বুধবার, মে ১, ২০২৪
প্রচ্ছদফিচারভাষা ও আমাদের প্রত্যাশা

ভাষা ও আমাদের প্রত্যাশা

মানুষ সামাজিক জীব। মানুষের যোগাযোগের জন্য ভাষা খুব প্রয়োজন। ভাষা না থাকলে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পিতামাতা কারও সঙ্গে মানুষ কথা বলতে পারত না। লেখাপড়ার বিষয়গুলো নানান ভাষায় লেখা হয়ে থাকে। ভাষা না থাকলে বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা কিছুই প্রকাশ হতো না। ফলে আমরা লিখতে ও পড়তে পারতাম না। ভাষা মানুষের জীবন ও শেকড়ের সঙ্গে জড়িত। ভাষা আছে বলেই মানুষের এত দাম, ভাষা ছাড়া মানুষের জীবন অর্থহীন। আবার মানুষ মননশীল। মানুষ নিজকে নিয়ে, অন্যকে নিয়ে ভাবে। মানুষ চিন্তা করে, সে চিন্তা হতে পারে নিজকে নিয়ে, হতে পারে মা-বাবা, ভাই-বোন কিংবা পরিবার নিয়ে কিংবা চারপাশের প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে। মানুষ স্বপ্ন দেখে, নানান রকম স্বপ্ন। সে স্বপ্ন হতে পারে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে। হতে পারে কোনো মানুষকে আপন করে পাওয়ার। মানুষ কল্পনা করে। সে কল্পনায় মানুষ অনায়াসে পৌঁছে যায় মঙ্গলগ্রহে। পৌঁছে যায় ইচ্ছড়ানায় ভর করে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। মানুষের এই ভাবনা, ইচ্ছা আর আকাঙ্ক্ষার কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য কণ্ঠধ্বনির সাহায্য নিতে হয়। আবার কখনো কখনো মানুষ হাত, পা, চোখ ইত্যাদি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাহায্য ইশারায়ও মনের ভাব প্রকাশ করে। তবে কণ্ঠধ্বনির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ যতটা সহজ অন্যভাবে ততটা সহজ নয়।
আদিম যুগের মানুষ নানা আকার – ইঙ্গিতে এবং অস্ফুট ধ্বনির মাধ্যমে পারস্পরিক ভাবের আদান প্রদান করত। পরবর্তীকালে ভাষা সেই স্হান দখল করে। এভাবেই কালের বিবর্তনে ভাষার উৎপত্তি হয়।
পৃথিবীতে যেদিন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, সেদিন থেকেই হয়েছে ভাষার জন্ম। তবে আদিমকালের মানুষ যে ভাষায় বা যেভাবে কথা বলত তা ছিল না সাজানো গোছানো। এখনকার মতো সুন্দর, সাজানো গোছানো ভাষা পেতে মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক কাল। তারপর নানা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে মানুষ পেয়েছে আজকের ভাষা।
বহুভাষাবিদ পÐিত ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ভাষার জন্ম নিয়ে বলেছেন, ‘ভাষার জন্ম জীবের জন্মের ন্যায় নয়। অমুক সন তারিখে অমুক ভাষার জন্ম হইয়াছে; এইরূপ কথা বলিতে পারি না। ভাষা নদীর প্রবাহের ন্যায়। বিভিন্ন স্হানে তাহার বিভিন্ন নাম। যখন একটি ভাষা প্রবাহের মধ্যে কোনো সময়ের তাহার পরবর্তী ভাষাভাষীদিগের নিকট একটি নতুন ভাষা বলিয়া বোধ হয় তখন তাহার নতুন নামকরণ হইয়া থাকে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘ভাষা সম্ভবই হতো না, যদি না মানুষের স্বভাবের মধ্যে ভাষার বীজ থাকত। মানুষের সৃষ্টির সঙ্গেই তার মধ্যে এই ভাষার বীজ রেখে দিয়েছিলেন। এই হিসেবে ভাষাকে মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তার দান বলা যেতে পারে। কিন্তু এই বীজ কী? সেটি হচ্ছে প্রত্যেক জিনিসের অনুভূতির সঙ্গে মানুষের গতি প্রকৃতি। একটা বাঘ বা সাপ দেখলে মানুষ পালাতে চায়; জল দেখলে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য সেদিকে যেতে চায়, মানুষ শব্দ শুনলে শব্দের দিকে কান বাড়িয়ে দেয়। যখনই অনুভূতি স্মরণে আসে, তখনই পূর্বের গতি প্রবৃত্তিও জেগে ওঠে। যখন মানুষের গতি প্রবৃত্তি অঙ্গভঙ্গি থেকে বাগযন্ত্রের গতিতে পরিণত হলো, তখনই প্রথম ভাষার উৎপত্তি হলো। প্রথমে গতি, পরে অঙ্গভঙ্গি শেষে ভাষা। এই হলো ভাষার জন্মকথা।’
এক এক জাতি ও দেশের ভাষা এক এক রকম হয়। বর্তমান পৃথিবীতে কতগুলো ভাষা আছে, আর কতগুলো ভাষায় মানুষ কথা বলে তার সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একটি করে ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া মানে ঐ ভাষায় কথা বলার মতো একজন লোকও পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকছে না। বিশ্বে কমপক্ষে ১০০টি ভাষায় কথাবলা লোকের সংখ্যা হাতেগোনা। এসব ভাষাভাষী লোকদের খুঁজে বের করাও মুশকিল। এ ধরনের কয়েকটি বিখ্যাত ঘটনা আছে, তারমধ্যে একটি হচ্ছে: ম্যারি স্মিত জোনস নামে এক মহিলা ২০০৮ সালে আলাস্কায় মারা যান এবং তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার মাতৃভাষা ইয়াক ভাষারও মৃত্যু ঘটে। অর্থাৎ তিনি ছাড়া এই ভাষা জানা বা এই ভাষায় কথাবলা মানুষ আর কেউ না থাকায় ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এমনটি ঘটনা অন্যত্রও ঘটছে। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি বিশ্বের এক বিরাট সংখ্যক ভাষার চর্চাকারী মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে, যা ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ। আর ভাষার বৈচিত্র্য কমে যাওয়ার অর্থ মানুষের চিন্তাভাবনা ও মনীষা বৈচিত্র্যহীন এবং সীমাবদ্ধ হয়ে পড়া; যেমনটি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যে নদী হারায় স্রোত, চলিতে না পারে/ অসংখ্য শৈবাল ধাম বাঁধে আসি তারে।’ ভাষাবিদরা তাই ধারণা করছেন, এভাবে ভাষা হারাতে থাকলে আগামী ১০০ বছরে পৃথিবী থেকে ৩০০০ ভাষা হারিয়ে যাবে। সে হিসেবে গড়ে প্রতি দু’সপ্তাহে একটি করে ভাষা অবলুপ্ত হবে বা হারিয়ে যাবে।
পৃথিবীতে তালিকাভুক্ত ভাষার সংখ্যা ৬০৬০টি। তবে মজার ব্যাপার হলো পৃথিবীর বিখ্যাত দশটি ভাষায় সারাবিশ্বের অর্ধেক মানুষ কথা বলে ; অবশিষ্ট ৬০৫০টি ভাষায় কথা বলে পৃথিবীর বাকি অর্ধেক মানুষ । সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলে —এমন দশটি ভাষা হলো : ১. চায়না ম্যান্ডারিন, ২.স্প্যানিশ, ৩. ইংরেজি ৪. হিন্দি/উর্দু ৫. আরবি ৬. পর্তুগিজ ৭. বাংলা ৮. রুশ ৯. জাপানি ১০. পাঞ্জাবি। পৃথিবীতে ৫০টির মতো ভাষা আছে, যে ভাষাগুলোতে মাত্র ১জন করে লোক কথা বলে। আর ঐ একজন করে লোক পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে ঐ ৫০টি ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। পৃথিবীতে ৫০০টির মতো ভাষা আছে , যার এক একটি ভাষায় কথা বলে মাত্র ১০০ জন করে লোক। ঐ ১০০ জন মানুষের মৃত্যু হলে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে আরো ৫০০টি ভাষা। দেশ বড় বা জনসংখ্যা বেশি হলেই যে ভাষার সংখ্যা বেশি হবে এমন কোন কারণ নেই। তাহলে চীন ও ভারতেই ভাষার সংখ্যা বেশি হতো। বিশ্বে পাপুয়া নিউগিনি নামে একটি রাষ্ট্র আছে, ঐ একটি মাত্র দেশে কথা বলার জন্য চালু রয়েছে ৮১৭টি ভাষা। অথচ চীনের মতো এত বড় দেশে, যার জনসংখ্যা শত কোটিরও বেশি, সেখানে ভাষামাত্র ২০৫টি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে চালু আছে ৪০৭ টি ভাষা। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশেও কম করে হলেও ৩০ টি ভাষা প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে বাংলা ছাড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে সব ভাষা প্রচলিত আছে তাহলো: চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, লুসাই, সাঁওতালি, মণিপুরি প্রভৃতি। এ ভাষা গুলোর মধ্যে বাংলা ছাড়া একের সঙ্গে অন্যের অনেক মিল রয়েছে। আবার সামান্য কিছু তারতম্যের জন্য নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলোর নাম হয়েছে আলাদা আলাদা।
চলছে ভাষার মাস ফেব্রæয়ারি। বাঙালির আবেগ, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা এ মাসটা এলে যতটা উথলে ওঠে, এ মাস যেতে না যেতে আবার নেতিয়ে পড়ে। আবার আমরা বাংলা ভাষার পরিচর্যার বদলে মেতে উঠি অন্য ভাষায়। আমাদের উচিত আমাদের শেকড় ঠিক রেখে তারপর অন্য ভাষার চর্চা করা। আমার ছেলেমেয়েরা বাংলা বলে না বা বলতে পারে না এ ধরনের বুলি আওড়ানো যতটা গর্বের ততটা লজ্জার। এই বোধটা বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমাদের সবার থাকা উচিত। আমাদের জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা শাণিত হোক, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে মাতৃভাষাপ্রীতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাক, একুশ আমাদের অহংকার- সে অহংকার হৃদয়ের শিরা উপশিরাকে উজ্জীবিত করুক, বাংলা ভাষার শুদ্ধস্বর সারা বছর উচ্চারিত হোক, এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : এমরান চৌধুরী, শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ