্থানীয় নয়। ছিনতাই গ্রুপগুলোর মধ্যে ঢাকা থেকে দুটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে জামালকামাল দুই ভাই। এ দুটি গ্রুপের ৩৫ জন সদস্যের প্রায় সকলেই বরিশালের লোক। রয়েছে নুরুল আলম গ্রুপ, নূর হোসেন গ্রুপ ও আলমগীর গ্রুপ। এ তিনটি গ্রুপ আগে এক থাকলেও পরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে তিনটি গ্রুপ তৈরি করে। নোয়াখালী কেন্দ্রিক গ্রুপ তিনটির সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে চট্টগ্রামে। এছাড়া কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোটের নোয়াপাড়া গ্রামের জসীমের নেতৃত্বে কুমিল্লা গ্রুপ, যশোরের সাইফুল আলম স্বপন গ্রুপ, কুমিল্লার নাজির উদ্দিন নাইজ্যা গ্রুপ, ফেনী ও ব্রাক্ষ্মণ বাড়িয়ার রফিককবির গ্রুপ, নোয়াখালীর নাজিম গ্রুপ, ও নোয়াখালীর আপেল মিন্টু গ্রুপ ছিনতাই করে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক অভিযানে বেশ ক’জন ধরা পড়েছে কিন্তু বাকিরা ঠিকই সক্রিয় রয়েছে। অজ্ঞান ও মলম পার্টির একটি বৃহৎ অংশ বাইরের জেলা থেকে এসে নগর জুড়ে অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে। নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার বাবুল আকতার জানান, গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ২০ জনের অধিক সিএনজি অটোরিক্সা চালকের তথ্য আছে যারা অপরাধের সাথে জড়িত এবং অন্য জেলার বাসিন্দা। সিএনজি চালানোর ভান করে তারা নগরীতে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। অপরাধীদের এই তালিকায় সম্প্রতি আটক হয়েছে চার মামলার আসামি কুমিল্লা মুরাদনগরের আইনুল, খাগড়াছড়ি দীঘিনালার জলিল মাঝি, দুই মামলার আসামি হাতিয়ার আলম ও লক্ষ্মীপুরের নিজাম উদ্দিন।

গত ৪ জুন মলম পার্টির অন্যতম সদস্য নোয়াখালির হাতিয়া থানার উত্তর ভূমিহীন বাজারের হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে নগরী ও জেলায় ৭টি মামলা রয়েছে।গত ১ জুন হালিশহর থানার চৌচালা বালুর মাঠ এলাকা থেকে গাড়ি চোর চক্রের চার সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতরা হল, নোয়াখালি জেলার বেগমগঞ্জ থানার বাংলাবাজার এলাকার মো. আলাউদ্দিন সাগর (২৬), একই থানার দুর্গাপুর এলাকার মো. শহিদ (৫০), ফেনী সদর এলাকার মো. মনির (২৯), ররগুনা জেলার পাথরঘাটা থানার মো. মঞ্জুর ওরফে জাকির (৩৬)

গত ২৬ জুন থেকে ২৭ জুন টানা অভিযান চালিয়ে নগরীতে মোটর সাইকেল চোর চক্রের চার সদস্যকে আটক করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। আটককৃতরা হলো বাগেরহাটের মোঃ আসাদুল্লাহ প্রকাশ আসাদ , বরিশালের মোঃ নূরুল ইসলাম প্রকাশ সুলতান , কাইয়ূম ও আনোয়ার । আটককৃত নূরুল ইসলাম প্রকাশ সুলতানকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, সে তার সহযোগী আসাদুল্লাহ আসাদ, কাইয়ুম, আনোয়ার, রিয়াজ, ঢাকাইয়া নজরুল, সোহেল, জুয়েল নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে মোটর সাইকেল চুরি করে। নূরুল ইসলাম প্রকাশ সুলতান এক সময় ঢাকার বংশাল রোডে “মায়ের দোয়া অটো মোবাইল” নামের গাড়ির পার্টস এর দোকান করতো। ঢাকা শহরে ৪/৫ বৎসর গাড়ি চুরির পর পুলিশ খোঁজাখুঁিজ করলে সে চট্টগ্রাম শহরে পালিয়ে আসে। ফেণীর মোটর সাইকেল চোর দলের নেতা টিটুর সাথে হাত করে চট্টগ্রাম শহরে মোটর সাইকেল চুরির কাজে লিপ্ত হয় নূরুল ইসলাম সুলতান। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি আসাদুল্লাহ প্রকাশ আসাদ পেশায় একজন মোটর সাইকেল মিস্ত্রি। ইতিপূর্বে মোটর সাইকেল চুরি করার পর ডিএমপি, ডিবি কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার পর অনেক দিন হাজতবাস করে। পরবর্তীতে তার সহযোগী নূরুল ইসলাম প্রকাশ সুলতান চট্টগ্রাম শহরে আসলে সেও চট্টগ্রামে আসে। হোটেলে অবস্থান করে ২/৩ মাস কাজ করার পর বাড়ি চলে যায়।

চট্টগ্রাম নগরীতে বতৃমানে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে পুলিশের চাকরিচ্যুত কনস্টেবল খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে একটি চক্র । গত ২৬ জুন খলিলসহ দু’জনকে গ্রেফতারের পর এ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। খলিলের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার উজিরপাড়া এলাকায়। তার গ্রুপে থাকা সেলিম হাওলাদার, জামশেদ সহ আরো কয়েকজন রয়েছে, যাদের কেউই চট্টগ্রামের নয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিদর্শক পরিচয়ে একটি ছিনতাইয়ের ঘটনার পর গত ২৭ এপ্রিল খলিলকে নগরীর দামপাড়া পুলিশলাইন থেকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। জামিনে বের হয়ে এসে খলিল গত মঙ্গলবার ‘ডিবি পুলিশ’ পরিচয়ে একজনের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা ছিনতাই করে নেন।এরপর কোতোয়ালি থানা পুলিশ কৌশলে খলিল ও তার সহযোগী জাহাঙ্গীরকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নগরীর জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে থেকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

গোয়েন্দা পুলিশের তথ্যানুযায়ী গত তিন মাসে বেশ কিছু অপরাধী জামিনে মুক্ত হয়ে জড়িয়ে পড়ছে পুরনো পেশায়। এদের মধ্যে আইনুল হক, আবুল কাশেম, রিয়াজ, শাহীন, আলম, শাহাদাত, নিজাম উদ্দিন, আবুল কালাম, মিরাজ, এমরান হোসেন, বেলাল, মনির, বোরহান উদ্দিন, বাকের হোসেন, বাচ্চু, আমির হোসেন, আবু সিদ্দিক, শাহাব উদ্দিন, ফেরদৌস, কাউসার, আসিফ, হানিফ, কিরণ, আলতাফ, ইকবাল, প্রবীর, গোলাম সরওয়ার, ইমন, বিশু, লিটনসহ আরও কয়েকজন জামিনে বেরিয়ে ছিনতাইকারী অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে বলেও তথ্য আছে পুলিশের কাছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর রোজার আগে ঢাকা, বরিশাল, ভোলা ও নোয়াখালী থেকে কয়েকটি চক্র এসে নগরীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে উঠে। এরা প্রথমে বিভিন্ন বিপণি বিতান ও ব্যাংকবীমা পর্যবেক্ষণ করে। এরপর কৌশল ঠিক করে নিয়ে ছিনতাই শুরু করে।

গত ৩ ও ৯ জুন নগরীর পুথক স্থান থেকে নগর গোয়েন্দা পুলিশ ও হালিশহর থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে হামকা গ্রুপের প্রধান ঢাকাইয়া আলমগীরসহ সাত ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে, যারা অন্য জেলার বাসিন্দা হলেও দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামকেই তাদের অপরাধের কেন্দ্রে পরিণত করেছে।

৯ জুন হালিশহর থানা পুলিশের একটি দল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে ছিনতাইচক্র ‘হামকা’ গ্রুপের প্রধান মো. আলমগীর ওরফে ঢাকাইয়্যা আলমগীরকে গ্রেফতার করে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অপর সদস্যকে নগরীর সরাইপাড়া থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার আগে ৩ জুন নগরীর কোতোয়ালী থানার টাইগারপাস এলাকা থেকে হামকা গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড হাত কাটা জাহাঙ্গিরসহ পাঁচ ছিনতাইকারীকে আটক করেছে পুলিশ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ