বুধবার, মে ২৯, ২০২৪
প্রচ্ছদইন্টারভিউকাদের মোল্লার যত কু-কর্ম

কাদের মোল্লার যত কু-কর্ম

kader mollah chattro unionষ্টাফ  রিপোর্টার  (বিডিসময়২৪ডটকম)

মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির রায় কার্যকর হতে যাচ্ছে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার। যেকোনো মুহূর্তে তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে। একাত্তরে ‘মিরপুরের কসাই’ বলে পরিচিত দেশের এই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা আগে ছিলেন ফরিদপুরের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা। সেখান থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন তিনি।

ঊনসত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে জাতীয় পর্যায়ে ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে জড়িত হন কাদের মোল্লা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রসংঘ আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হলে তিনি ঢাকার মিরপুরে ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করেন এবং এ বাহিনীর একজন কমান্ডার হন।

ধারণা করা হচ্ছে কু-কীর্তিতে খ্যাত কাদের মোল্লার ফাঁসি বৃহস্পতিবার রাতেই। এখন সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে তার ফাঁসির মঞ্চের দিকে। মানুষ খুন করার মতো জঘণ্য কাজগুলো তিনি করতেন নির্দ্বিধায়। কী কারণে কুখ্যাত এই জামায়াত নেতা তা সবাই জানে। চলুন আমরা আবার একটু দেখে আসি তার কু-কীর্তিগুলো:

কাদের মোল্লার কু-কর্মের তালিকা
১. ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবসহ সাতজনকে মিরপুর ১২ নম্বরের সামনে গাছের সঙ্গে বেঁধে হত্যা করে কাদের মোল্লাসহ সঙ্গীরা।

২. কাদের মোল্লার নির্দেশে ২৭ মার্চ নারী কবি মেহেরুন্নিসা, তার বৃদ্ধ মা এবং তার দুই ভাইকে জবাই করে হত্যা করে অবাঙালিরা। কবি মেহেরুন্নিসা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কবিতা লিখতেন।

৩. ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মিরপুরের কালাপানির ৫ লাইনের ২১ নম্বর বাড়িতে ঢুকে কাদের মোল্লার নির্দেশে হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা ও মেঝ মেয়ে আমেনাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হয়রত আলীর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে জবাই করা হয়। ২ বছরের শিশুকে আছাড় দিয়ে মারা হয়।

৪. খন্দকার আবু তালেব ইত্তেফাকে চাকরি করতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কবিতা লিখতেন এবং বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যোগ দিতেন। কাদের মোল্লার নির্দেশে তাকে জল্লাদখানায় নিয়ে হত্যা করা হয়।

৫. শহীদনগরে কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে দু’মুক্তিযোদ্ধা ওসমান ও আব্দুল গনিকে হত্যা করা হয়।

৬. ১৯৭১ সালে রাজধানীর পল্লবীর আলোকদি গ্রামে কাদের মোল্লার নির্দেশে ৩৪৪ জনকে হত্যার অভিযোগ।

৭. ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সিরামিক ইন্ড্রাস্ট্রির গেইটে কসাই কাদের মোল্লা তার দলবল নিয়ে একটি মিটিংয়ে আক্রমণ করেছিল। নির্বিচারে মানুষ মেরেছিল কসাইয়ের মতো জবাই করে। ভারী হয়ে উঠেছিল ঐদিন মিরপুরের আকাশ বাতাস।

৮. কুখ্যাত খুনি হিসেবে তিনি তার এলাকা মিরপুরে জল্লাদ ও কসাই নামে পরিচিত ছিল।

৯. এখানে হাজার হাজার বাঙালির হত্যার প্রধান নায়ক ছিলেন জল্লাদ কাদের মোল্লা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিহারীদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের বিপক্ষে নের্তৃত্ব দিয়েছেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২) এ, ৩ (২) জি, ৩ (২) এইচ, ৪(১ ও ২) ধারায় ২০১২ সালের ২৮ মে অভিযোগ গঠন করা হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ বিচার হয় কসাই কাদের মোল্লার। ট্রাইব্যুনাল ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তে  ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধর্ষণ, খুন ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। এখানে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনীত ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হয়েছে।

এরপর এ রায়ে সন্তষ্ট হতে পরেনি দেশের সাধারণ জনগণ। রাস্তায় নেমে আসে তারা। সংসদে পরিবর্তন করা হয় ট্রাইব্যুনাল আইন। ওই আইন অনুযায়ী চলতি বছরের ৩ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। এরপর কাদের মোল্লাও রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। ৫ ডিসেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশা করেন। পূর্ণাঙ্গ রায় ৭৯০ পৃষ্ঠার। এতে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। সম্প্রতি এ ফাঁসির আদেশ কার্যকরের ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সিদ্ধান্ত আসে কারাগার থেকে।

স্বজাতির বিরুদ্ধে দাঙ্গা বাঁধান!
একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে জানানো আহ্বানের মধ্য দিয়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে কাদের মোল্লা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ইঙ্গিতে ও জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গোপন নির্দেশে ঢাকার মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা শুরু করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেন।

আর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত থেকেই শুরু হয় তার নেতৃত্বে বিহারিদের যোগসাজশে ঢাকার মিরপুরে বাঙালি নিধনযজ্ঞ। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার দখলদার বাহিনী, সহযোগী বাহিনীসহ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের অধিনায়কের কাছে আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতেই কাদের মোল্লা মানবতাবিরোধী নানা অপরাধ সংঘটিত করেন।

ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে ছাত্রসংঘে
ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামের  মরহুম সানাউল্লা মোল্লার ছেলে আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৪৮ সালের ২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকায় ৪৯৩ বড় মগবাজারের গ্রিন ভ্যালি অ্যাপার্টমেন্টের ৮/এ ফ্ল্যাটে থাকতেন।

কাদের মোল্লা ১৯৬১ সালে সদরপুর উপজেলার আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনস্টিটিউশনে ৮ম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে বিএসসি প্রথম বর্ষে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে নাম লেখান। বিএসসি ২য় বর্ষের শেষের দিকে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের কলেজ শাখার সভাপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

১৯৬৮ সালে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন কাদের মোল্লা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তিনি শহীদুল্লাহ হলে থাকতেন এবং ১৯৭০ সালের অক্টোবরে তিনি শহিদুল্লাহ হল ছাত্রসংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন।

কাদের মোল্লার যতো অপরাধ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ গঠন করা অভিযোগ, ৯৬ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্য এবং ৩৮৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, ষড়যন্ত্র ও উস্কানির ৬টি অভিযোগ আনা হয়।

এগুলোর মধ্যে ৫টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে আর বাকি ১টি রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি বলে গত ৫ ফেব্রুয়ারির রায়ে বলেছিলেন ট্রাইব্যুনাল। তবে ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে ৬টির প্রতিটিই প্রমাণিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

১৭ সেপ্টেম্বর ওই চূড়ান্ত রায় দেওয়া হয় এবং ৫ ডিসেম্বর ৭৯০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।

ওইসব ঘটনার স্থান হিসেবে মিরপুর ১২ নম্বর থেকে মিরপুর ১ নম্বরসহ শাহ আলী মাজার পর্যন্ত এবং ঘটনার সময় হিসেবে একাত্তর সালের ২৫ মার্চ থেকে ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধরা হয়েছে।

এসব অভিযোগ ও রায় অনুসারে, ঢাকার মিরপুর ১০ নং বাসস্ট্যান্ড, মিরপুর জল্লাদখানা, মিরপুরের শিয়ালবাড়ি ও রূপনগর, মিরপুর ৬নং সেকশন, মিরপুর ১২ নম্বর সেকশন, মিরপুরের কল্যাণপুর, ঢাকার মোহাম্মদপুর এবং ঢাকা জেলার কেরাণীগঞ্জের শহীদনগরে হাজার হাজার বাঙালি হত্যার প্রধান খলনায়ক ছিলেন আব্দুল কাদের মোল্লা।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বিহারিদের যোগসাজশে কাদের মোল্লার নেতৃত্বে মিরপুরে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। স্বাধীনতার পর দেশের অন্যতম বৃহৎ গণকবর আবিষ্কৃত হয় মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে।

প্রমাণিত প্রথম অভিযোগে বলা হয়, আলবদর বাহিনীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা তার সহযোগী ও অবাঙালি বিহারিদের নিয়ে মিরপুরের বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে জোর করে ধরে এনে মিরপুর-১২ নম্বর থেকে ১ নম্বর এবং ১নং শাহ আলী মাজার থেকে হাতে দড়ি বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে পুনরায় মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে ঈদগাহ মাঠে নিয়ে এসে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখেন। পল্লবের দেহ দু’দিন ঝুলিয়ে রেখে তার সহযোগী আলবদর বাহিনীর সদস্য ও অবাঙালি বিহারিদের দিয়ে পল্লবের আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলেন। ৫ এপ্রিল কাদের মোল্লার নির্দেশে ও উপস্থিতিতে তার প্রধান সহযোগী আলবদর আক্তার গুণ্ডা পল্লবের বুকে পরপর ৫টি গুলি করে হত্যা করেন। এর দু’দিন পর পল্লবের লাশ মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনে কালাপানি ঝিলের পাশে আরও ৭ জনের সঙ্গে মাটি চাপা দেওয়া হয়।

জানা যায়, মিরপুর-১১ নম্বর বি ব্লক তালতলা নিবাসী মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব স্থানীয় বাঙালি ও অবাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে উদ্যোগী হন। এসব কারণে স্বাধীনতাবিরোধীদের হত্যা পরিকল্পনায় তার নাম যোগ হয়।

এছাড়া কাদের মোল্লার নেতৃত্বে তার সহযোগী বিহারিরা ২৭ মার্চ কবি মেহেরুন্নেছা মেহের ও তার পরিবারের সদস্যদের মিরপুরের বাড়ির ভেতরে ঢুকে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করেন। জবাই করার পর কবি মেহেরুন্নেছা কল্লাটা কেটে চুল দিয়ে  ফ্যানের সঙ্গে লটকিয়ে দেন তারা। এই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখে বাড়ির সিরাজ নামে এক ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

২ এপ্রিল স্থানীয় আলবদর বাহিনীর নেতা কাদের মোল্লা তার সহযোগী আল বদর বাহিনীর সদস্য ও বিহারীদের নিয়ে ঢাকার কল্যাণপুর, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে নিরীহ নিরাপরাধ বাঙালিদের ঘরবাড়ি লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও স্বাধীনতাকামী অনেক বাঙালিকে হত্যা এবং নারীদের ধর্ষণ করেন। ওই এলাকাগুলোতে সেদিন এক বীভৎস-করুণ মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

অভিযোগে আরও বলা হয়, একাত্তরের ২৪ এপ্রিল তার সহযোগী আলবদর বাহিনীর প্রায় ৫০ সদস্যকে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় আলুব্দী (আলোকদী) গ্রাম ঘিরে নির্বিচারে গুলি করে ৩৪৪ জনকে হত্যা করেন কাদের মোল্লা।

২৪ এপ্রিল ফজরের নামাজের পর পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারযোগে তুরাগ নদীর পাড়ে আলুব্দী গ্রামের পশ্চিম পাশে অবতরণ করে। পূর্বদিক থেকে আলবদর বাহিনীর নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা তার সহযোগী আলবদর বাহিনীর প্রায় ৫০ জন সদস্য ও বেশ কয়েকজন অবাঙালি বিহারিদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় ও যোগসাজশে আলুব্দী গ্রাম ঘিরে ফেলে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালান। এ গণহত্যায় বাসু মিয়া, জহিরুল হক ওরফে জোরা মোল্লা, জেরাত আলী, ফোয়াদ আলী, শুকুর মিয়া, আওয়াল মোল্লা, ছলে মোল্লা, রুস্তম আলী ব্যাপারী, করিম মোল্লা, জয়নাল মোল্লা, কাশেম মোল্লা, বদরউদ্দিন, বিষু মোল্লা, অজল হক, ফজল হক, রহমান ব্যাপারী, নবী মোল্লা, আলামত মিয়া, মোকলেচুর রহমান, ফুলচান, নওয়াব মিয়া, ইয়াছিন ভানু, লালুচান বেপারী, সুনু মিয়াসহ ৩৪৪ জনের বেশি লোককে হত্যা করা হয়।

অভিযোগপত্রে প্রকাশ, ২৬ মার্চ সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টায় কাদের মোল্লা তার আলবদর বাহিনী নিয়ে শহীদ হযরত আলী লস্করের বাড়িতে ঢুকে মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চালান। কাদের মোল্লার নির্দেশে হযরত আলী লস্করকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার অন্ত্বঃসত্ত্বা স্ত্রী আমেনা ও দুই শিশু মেয়ে খোদেজা (৯) ও তাছলিমাকে (৬) জবাই করে হত্যা করা হয়। ছোট ছেলে বাবু, যার বয়স ছিল মাত্র ২ বছর তাকে মাটিতে আছড়িয়ে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় মেয়ে আমেনাকে (১১) পালাক্রমে ১২ জন মিলে ধর্ষণ করেন।

ঘরের ট্রাঙ্কের পেছনে লুকিয়ে থেকে তার বোনকে ধর্ষণ করার ঘটনা দেখে লস্করের বড় মেয়ে মোমেনা (তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর) জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এ ঘটনার আগেই মোমেনার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে উঠিয়ে নেয়নি। কেরাণীগঞ্জের জিঞ্জিরায় তার স্বামীর বাড়ি ছিল। তারা এ ঘটনার সংবাদ শুনে ঘটনার ৩/৪ দিন পর এ নির্মম রোমহর্ষক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভিকটিম মোমনাকে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যান। ওই ঘটনার কারণে মোমেনা প্রায় পাগল হয়ে যাওয়ায় শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তাকে ২/৩ মাস চিকিৎসা করে ভালো করান। স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের পর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মোমেনা তাদের বাড়িতে আসে। কিন্তু তার মা বাবা ভাই বোন কারও দেহাবশেষ পান নি। ঘরে তখনও রক্তের দাগ ছিল। সারা এলাকায় শুধু লাশ আর লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেন তারা। তাদের বাড়ির সব মালামাল লুট হয়ে যায়।

ওখানে গিয়ে মোমেনা বেগম স্থানীয় লোকদের কাছে জল্লাদখানার নাম শুনে জল্লাদখানায় যান এবং সেখানে গিয়ে মাথার খুলি ও হাড় দেখতে পান। জল্লাদখানায় যে নারীদের ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে, সেখানে তাদের অনেক শাড়ি চুরি ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছেন। এরপর মোমেনা বেগম পুরোপুরি পাগল হয়ে যাওয়ায় তাকে ৩ বছর শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। অনেক চিকিৎসার পরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক ও আইনজীবী খন্দকার আবু তালেবকে হত্যার অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে।  অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, খন্দকার আবু তালেব আইন পেশার পাশাপাশি সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ, দৈনিক আযাদ, সংবাদ, ইত্তেফাক, দ্য মর্নিং নিউজ, অবজারভার ও পয়গাম পত্রিকায় কাজ করেছেন। ২৯ মার্চ অফিস থেকে মিরপুরে ফেরার পথে ইত্তেফাকের তত্কালীন অবাঙালি চিফ অ্যাকাউনট্যান্ট আবদুল হালিম তাকে তার গাড়িতে তুলে নিয়ে পরে কাদের মোল্লার হাতে তুলে দেন।

কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা মিরপুরের ১০ নম্বর জল্লাদখানায় খন্দকার আবু তালেবকে নিয়ে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন। ওই দিন বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার মিরপুর ১০নং বাসস্ট্যান্ড ও মিরপুর জল্লাদখানায় হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।

তবে ঘাটারচর গণহত্যার সঙ্গে কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতা রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেনি বলে ট্রাইব্যুনাল রায়ে উল্লেখ করেছেন। ওই অভিযোগ বলা হয়েছে, ২৫ নভেম্বর কেরাণীগঞ্জের ভাওয়াল খানবাড়ি ও ঘাটারচর (শহীদনগর) এবং পাশ্ববর্তী দু’টি গ্রামে কাদের মোল্লা তার সহযোগী আলবদর বাহিনীর সদস্যসহ পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করেন। হত্যাকাণ্ডের পর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মোজাফফর আহম্মেদ খানের বাড়িসহ দু’টি গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেন।

সেখানে যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছেন, ওসমান গনি, গোলাম মোস্তফা, দরবেশ আলী, আরজ আলী, রাজা মিয়া, আব্দুর রহমান, আব্দুল কাদির, সোহরাব হোসেন, আব্দুল লতিফ, নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলীসহ আরও অনেকে।

গ্রেফতার হয়েছিলেন বাহাত্তরেই
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ, কাদের মোল্লা মুক্তিযুদ্ধকালে মিরপুরে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ফরিদপুরে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে ফের প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসেন তিনি।

১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইসলামী ছাত্রসংঘ ইসলামী ছাত্রশিবির নামে প্রতিষ্ঠিত হলে কাদের মোল্লা ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য হন। তিনি ১৯৭৭ সালের মে মাসে জামায়াতে যোগ দেন, যদিও জামায়াত তখনও প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসেনি।

১৯৭৮ সালে তিনি ঢাকার রাইফেল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়্ত্বি পালন করেন। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতিবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও আর্থিক সহায়তায় দেশে মুসলমান ছেলে-মেয়েদের আন্তর্জাতিক মানের একটি ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে গুলশান ১ নম্বর মার্কেটের দক্ষিণ পাশে ‘মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে মানারাত ইউনিভার্সিটি হিসেবে পরিচিত। সেখানে তিনি প্রায় ১ বছর কাজ করেন।

১৯৮০ সালে দৈনিক সংগ্রাম-এর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। তখন তিনি ঢাকা মহানগর জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য থেকে সহকারী সেক্রেটারি জোনারেল পদে নিয়োজিত হন। পরবর্তী সময়ে আবদুল কাদের মোল্লা জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদে নিয়োজিত হন। তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ (সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনে জামায়াত থেকে নির্বাচন করেন। কিন্তু উভয় নির্বাচনে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ