রবিবার, এপ্রিল ২৮, ২০২৪
প্রচ্ছদঅর্থ ও বানিজ্য সময়তিন হাজার কোটি টাকার আমানত শেয়ারে রূপান্তর করবে পদ্মা ব্যাংক

তিন হাজার কোটি টাকার আমানত শেয়ারে রূপান্তর করবে পদ্মা ব্যাংক

প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে প্রিফারেন্সিয়াল বা অগ্রাধিকারমূলক শেয়ারে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে পদ্মা ব্যাংক। এ আমানতের ১ হাজার ৮২০ কোটি টাকা সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও তহবিলের। বাকি ১ হাজার কোটির বেশি আমানত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। সব মিলিয়ে ২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকার আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর করতে চাইছে বহুল আলোচিত বেসরকারি ব্যাংকটি। এজন্য আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) আয়োজন করতে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংক। সভায় এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। সেখানে পাস হওয়ার পর পরবর্তী উদ্যোগ নেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।

অগ্রাধিকারমূলক শেয়ার হচ্ছে মূলত শেয়ার ও ডিবেঞ্চারের মাঝামাঝি একটি ইন্সট্রুমেন্ট। এ শ্রেণীর শেয়ারধারী লভ্যাংশ পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। তবে এ শেয়ারধারীদের কোনো ভোটাধিকার থাকে না। নির্দিষ্ট সময় পর অগ্রাধিকারমূলক শেয়ার থেকে ইকুইটি শেয়ারে রূপান্তরের সুযোগ থাকে। তবে অগ্রাধিকারমূলক শেয়ারকে ইকুইটি মূলধনের অংশ হিসেবে দেখানো গেলেও এটি কখনই সাধারণ মূলধনের (অর্ডিনারি ক্যাপিটাল) অংশ হবে না বলে পেশাদার হিসাববিদরা জানিয়েছেন।

বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। এ মূলধনের ৬৮ শতাংশ জোগান দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)।

জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তারেক রিয়াজ খান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেয়া নির্দেশনার আলোকে আমরা ইজিএম আয়োজন করেছি। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে প্রিফারেন্সিয়াল শেয়ারে রূপান্তরের প্রস্তাব তোলা হবে। সভায় অনুমোদন পেলে আমরা আমানত রাখা সব প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেব। পারস্পরিক সম্মতি ও চুক্তির আলোকেই শেয়ার অনুমোদন হবে। এটি হলে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহের ব্যয় কমে যাবে। আর আমানতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও দীর্ঘমেয়াদে সুফল পাবে।’

পদ্মা ব্যাংকের কাছে এখন গ্রাহকদের আমানত রয়েছে ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এ আমানত থেকে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। তবে বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেকের বেশি এখন খেলাপি। পদ্মা ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল দ্য ফারমার্স ব্যাংক নামে। চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করেছিল ব্যাংকটি। কিন্তু নজিরবিহীন ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কার্যক্রম শুরুর তিন বছরের মধ্যে ব্যাংকটি মুখ থুবড়ে পড়েছিল।

ধারাবাহিকভাবে গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে ফারমার্স ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠন করা হয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। ওই সময় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন। একই সময় অপসারণ করা হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। এরপর চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে দ্য ফারমার্স থেকে পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডে রূপান্তর করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে পদ্মা ব্যাংকের ৬৮ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে জোগান দিতে হয়েছে ৭১৫ কোটি টাকার পুঁজি।

২০১৮ সালের এপ্রিলে জোগান দেয়া এসব পুঁজির বিপরীতে এখন পর্যন্ত কোনো মুনাফা পায়নি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। উল্টো ধারাবাহিক লোকসানের কারণে ব্যাংকটির পুঞ্জীভূত লোকসান মূলধনের চেয়েও বেশি হয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য আর্থিক সূচকে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজিরবিহীনভাবে একের পর এক বিভিন্ন নীতি ছাড় দিয়েছে ব্যাংকটিকে। পদ্মা ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিদেশী বিনিয়োগ আনাসহ যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তার কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। শেষ পর্যন্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতকে শেয়ারে রূপান্তরের পথে হাঁটা শুরু করেছে পদ্মা ব্যাংক। প্রায় ছয় বছর চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালনের পর চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে পদ্মা ব্যাংক পর্ষদ থেকে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত পদত্যাগ করেন।

জোগান দেয়া ৭১৫ কোটি টাকার মূলধনের বাইরেও পদ্মা ব্যাংকের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। কলমানি ও স্বল্পমেয়াদি আমানত হিসেবে এ টাকা ধার নিয়েছিল পদ্মা ব্যাংক। কিন্তু দীর্ঘদিন পার হলেও এ টাকা ফেরত দিতে পারেনি ব্যাংকটি। সরকারের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ও ফান্ডের ৭৬০ কোটি টাকা ছাড়াও পদ্মা ব্যাংকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, জীবন বীমা করপোরেশন, সাধারণ বীমা করপোরেশন, তিতাস গ্যাস, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেড (বিআইএফএফএল), ইসলামিক ফাউন্ডেশন, নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসসহ আরো কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত জমা রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানতের পরিমাণ ২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। এ আমানতের পুরোটাই এখন অগ্রাধিকারমূলক শেয়ারে রূপান্তর করতে চাইছে পদ্মা ব্যাংক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, যেকোনো ব্যাংকে জমাকৃত আমানতের মালিকানা গ্রাহকের। এখন পদ্মা ব্যাংক যদি আমানতকে মূলধনে রূপান্তর করতে চায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকেরও অনুমতি লাগবে। ব্যাংকটির ইজিএমে প্রস্তাব পাস হওয়ার পর সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। তখন আইনি দিকগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ